ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

বিক্রমজিৎ ভট্টাচার্য

‘হায়দার’, মুস্তাক, মেহরাজ ... কাশ্মীর

প্রকাশিত: ০৫:৩৯, ৯ নভেম্বর ২০১৪

‘হায়দার’, মুস্তাক, মেহরাজ ... কাশ্মীর

‘হায়দার’ দেখার পরে লোকে আবার কাশ্মীর নিয়ে আলোচনা করছে। রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস কিভাবে কাশ্মীরকে তছনছ করে রেখেছে, সেই সত্যকে যেন ছুঁয়েও ছুঁতে চাননি বা পারেননি ছবির পরিচালক। তবে বিতর্ক উস্কে দিয়েছেন, এটা বুদ্ধিমানরা জানেন। গণতন্ত্রে বিভিন্ন মাত্রা থাকে, জাতীয়তাবাদই একমাত্র মাত্রা হতে পারে না। বিকল্প স্বর গণতন্ত্রের স্বার্থেই অত্যন্ত প্রয়োজন। হায়দরের ট্র্যাজেডি গোটা কাশ্মীরের, নিজভূমে কিছুতেই থিতু হতে না পারা কাশ্মীরীদের। যেমন হ্যামলেটের ট্র্যাজেডি ছিল গোটা ডেনমার্কের। ভারতীয় ভূখ-ে পরিচিতির দ্বন্দ্ব যদি কোথাও থেকে থাকে সেটা প্রকটভাবে আছে কাশ্মীরেই। কাট-১ ২০১১ সালে জম্মু কাশ্মীর হাইকোর্ট এক রায়দান করে জনৈকা আরজা বেগমকে ১০ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দেয়ার নির্দেশ দেন সরকারকে। ১৪ বছর আগের এক ঘটনা প্রবাহ বলছে ১৯৯৭ সালের এক গভীর রাতে আরজার ছেলে মুস্তাক আহমেদকে সন্ত্রাসবাদী সন্দেহে গ্রেফতার করা হয়। মুস্তাক পেশায় ছিলেন অটোচালক। আশ্চর্যজনকভাবে মুস্তাককে আর পাওয়া যায়নি। আইনী ভাষায় যাকে বলে ‘ঈঁংঃড়ফরধষ উরংধঢ়ঢ়বধৎধহপব’ পুলিশ হেফাজত থেকে নিখোঁজ। মুস্তাকের মা বিগত ১৪ বছর ধরে হন্যে হয়ে খুঁজে বেড়িয়েছেন তাঁর ছেলেকে। কাশ্মীরের প্রতিটি জেলে খুঁজেছেন, দেখা তো পানইনি, উল্টো জুটেছে দুর্ব্যবহার আর ‘সন্ত্রাসবাদীর মা’ এই তকমা। কোর্টের রায়দানের পরে আরজার প্রতিক্রিয়া ছিলÑ টাকা নয়, আমি চাই সুবিচার। হ্যাঁ তিনি চেয়েছিলেন দোষীদের শাস্তিÑ যেটা দিতে গেলে সরকারকেই তো পিছু হঠতে হবে, তাই সেটা কাশ্মীরে অসম্ভব। সশস্ত্র বাহিনীর বিশেষ ক্ষমতা আইন (অঋঝচঅ)র ৪ নং ধারা সরাসরি সশস্ত্র বাহিনীকে ক্ষমতা প্রদান করছে শুধুমাত্র সন্দেহের বশেই কাউকে চ্যালেঞ্জ করে গ্রেফতার করার এবং গুলি ছোড়ার। কাট-২ সাল ১৯৯১-এর ফেব্রুয়ারি। কাশ্মীরের কুপওয়াড়া থেকে ৭ কিলোমিটার দূরে পাশাপাশি একজোড়া গ্রাম কুনান আর পোশপোরা। রাত ১০টা নাগাদ সেই দুটো গ্রামে হঠাৎ ভারতীয় সেনাবাহিনীর ‘রাজপুতানা রাইফেলস ব্রিগেড’...। জঙ্গী লুকিয়ে আছে সন্দেহে শুরু হবে তল্লাশি, স্থানীয় ভাষায় যার নাম ‘ক্র্যাক ডাউন’। কিন্তু সেদিন ঠিক কি হয়েছিলÑ শোনা যায় গ্রামের পুরুষদের ধরে বেঁধে তল্লাশির নামে অন্যত্র সরিয়ে দেয়ার পরে পৈশাচিক আনন্দে ওই দুটো গ্রামের মেয়েদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল সেনারা। ১৫ বছরের ফুটফুটে কিশোরী থেকে শুরু করে ৭৮ বছরের ন্যুব্জ বৃদ্ধ নারী কেউ সেদিন ছাড় পায়নি সেনাদের