ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

বেনারসী পল্লী

প্রকাশিত: ০৫:২৫, ১১ নভেম্বর ২০১৪

বেনারসী পল্লী

বেনারসী এক সময় শুধুমাত্র বিয়ের শাড়ি হিসেবে পরিচিত ছিল। আস্তে আস্তে তাঁতিরা বেনারসী শাড়িকে বৈচিত্র্যপূর্ণ ডিজাইন দিতে সক্ষম হলে তা হয়ে ওঠে সর্বসময়ের শাড়ি হিসেবে। পার্টি কিংবা ভ্রমণে সাধারণ শাড়ির পাশাপাশি এখন বেনারসী শাড়ি নারীদের প্রিয় শাড়ি হিসেবে জনপ্রিয়তা লাভ করছে। তাই বেনারসীর চাহিদা বেড়েছে। কিন্তু বেদনার বিষয় ঢাকার মিরপুরে বেনারসী পল্লীতে যে শতাধিক বেনারসী শাড়ির শোরুম আছে তার ৬০% শাড়ি হচ্ছে ভারতের। ক্রেতাদের চাহিদা মিটাতেই দোকান মালিকরা দেশের তৈরি বেনারসী শাড়ির পরিবর্তে ভারতীয় শাড়ি রাখতে বাধ্য হচ্ছে। অনেক তাঁতি নিজের পেশা ছেড়ে অন্য কাজে জড়িয়ে পড়ছে। দেশীয় শিল্পের এই পরিণতি কখনও গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। আমাদের বেনারসী শিল্পকে বাঁচাতে হলে তাঁতশিল্পীদের আবার তাদের কাজে ফিরিয়ে এনে শিল্পটির অধিকতর উন্নয়ন ঘটানো উচিত। এই অঞ্চলের তাঁত শিল্পের ইতিহাস অতি প্রাচীন ও সুষমাম-িত। হাজার হাজার বছর আগে ঢাকায় যে মসলিন তৈরি হতো তা ইউরোপের বাজারে বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করে। মসলিন ছিল জগদ্বিখ্যাত। একে বলা হতো কুয়াশার চাদর বা বাতাসের ইন্দ্রজাল। ইংরেজ শাসকরা এই শিল্প ধ্বংস করে দেয়। ফলে হারিয়ে যায় মসলিন। আজও এই অঞ্চলের তাঁতিরা উৎপাদন করে যে সব শাড়ি তার চাহিদা উন্নত বিশ্বে এখন ব্যাপকতা লাভ করেছে। ইউরোপ ও আমেরিকার বাজারে তাঁত বস্ত্র জনপ্রিয়তা হিসেবে ব্যাপক চাহিদার কারণ, এই বস্ত্র হাতে চালিত তাঁতে উৎপাদন করা হয় তাই এতে কোন তেল বা বিদ্যুত ব্যবহৃত হয় না। ফলে এই বস্ত্র উৎপাদন প্রক্রিয়া পরিবেশবান্ধব। তাছাড়া তাঁতের বস্ত্র হাতে বুনন করা হতো তাই এর প্রতিটি সুতার সঙ্গে লেগে থাকত বুননকারী তাঁতির কোমল হাতের স্পর্শ। স্বাধীনতার পর নানা কারণে এই শিল্পের ওপর কিছুটা বিপর্যয় নেমে আসে। সেই সময় কারিকা, আড়ং, কুমুদিনী ও টাঙ্গাইল শাড়ি কুটিরের উদ্যোগে আবার এই শিল্প বিকাশ লাভ করে। টাঙ্গাইল ও পাবনার সুতি শাড়ি, রাজশাহীর সিল্ক, নারায়ণগঞ্জের জামদানী, মিরপুরের বেনারসী ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে। মানুষ দেশের শাড়ি পরতে উৎসাহী হয়। এই বিপর্যয়ের প্রধান কারণ হচ্ছে পরিকল্পনামাফিক এই শিল্পকে গতিশীল করার ক্ষেত্রে উদাসীনতা। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর ভারতের বেনারস থেকে আসা কয়েকজন কারিগর মিরপুরে বসবাস শুরু করে এবং সেখানেই কাতান-বেনারসী শাড়ি বানানো শুরু করেছিল। আস্তে আস্তে এই শিল্পের বিকাশ ঘটে। গড়ে ওঠে মিরপুরের বেনারসী পল্লী। বিশ-পঁচিশ বছর আগেও বেনারসী পল্লীতে যে শাড়ি তৈরি হতো তার সুনাম ছিল সর্বত্র। কিন্তু দেশের নারীরা আস্তে আস্তে এই শাড়ির প্রতি আকর্ষণ হারিয়ে ফেলে। অনেকে মনে করেন ভারতীয় টিভিতে হিন্দি ধারাবাহিক নাটক দেখে অনেকে এই শাড়ি পরতে আগ্রহী হয়। শুধু তাই নয়, মিরপুরের দক্ষ তাঁতিরা অন্য পেশার সঙ্গে জড়িয়ে পড়ার কারণে এই শাড়ির মান অনেক কমে যায়। মিরপুরের বেনারসী শাড়ির গৌরবময় বাজার ফিরিয়ে আনতে হলে কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে এবং দেশের তাঁত শিল্পের উপকরণের জন্য ভর্তুকি এবং স্বল্পসুদে ঋণের ব্যবস্থা করতে হবে। কারিগরদের দক্ষ করার জন্য প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে পারলে এই শিল্প আবার তার আগের চেহারা ফিরে পাবে। আগে ক্রেতাদের নিজেদের উদ্যোগী হয়ে দেশীয় শাড়ি বস্ত্র ব্যবহারে আগ্রহী হতে হবে। যেসব তাঁতি দীর্ঘদিন এই শিল্পের সঙ্গে জড়িত থেকে আজ অন্য পেশায় চলে গেছে তাদের এই শিল্পের সঙ্গে আবার সম্পৃক্ত করতে পারলে এই শিল্প বিকাশ লাভ করতে বাধ্য। দেশ নিজ শিল্প সম্পদে সমৃদ্ধ হবে, উন্নত হবে এবং বাড়বে অর্থনীতির গতি। সরকারের পাশাপাশি ব্যক্তি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান ও এনজিওগুলো বেনারসী শিল্পের উন্নয়নে এবং বাজার তৈরিতে কাজ করতে পারে। বাংলাদেশের বেনারসী শিল্প যাতে অধিকতর বিকশিত ও উন্নত হয়, এই শাড়ির বাজার যাতে ব্যাপকতর হয়ে ওঠে সেই লক্ষ্যে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে যথাযথ উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।
×