ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

বাগেরহাটের ৩ কসাইয়ের বিরুদ্ধে সাত অভিযোগ গঠন

প্রকাশিত: ০৫:৪০, ৬ নভেম্বর ২০১৪

বাগেরহাটের ৩ কসাইয়ের বিরুদ্ধে সাত অভিযোগ গঠন

যুদ্ধাপরাধী বিচার প্রসিকিউশনের সূচনা বক্তব্য ২ ডিসেম্বর স্টাফ রিপোর্টার ॥ একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে বাগেরহাটের তিন রাজাকার কসাই শেখ সিরাজুল হক ওরফে সিরাজ মাস্টার, আব্দুল লতিফ তালুকদার ও খান আকরাম হোসেনের বিরুদ্ধে হত্যা, গণহত্যা, অপহরণ আটক অগ্নিসংযোগসহ ৭ ধরনের অভিযোগ গঠন করেছেন ট্রাইব্যুনাল। অভিযোগ গঠনের মাধ্যমে তাদের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক বিচার শুরু হলো। একই সঙ্গে আসামি দুই ডিসেম্বর তাদের বিরুদ্ধে প্রসিকিউশন পক্ষের সূচনা বক্তব্য উপস্থাপনের জন্য দিন ধার্য করা হয়েছে। অন্যদিকে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে অভিযুক্ত আব্দুল জব্বার ইঞ্জিনিয়ারের বিরুদ্ধে প্রসিকিউশনের ১৮তম সাক্ষী দীপক কুমার বিশ্বাস জবানবন্দী প্রদান করেছেন। আজ নতুন সাক্ষীর জবানবন্দীর জন্য দিন নির্ধারণ করা হয়েছে। একই মামলায় জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির আব্দুস সুবহানের বিরুদ্ধে প্রসিকিউশনের যুক্তিতর্ক শুরু হয়েছে। আজ আবার প্রসিকিউশন পক্ষ যুক্তিতর্ক করার জন্য দিন নির্ধারণ করা হয়েছে। বুধবার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল ১ ও ২ এ আদেশগুলো প্রদান করেছেন। পাশাপাশি তদন্ত সংস্থা নেত্রকোনার গ্রেফতারকৃত দুই রাজাকার মুসলীম লীগ নেতা আতাউর রহমান ননি (৬২) ও নেজামে ইসলামের ওবায়দুল হক তাহেরের (৬৪) বিরুদ্ধে তদন্ত প্রতিবেদন চুড়ান্ত করেছে। আজ প্রতিবেদন প্রসিউিকশনে দাখিল করা হবে। অভিযোগ গঠনের মাধ্যমে বাগেরহাটের তিন রাজাকারের বিচার শুরু হলো। কসাই শেখ সিরাজুল হক ওরফে সিরাজ মাস্টার, আব্দুল লতিফ তালুকদার ও খান আকরাম হোসেনের বিরুদ্ধে হত্যা, গণহত্যা, অপহরণ আটক অগ্নিসংযোগসহ ৭ ধরনের অভিযোগ গঠন করে আদেশ দিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল। চেয়ারম্যান বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিমের নেতৃত্বে তিন সদস্যবিশিষ্ট আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল এ আদেশ প্রদান করেছেন। ট্রাইব্যুনালে অন্য দুই সদস্য ছিলেন বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন সেলিম ও বিচারপতি আনোয়ারুল হক। অভিযোগ গঠনের ওপর উভয় পক্ষের আইনজীবীদের শুনানি শেষে গত ২০ অক্টোবর আদেশের জন্য ৫ নবেম্বর দিন ধার্য করেছিলেন। আদালতে আসামি খান আকরাম ও লতিফ তালুকদারের পক্ষে শুনানি করেন ব্যারিস্টার মীর সরোয়ার হোসেন। অপরদিকে প্রসিকিউশন পক্ষে প্রসিকিউটর ব্যারিস্টার সাইয়েদুল হক সুমন উপস্থিত ছিলেন। আর সিরাজ মাস্টারের পক্ষে আইনজীবী ছিলেন আবুল হাসান। আসামি পক্ষের আইনজীবীরা মক্কেলদের নির্দোষ দাবি করে তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ থেকে অব্যাহতির আবেদন করেন। এর আগে গত ৩০ সেপ্টেম্বর এ মামলায় আসামি পক্ষের শুনানির জন্য সময় পিছিয়ে আজ দিন ধার্য করেছিলেন ট্রাইব্যুনাল। গত ১৫ সেপ্টেম্বর এ তিন আসামির বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ আমলে নেয় ট্রাইব্যুনাল-১। গত ১৪ সেপ্টেম্বর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের রেজিস্ট্রার অফিসে প্রসিকিউটর সায়্যেদুল হক সুমন ও শেখ মুশফিক কবির তিন আসামির বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগপত্র দাখিল করেন। মানবতাবিরোধী অপরাধে সিরাজ মাস্টারের বিরুদ্ধে ছয়টি এবং আব্দুল লতিফ ও খান আকরামের বিরুদ্ধে চারটি করে অভিযোগ আনা হয়েছে। তদন্ত চূড়ান্ত করে গত ২৫ আগস্ট এ তিনজনের বিরুদ্ধে তদন্ত প্রতিবেদন প্রসিকিউশন বরাবর দাখিল করে তদন্ত সংস্থা। এদের বিরুদ্ধে নয়টি খ-ে মোট ৮৪৪ পৃষ্ঠার ডকুমেন্ট তৈরি করা হয়েছে। এছাড়া এদের বিরুদ্ধে ৬৫ জন সাক্ষীর সাক্ষ্য লিপিবদ্ধ করা হয়েছে বলে জানায় তদন্ত সংস্থা। তাহের-ননী ॥ নেত্রকোনার গ্রেফতারকৃত দুই রাজাকার মুসলীম লীগ নেতা আতাউর রহমান ননি (৬২) ও নেজামে ইসলামের ওবায়দুল হক তাহেরের (৬৪) বিরুদ্ধে তদন্ত প্রতিবেদন চূড়ান্ত করেছে। আজ প্রতিবেদন প্রসিউিকশনে দাখিল করা হবে। তদন্ত সংস্থার প্রধান এম হান্নান খান ধানম-ির সেফ হোমে এক সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে এ কথা বলেছেন। এ সময় মামলার তদন্ত কর্মকর্তা মোঃ শাহজাহান কবীর উপস্থিত ছিলেন। মোঃ ওবায়দুল হক ওরফে তাহের, আতাউর রহমান ওরফে ননীর বিরুদ্ধে হত্যা, গণহত্যা, লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগ, অপহরণ, আটক ও নির্যাতনসহ মোট ৪টি অভিযোগ আনা হয়েছে। সংবাদ সম্মেলনে এম এম হান্নান খান বলেন, এই মামলার তদন্ত করতে সময় লেগেছে ১ বছর ৪ মাস ২৮ দিন। ২০১৩ সালের ৬ জুন থেকে আসামিদের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু হয়। আর শেষ হয় চলতি বছরের ৫ নবেম্বর। সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়েছে ৮০ জনের উর্ধে, তার মধ্যে ৩২ জনকে সাক্ষী হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে। আসামিদের বিরুদ্ধে ১৫ জন নিরীহ মানুষকে অপহরণের পর হত্যা, ৪০০-৪৫০টি বাড়ির মালামাল লুট ও আগ্নিসংযোগের অভিযোগ আনা হয়েছে। তদন্ত সংস্থা তাহের ও ননীর বিরুদ্ধে ৪ ধরনের অভিযোগ এনেছে। তার মধ্যে রয়েছেÑ (১) একাত্তরের ১৭ আগস্ট সকাল ১১টার দিকে আসামিদের নেতৃত্বে রাজাকারেরা নেত্রকোনা জেলার বারহাট্রা থানার বাউসী বাজার থেকে ফজলুর রহমান তালুকদারকে অপহরণ। এরপর নেত্রকোনা জেলা পরিষদ ডাকবাংলোয় নির্য়াতনের পর ত্রিমোহনী ব্রিজে হত্যা। হত্যাকা-ের পর বাউসী বাজারের ৪০০-৪৫০টি দোকানঘরে আগুন ধরিয়ে দেয়া। (২) ৪ অক্টোবর ১৯৭১, সকাল আনুমানিক সাড়ে ১২টার দিকে নেত্রকোনা শহরের বারহাট্রা রোডস্থ শ্রীশ্রী জিউর আখড়ার সমানের রাস্তা থেকে আসামিরা কৃতি ফুটবলার দাবির হোসেনকে অপরহরণ। এরপর নির্যাতন চালিয়ে মোক্তার পাড়া ব্রিজের নিয়ে গুলি করে হত্যা। (৩) ২৯ অক্টোবর ১৯৭১ বেলা অনুমান সাড়ে ১২টার দিকে আসামিরা বারহাট্রা থানার লাউফা গ্রামে মশরফ আলী তালুকদারসহ ১০ জনকে অপহরণ করে ঠাকুরাকোনা ব্রিজে ৭ জনকে নিয়ে গুলি করে হত্যা। (৪) ১৫ নবেম্বর ১৯৭১ সকাল ১১টার দিকে আসামিরা বিরামপুর বাজার থেকে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক বাদিউজ্জামান মুক্তসহ ৬ জনকে অপহরণ করে। এরপর লক্ষীগঞ্জ ও মোক্তারপাড়া ব্রিজ নিয়ে গুলি করে হত্যা করে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত করেছে। আব্দুল জব্বার ॥ একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে অভিযুক্ত পিরোজপুরের জাতীয় পার্টির সাবেক নেতা পলাতক ইঞ্জিনিয়ার আব্দুল জব্বারের বিরুদ্ধে প্রসিকিউশনের ১৮তম সাক্ষী দীপক কুমার বিশ্বাস জবানবন্দী প্রদান করেছেন। জবানবন্দী শেষে রাষ্ট্র কর্তৃক নিযুক্ত আইনজীবী সাক্ষীকে জেরা করেছেন। আজ নতুন সাক্ষীর জবানবন্দীর জন্য দিন নির্ধারণ করা হয়েছে। চেয়ারম্যান বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিমের নেতৃত্বে তিন সদস্যবিশিষ্ট আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এ আদেশ প্রদান করেছেন। সাক্ষীকে সাক্ষ্য প্রদানে সহায়তা করেন প্রসিকিউটর জাহিদ ইমাম। প্রসিকিউশনের সাক্ষী জবানবন্দীতে বলেন, জব্বারের নির্দেশে রাজাকাররা আমার দাদা নিশি কান্ত এবং আমার বাবা সুরেন্দ্র নাথ বিশ্বাসকে গুলি করে হত্যা করে। একইভাবে আসামির নির্দেশে আমাদের গ্রামের জিতেন্দ্র নাথ বিশ্বাস, গনেশ চন্দ্র মিস্ত্রি, নেপাল চন্দ্র মিস্ত্রি, উপেন্দ্র নাথ মিস্ত্রিসহ ১১ জনকে গুলি করে হত্যা করে। আমরা এ সময় গ্রামের পার্শ্ববর্তী খালের ওপারে আত্মরক্ষার জন্য আশ্রয় গ্রহণ করি। তিনি আরও বলেন, এরপর রাজাকার বাহিনী গ্রামে ঢুকে বিভিন্ন বাড়ি-ঘর লূটপাট করে অগ্নিসংযোগ করে। অন্যদিকে সাক্ষ্য প্রদানের পর সাক্ষীকে জেরা করেন রাষ্ট্র নিয়োগপ্রাপ্ত আইনজীবী আবুল হাসান। আব্দুস সুবহান ॥ একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে অভিযুক্ত জামায়াতের নায়েবে আমির আব্দুস সুবহানের বিরুদ্ধে প্রসিকিউশনের যুক্তিতর্ক শুরু হয়েছে। আজ আবারও আসামির বিরুদ্ধে যুক্তিতর্ক করার জন্য দিন নির্ধারণ করা হয়েছে। চেয়ারম্যান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান শাহীনের নেতৃত্বে তিন সদস্যবিশিষ্ট আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ এ আদেশ প্রদান করেছেন। ট্রাইব্যুনালে অন্য দুই সদস্য ছিলেন বিচারপতি মোঃ মুজিবুর রহমান মিয়া ও বিচারপতি মোঃ শাহিনুর ইসলাম। বুধবার আসামি আব্দুস সুবহানের বিরুদ্ধে যুক্তিতর্কে প্রারম্ভিক বক্তব্য রাখেন চীফ প্রসিকিউটর গোলাম আরিফ টিপু। এরপর আসামি সম্পর্কে ও অভিযোগ ভিত্তিক যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন প্রসিকিউটর সুলতান মাহমুদ সিমন ও প্রসিকিউটর রেজিয়া সুলতান চমন। আব্দুস সুবহানের বিরুদ্ধে প্রসিকিউশনের ৩১ জন সাক্ষী সাক্ষ্য প্রদান করেছেন। আর সাফাই সাক্ষীর জন্য তিনজন নির্ধারণ থাকলেও আসামি পক্ষ থেকে কোন সাফাই সাক্ষী হাজির করা হয়নি। প্রসিকিউশন ও আসামি পক্ষের যুক্তিতর্ক শেষ হওয়ার পর নিয়ম অনুসারে ট্রাইব্যুনার রায ঘোষণার জন্য অপেক্ষমাণ (সিএভি) রাখবেন। গত ৭ এপ্রিল থেকে ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সুবহানের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিয়েছেন দুই তদন্ত কর্মকর্তা মতিউর রহমান ও মোঃ নূর হোসাইনসহ প্রসিকিউশন পক্ষের ৩১ জন সাক্ষী। গত ২৭ মার্চ ট্রাইব্যুনাল-১ স্বপ্রণোদিত হয়ে এ মামলাটি ট্রাইব্যুনাল-২ এ স্থানান্তর করেন। গত বছরের ৩১ ডিসেম্বর গণহত্যা, হত্যা, অপহরণ, আটক, নির্যাতন, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ ও ষড়যন্ত্রসহ ৮ ধরনের নয়টি মানবতাবিরোধী অপরাধে সুবহানের বিরুদ্ধে অভিযোগ (চার্জ) গঠন করেন ট্রাইব্যুনাল। ২০১২ সালের ২০ সেপ্টেম্বর সকালে টাঙ্গাইলে বঙ্গবন্ধু সেতুর পূর্ব প্রান্ত থেকে সুবহানকে আটক করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
×