ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

মাশরুম চাষে স্বাবলম্বী

শুরু হাজার টাকা দিয়ে এখন পুঁজি পাঁচ লাখ মাসে আয় ৪০ হাজার

প্রকাশিত: ০৪:৪৫, ৯ নভেম্বর ২০১৪

শুরু হাজার টাকা দিয়ে এখন পুঁজি পাঁচ লাখ মাসে আয় ৪০ হাজার

মোঃ খলিলুর রহমান ॥ আগে শাকসবজি আবাদ করতেন। এখন মাশরুম চাষী। মাশরুম চাষী তোফাজ্জল হিসেবেই পরিচিতি তাঁর। ২০০৫ সালের কথা। মাত্র এক হাজার টাকা বিনিয়োগ করে মাশরুম চাষ শুরু করেন তিনি। আর এখন তাঁর পুঁজি পাঁচ লাখ টাকা। আর এই বিনিয়োগ মাশরুম চাষের লাভের টাকা থেকেই। দীর্ঘ নয় বছর ধরে ওয়েস্টার মাশরুম আবাদ করে চারদিকে বেশ সুনাম কুড়িয়েছেন তিনি। মাশরুম চাষ করে তোফাজ্জল এখন স্বাবলম্বী। শুধু মাশরুম চাষেই সীমাবদ্ধ নেই তিনি, মাশরুমের চারা ও স্পনও বিক্রি করছেন। দূর-দূরান্ত থেকে লোকজন পূর্ণাঙ্গ মাশরুম, মাশরুমের চারা ও স্পন কিনতে তোফাজ্জলের বাড়িতে ছুটে আসছেন। আর এ থেকে প্রতিমাসে তাঁর আয় ৩৫-৪০ হাজার টাকা। প্রতিদিন বাগান থেকে ২৫-৩০ কেজি পূর্ণাঙ্গ মাশরুম বিক্রি করতে পারেন। শীত মৌসুমে মাশরুমের ফলন ভাল হয়। তবে গ্রীষ্মকালে ফলন একটু কমে যায়। জালকুঁড়ি গ্রামে তিনিই একমাত্র মাশরুম চাষী। তোফাজ্জল হোসেন (৩৬) নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জ থানার জালকুঁড়ি গ্রামের বাসিন্দা। পিতার নাম মোহর আলী। চার ভাই ও তিন বোনের মধ্যে তোফাজ্জল সবার ছোট। ১৯৯৮ সালে বিদেশে যাওয়ার জন্য দালালকে সাত লাখ টাকা দিয়ে প্রতারণার শিকার হন। এরপর তোফাজ্জল হোসেন বোনদের সঙ্গে ২০০৫ সালে জালকুঁড়ি পশ্চিমপাড়া টিসি রোডে ১৩ কাঠা জমি কিনে বসবাস শুরু করেন। এ গ্রামে প্রচুর পরিমাণে শাকসবজির আবাদ হয়। তোফাজ্জল জালকুঁড়ি গ্রামে এসে সর্বপ্রথম শাকসবজির আবাদ শুরু করেন। এরপর মাশরুম চাষে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। ওই বছরই পত্রিকায় মাশরুম আবাদের খবর পড়ে আরও বেশি আগ্রহী হয়ে উঠেন। পরে পাঁচ শ’ টাকা দিয়ে মাশরুম চাষের ওপর প্রাথমিক প্রশিক্ষণ নেন। এক হাজার টাকা দিয়ে ১০০টি মাশরুমের চারা কিনে নিজের বসতঘরেই চাষাবাদ শুরু করেন। পরে তিনি বুঝতে পারেন মাশরুম চাষে স্বাবলম্বী হওয়া সম্ভব। ২০০৬ সালে ঢাকার সাভার কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর থেকে তিন দিনের একটি প্রশিক্ষণে অংশ নেন। ওই বছরই সাভার থেকে পাঁচ শ’ চারা এনে পুরোদমে শুরু করেন মাশরুম চাষ। ধীরে ধীরে তিনি পরিধিও বাড়াতে থাকেন। বর্তমানে ৬টি কক্ষে মাশরুম চাষ করছেন। তাঁর রয়েছে বয়লার কক্ষ, এসি কক্ষ, স্পন তৈরির কক্ষ ও মাশরুম বেড়ে উঠার কক্ষ। তিনি তার প্রতিষ্ঠানের নাম দিয়েছেন ‘ মাশরুম প্রকল্প।’ প্রথমে তিনি স্পন তৈরি করেন। কাঠের গুঁড়া, ধানের তুষ ও গমের ভূসি মিশিয়ে ক্যালসিয়াম পাউডার দিয়ে স্পন তৈরি করেন। পরে স্পন পলিথিনে প্যাকেট করে বয়লার মেশিনে সিদ্ধ করেন। এরপর ঠা-া করে কাঁচের মধ্যে ঢুকিয়ে রাখেন। পরে এটিকে মাদার কালচার করা হয়। ২৫-৩০ দিন এসি কক্ষে স্পনটি রেখে দেয়া হয়। এসি কক্ষে ছত্রাক জন্মায়। এরপর দুই দিকে কেটে দিয়ে ২-৩ বার পানি ¯েপ্র করতে হয়। এক সপ্তাহ পরে মাশরুমের অঙ্কুর গজায়। তিন দিন পর পূর্ণাঙ্গ মাশরুমে পরিণত হয়। একটি স্পন থেকে প্রতিদিন ২৫০-৪০০ গ্রাম পূর্ণাঙ্গ মাশরুম উৎপন্ন হয়। একটি স্পন থেকে তিন মাসে ৭-৮ বার মাশরুম পাওয়া যায়। বর্তমানে তাঁর বাগানে চার হাজার মাশরুমের চারা রয়েছে। তার সাত হাজার মাশরুমের চারা রাখার জায়গা আছে। তিনি সব মিলেই পাঁচ লাখ টাকা পুঁজি খাঁটিয়েছেন। কোন সরকারী সাহায্য ছাড়াই তোফাজ্জল আজ স্বাবলম্বী। তবে তিনি মাশরুম প্রকল্পটি আরও বড় করতে চান। আর সেজন্য সরকারী সাহায্য প্রয়োজন বলে জানান তিনি। ২০১৩ সালে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় তোফাজ্জল হোসেন ডান হাত হারিয়ে এখন পঙ্গু। তাঁর চিকিৎসায় প্রায় ১০ লাখ টাকা খরচ হয়। তবুও তিনি মনোবল হারাননি, ছাড়েননি মাশরুম চাষ। এখন তিনি এক হাত দিয়েই মাশরুম চাষাবাদ করে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে জীবনধারণ করছেন। তোফাজ্জল জানান, শীত মৌসুমে প্রতিদিন ২৫-৩০ কেজি মাশরুম বিক্রি করতে পারেন। তবে গ্রীষ্মকালে ১০-১২ কেজির বেশি বিক্রি করতে পারেন না। প্রতিকেজি মাশরুম পাইকারি বিক্রি করেন ২০০ টাকায়। খুচরা বিক্রি হয় ২৫০-৩০০ টাকায়। তিনি ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জ শহরে মাশরুম বিক্রি করেন। তিনি জানান, চাইনিজ রেস্টুরেন্ট ও হোটেল-রেস্তরাঁ মাশরুমের প্রধান ক্রেতা। মাশরুম একটি হালাল ও বহুবিধ ওষুধি সুস্বাদু সবজি। মাশরুম আলুর মতো মাছ-মাংসে ব্যবহার করা যায়। এছাড়া মাশরুমের সবজিও বেশ সুস্বাদু। মাশরুম দিয়ে নুডুলসও রান্না করা হয়। তিনি জানান, তাঁর মাশরুম বাগানে জিহাদ, হেদায়েত উল্লাহ ও মাসুদ নামে তিনজন কর্মচারী কাজ করেন। তাঁর স্ত্রী সালমা আক্তার সাথীও মাশরুম চাষে তাঁকে বেশ সহায়তা করেন। তিনি জানান, মাশরুম চাষের আয় দিয়ে একটি ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও একটি ফার্মেসি করেছেন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত মাশরুম চাষাবাদে ডুবে থাকতে চান বলে জানান তোফাজ্জল।
×