বর্বরতার হাত থেকে। অভিযোগ দায়ের হয়েছিল অবশ্য মোটে ২৩টা। তবে আসল সংখ্যাটা ছিল প্রায় ১০০-এর কাছাকাছি। তা সত্ত্বেও অভিযোগের সংখ্যা এত কম, কারণ সেই, লোকলজ্জার ভয়। এতকিছুর করেও অবশ্য নিজেদের সেদিন পুরোপুরি লুকিয়ে রাখতে পারেনি কুনান-পোশপোরার লোকজন। তাদের বাকি জীবনটাকে ছারখার করে দিয়েছে ওই রাতের ঘটনাটাই। মানুষের মুখে মুখেই তো খবর ছড়িয়ে পড়েছিল চারপাশে। আর এরপর থেকে শুধু যে সেই দুই গ্রামের কোন মেয়েকে আর বাইরের গ্রামের কেউ বিয়ে করতে চাইত না তাই নয়, স্কুল-কলেজে পর্যন্ত সহপাঠীদের টিটকিরির চোটে দুর্বিষহ হয়ে উঠত তাদের জীবন। বাকি ভারত কি আদৌ জেনেছে বা মনে রেখেছে সেই লজ্জার ইতিহাস? ভারতীয় সেনারা তো গোড়াতেই অস্বীকার করে সব অভিযোগ থেকে হাত ধুয়ে ফেলেছে। ‘হায়দর’ ছবিতেও গোড়ার দিকে একটি দৃশ্যে গ্রামের সব পুরুষকে হেঁকে-ডেকে বাড়ি থেকে বের করিয়ে আনে মিলিটারি। কিন্তু তারপর থেকেই গ্রামের মেয়েদের কি হয়, সেই বিষয়ে ছবি রহস্যজনকভাবে নীরব। কাট-৩ নবেম্বর ৩, ২০১৪। বাদগাম জেলায় ছাত্তার গ্রামে ফয়সল মেহরাজুদ্দিন, বাসিমসহ বন্ধুরা গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছিল। আর্মি চেকপোস্টের আগে গাড়ি থামাতে বলে, আর্মির ইশারা দেখতে না পেয়ে সামান্য একটু দূরেই তারা ব্রেক কষে গাড়ি থামায়, ততক্ষণে উনিশ বছরের তরতাজা ফয়সল ও মেহরাজ দু’জনেই খতম আর্মির বুলেটে। হতবাক গোটা কাশ্মীর, হতবাক দেশ, ঝড় উঠেছে প্রতিবাদের। চাপে পড়ে আর্মি নিজের ভুল স্বীকার করে তদন্তের নির্দেশ দিয়েছে। হ্যাঁ, এটাই আজ এখনকার কাশ্মীর। ১৯৯০ সাল থেকেই কাশ্মীর উপত্যকায় লাগু হয়ে গেছে এই ‘আর্মড ফোর্সেস স্পেশাল পাওয়ার এ্যাক্টস’ সংক্ষেপে যাকে সবাই ‘আফস্পা’ বলে জানে। ‘হায়দর’ ছবিতে এই আইনটাকেই ব্যঙ্গ করে বলা হয়েছে চুতস্পাা। হিন্দী সø্যাং চুতিয়া শব্দটার অর্থ হলো বোকা। কিন্তু বোকা শব্দটা দিয়ে কি এই আইনের এক পার্সেন্টও বোঝানো যায়। এই আইনের দৌলতে এতটা ক্ষমতা পেয়ে যায় কোন দেশের মিলিটারি যে তারা বিনাবাক্য ব্যয়ে, কোন কারণ না দর্শিয়ে যে কোন রকম নির্যাতন করতে পারে, যে কাউকে এমনকি অসহায় মেয়েদের ওপর নৃশংস গণধর্ষণও তাতে বাদ যায় না। কাকে সবক শেখাতে চায় রাষ্ট্র কে জানে! বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন বছরের পর বছর গলা ফাটিয়ে প্রতিবাদ করে যাচ্ছে এই আফস্পা তুলে নেয়ার জন্য। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলও বলছে। শুধুমাত্র সীমান্ত অঞ্চলেই এই আফস্পা জারি রেখে কাশ্মীরের বাকি অংশে এই আইন তুলে নেয়া হোক। ঝঃধঃব ঐঁসধহ জরমযঃং পড়সসরংংরড়হ তাদের এক রিপোর্টে উল্লেখ করেছেÑ উত্তর কাশ্মীরের প্রচুরসংখ্যক কবরস্থানে ঘুমিয়ে রয়েছে মুস্তাকের মতোই হারিয়ে যাওয়া ‘সন্ত্রাসী’রা। আরজার মতো শয়ে শয়ে মা তাদের মুস্তাককে হারিয়েছেন চিরতরে, মৃতদেহটুকুও কোথাও পাওয়া যায়নি। এই আফস্পা ব্যবহারকারীরা নিজেদের আইনের ওপরেই ভাবে কারণ তারা সাধারণ নিয়মটুকুও মেনে চলে না। কাউকে গ্রেফতারের পরে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে কোন আদালতে পেশ করতে হবে- এটিও তারা থোড়াই কেয়ার করে। রাষ্ট্র তাদের এমন ক্ষমতা দিয়ে রেখেছে যে তারা কথা কম বলে বুলেট বেশি খরচা করছে নির্লিপ্তভাবে। আর ফলস্বরূপ কাশ্মীরজুড়ে বেড়ে চলেছে অবৈধ কবরের সংখ্যা! আবার অন্যদিকে কাশ্মীরকে নিজেদের কব্জায় আনার জন্য পাকিস্তান একটানা অন্ধ ধর্মীয় মৌলবাদকে লাগাতার অর্থ ও অস্ত্র জুগিয়ে চলেছে। আইএসআইয়ের মদদে একের পর এক তৈরি হয়েছে ইসলামিক জঙ্গী গোষ্ঠী, যারা ১৯৯০ থেকে একটানা তাদের অপারেশন চালিয়ে যাচ্ছে। কাশ্মীরকে সম্পূর্ণ ইসলামিক রাষ্ট্র তৈরি করার লক্ষ্যে অবাধে কাশ্মীরী হিন্দু প-িত ও তাদের পরিবারকে নৃশংসভাবে হত্যা, খুন, ধর্ষণ করে গেছে। উদাহরণস্বরূপ, লোহার শিক গরম করে একজন হিন্দু প-িতের ১৫ বছরের মেয়ের দুই উরুতে লিখে দেয়া হয়েছে ‘খড়হম খরাব চধশরংঃধহ.’ গত দু’ দশকে বিভিন্ন সময়ে অপহরণ করে খুন করা হয়েছে কাশ্মীরী হিন্দুদের, ভয়ে পালিয়ে গেছেন এই উপত্যকায় বাস করা ৯০ শতাংশ হিন্দুই। মনি রতœমের ‘রোজা’ ছবিতে প্রথম কাশ্মীরজুড়ে চলা উগ্রপন্থার খোঁজ পেয়েছিল বাকি দেশের মানুষ, কিন্তু রোজার প্রেক্ষাপট ছিল ভিন্ন। আসলেই পক্ষপাতহীনভাবে কাশ্মীরকে, কাশ্মীরের দ্বন্দ্বকে নিয়ে লেখার, বলার, ছবি তৈরির কেউ নেই-না ভারতে, না পাকিস্তানে। সমস্যার সরলীকরণ করে হিন্দু মুসলিম ভেদাভেদের চেষ্টা না করাই ভালো। এতে কাশ্মীরের প্রতি, কাশ্মীরীদের প্রতি অন্যায় হবে। কাশ্মীরে এখন দুই ধরনের ভাগ আছে। সংখ্যাগুরু ভাগ ভাবে তাদের স্বাধীন স্বতন্ত্র রাষ্ট্র হয়ে যাওয়া উচিত। আরেক অল্পসংখ্যক ভাগ মনে করে যেহেতু তারা মুসলিম তাই তাদের ‘হিন্দু রাষ্ট্র’ ভারতের সঙ্গে না থেকে পাকিস্তানের সঙ্গে থাকা উচিত। সব মানুষÑবাচ্চা থেকে বুড়ো, ছেলেমেয়ে নির্বিশেষে সবাই ক্ষুব্ধ শুধু কিন্তু এই সেনা কার্যকলাপের ওপরেই এবং সকলেই রাজনৈতিকভাবে সচেতনও। নিরক্ষর গ্রাম্য একজন সাদাসিধে কাশ্মীরীর মুখ থেকেও কেউ খুঁচিয়ে ‘আমি ইন্ডিয়ান’ তো বলাতেই পারবে না। তার মানে এই নয় যে তারা নিজেদের পাকিস্তানী বলছে, তাই মিছামিছি পাকিস্তানের উল্লাসেরও কিছু নেই; কারণ এরা নিজেদের একমাত্র ‘কাশ্মীরী’ বলতেই ভালবাসে। ৫২-এর বাতিল হওয়া গণভোট ভবিষ্যতে কখনও হলে এই সত্যই প্রতিষ্ঠিত হবে- কাশ্মীরে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ কখনই পাকিস্তানে যেতে চান না, তাঁরা ন্যায়বিচার চান, ফিরিয়ে নিয়ে যেতে চান সেই কাশ্মীরে যেটা ১৯৯০ সালের আগে পর্যন্ত ছিল একটা ২০০ কোটি টাকার পর্যটন শিল্প, যাদের আতিথেয়তা ছিল পৃথিবীখ্যাত।
×