ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

বায়ান্ন বাজার তিপ্পান্ন গলি ॥ মোরসালিন মিজান

প্রকাশিত: ০৫:০৭, ৭ নভেম্বর ২০১৪

বায়ান্ন বাজার তিপ্পান্ন গলি ॥ মোরসালিন মিজান

ত্রিশ লাখ শহীদের বাংলাদেশ। এখানে দেশবিরোধীদের কোন জায়গা হওয়ার কথা নয়। অথচ তাই হয়েছে। মুক্তিযোদ্ধারা অধিকাংশ ক্ষেত্রে ভাল নেই। রাজাকার, আলবদর, আলশামসরা খেয়ে মোটা-তাজা হয়েছে। এখন এদের বিপুল সম্পদ। কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা। মধ্যপ্রাচ্য থেকে ভিক্ষা করে আনা টাকা এদের পক্ষে কথা বলছে। দীর্ঘ ৪৩ বছর পর শুরু হওয়া যুদ্ধাপরাধের বিচার বাধাগ্রস্ত করতে মরিয়া চক্রটি। তবে সরকার দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। দেশী- বিদেশী চাপ মোকাবেলা করে এগিয়ে নিচ্ছে বিচারকার্য। বিশেষ করে এই সময়ে এসে নতুন মাত্রা পেয়েছে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার। অনেকদিন ধীরগতিতে চলার পর অতি সম্প্রতি তিনটি মামলার রায় ঘোষণা করেছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। মোটামুটি এক সপ্তাহের মধ্যে তিনজন শীর্ষ যুদ্ধাপরাধীর রায় শুনে সন্তুষ্ট রাজধানী ঢাকার মানুষ। আদালত বদর বাহিনীর প্রধান মতিউর রহমান নিজামী ও ইসলামী ছাত্রসংঘের চট্টগ্রাম শাখার প্রধান মীর কাশেম আলীকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদ- কার্যকরের নির্দেশ দিয়েছেন। আরেক হায়ে না কামারুজ্জামান। সব অপরাধ প্রমাণিত হওয়ায় আগেই এই ঘাতক পেয়েছিল মৃত্যুর পরোয়ানা। একই রায় বহাল রেখেছেন সুপ্রীমকোর্টের আপীল বিভাগ। কয়েকদিনের মধ্যে তিনটি মামলার এমন অগ্রগতি আশাবাদী করেছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী মানুষকে। বায়ান্ন বাজার তিপ্পান্ন গলির শহর ঢাকার অলি-গলিতে এখন এই আলোচনা। অধিকাংশ মানুষ কামারুজ্জামানের ফাঁসি কার্যকর দেখার অপেক্ষা করে আছেন। রাজধানীবাসীর চোখ এখন কেন্দ্রীয় কারাগারের দিকে। প্রধান ফটকের সামনে দিয়ে সব সময় আসা-যাওয়া করা মানুষও নতুন করে এর দিকে তাকাচ্ছেন। কারণ আর কিছু নয়, ভেতরে কনডেম সেলে মৃত্যুর প্রহর গুনছে শীর্ষ যুদ্ধাপরাধী কামারুজ্জামান। আগামী ৭ দিনের মধ্যে এই হায়েনার ফাঁসি কার্যকর করা হবে। সে লক্ষ্যে কারাগারের ভেতরে চলছে নানা আনুষ্ঠানিকতা। বাইরে থেকে এর কিছুই দেখা যায় না। দেখা অসম্ভব। এরপরও উৎসুক চোখ। মানবিক মানুষ অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন একাত্তরের খুনীর সাজা দেখবেন বলে। তাঁরা দেখতে চান অপরাধীর শাস্তি হয়। বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে বাংলাদেশের বেরিয়ে আসা দেখতে চান বিবেকবান মানুষ। যত দ্রুত সম্ভব ফাঁসি কার্যকরের খবর শুনতে আগ্রহী মানুষ কারাগারের ফটকের সামনে সামান্য পরিবর্তন দেখলে জায়গায় দাঁড়িয়ে যাচ্ছেন। পরখ করছেন পরিস্থিতি। শহিদুল নামের এক যুবক লম্বা সময় ধরে কারাগারের উল্টোদিকের একটি এটিএম বুথের সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন। চোখের পাতা যেন নড়ে না তাঁর। কেন? জানতে চাইলে প্রথমে একটু অপ্রস্তুত হয়ে যান। পরে বলেন, ‘রাজাকারের ফাঁসি হইবো ভাই। কবে হইবো কেউ কইতে পারে না। শুনলাম আজকেও হইতে পারে। তাই দেখতে আইলাম।’ একটা মানুষ ফাঁসির রশিতে ঝুলবে। এটা তো বেদনার সংবাদ। আপনি কী দেখতে এসেছেন? প্রশ্ন করলে অদ্ভুত উত্তর আসে তাঁর কাছ থেকে। বলেন, ভাই যেইডারে ফাঁসি দিব সেইডা তো রাজাকার। সংগ্রামের বছর এরা কী আকাম করছে জানেন? হ্যাঁ, মানুষ এখন সচেতন। সব ধরনের চাপ ও ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করে যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি কার্যকর করা হবেÑ এমন প্রত্যাশা তাঁদের। অবশ্য কয়লা ধুলে ময়লা যায় না। জামায়াত-শিবির তাই অপরিবর্তিত। অপরাধ স্বীকার করে নেয়ার পরিবর্তে এরা হরতাল ডাকছে। আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে হরতাল। বুধবার থেকে শুরু হয় দ্বিতীয় দফা হরতাল। হরতাল চলাকালে গাড়ি ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগের চেষ্টা করা হয়। তবে রাজধানীবাসী এবার এদের হুঙ্কারে ঘরে বসে থাকতে নারাজ। সকাল হতেই রাস্তায় নেমে আসছেন কর্মব্যস্ত মানুষ। অফিস, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, ব্যাংক- বীমায় চলেছে স্বাভাবিক কার্যক্রম। স্কুল- কলেজ খোলা। ক্লাস হচ্ছে। মাঝে মাঝেই চোখে পড়ছে স্কুল ও কলেজের ইউনিফর্ম পরা ছেলে-মেয়েরা হেঁটে যাচ্ছে। না, কোন শঙ্কা কারও চোখে-মুখে নেই। ভয়কে এরা জয় করেছে। হরতাল চলাকালে রাস্তায় দেখা যাচ্ছে সব ধরনের যানবাহন। কিছুদিন আগে সামান্য বিপদের আশঙ্কা থাকলেও কেউ নিজের গাড়ি নিয়ে বাসা থেকে বের হতেন না। এবার সেই ভয়ও কেটেছে বলে মনে হচ্ছে। গণপরিবহনের পাশাপাশি প্রচুর প্রাইভেটকার এখন রাস্তায়। ফলে মাঝে মাঝেই জ্যাম লেগে যাচ্ছে। বৃহস্পতিবার ফার্মগেট থেকে মতিঝিল ও মতিঝিল থেকে মগবাজার পর্যন্ত ঘুরে এমন দৃশ্য দেখা যায়। অন্য সময় যানজট দুর্ভোগের কারণ হলেও বর্তমানে এ যেন প্রতিবাদের স্বরূপ হয়ে উঠেছে। বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখাচ্ছে খুনীদের হরতালকে। এভাবে ভয়কে জয় করে এগিয়ে যাবে নগরবাসী। সকলের তাই প্রত্যাশা।
×