ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

সোহাগপুর বিধবা পল্লীতে আনন্দ মিছিল, শাপ মুক্তির পথে শেরপুর

প্রকাশিত: ০৪:৩৬, ৪ নভেম্বর ২০১৪

সোহাগপুর বিধবা পল্লীতে আনন্দ মিছিল, শাপ মুক্তির পথে শেরপুর

আলবদর হয়ে যে পাপ করেছিলাম, এই রায়ে সে কলঙ্ক মোচন হয়েছে ॥ রাজসাক্ষী মোহন মুন্সি রফিকুল ইসলাম আধার, শেরপুর, ৩ নবেম্বর ॥ সুপ্রীমকোর্টের চূড়ান্ত রায়ে জামায়াত নেতা কামারুজ্জামানের মৃত্যুদ- বহাল রাখায় তার নিজ জেলা শেরপুরে আনন্দ মিছিল করেছে একাত্তরে স্বজনহারা, মুক্তিযোদ্ধা, নির্যাতনে নিহতদের পরিবারের সদস্য ও সাক্ষীসহ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ শক্তির মানুষ। রায়ের খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে জেলা আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মানুষ জেলা শহরে বিশাল আনন্দ মিছিল বের করে। পরে থানা মোড়ে আওয়ামী লীগ নেতা ও সদর উপজেলার চেয়ারম্যান ছানুয়ার হোসেন ছানুর নেতৃত্বে জেলা যুবলীগ ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা সাধারণ মানুষকে মিষ্টি মুখ করান। বিকেলে মনিরুল ইসলাম লিটনের নেতৃত্বে জেলা জাসদের একটি পৃথক আনন্দ মিছিল শহর প্রদক্ষিণ করে। এছাড়া ওই রায় ঘোষণার পর থেকেই মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের লোকজনকে ছাপিয়ে সাধারণ মানুষের মাঝেও কলঙ্কমুক্তির ছাপে আনন্দের আভা ফুটে উঠে। কামারুজ্জামানের মামলায় চূড়ান্ত রায় ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে আনন্দাশ্রু বইতে শুরু করে সোহাগপুর শহীদ পরিবারের বিধবাদের চোখে। একাত্তরে শেরপুরের যেসব এলাকায় কামারুজ্জামানের নেতৃত্বে এবং তাঁর নির্দেশে জ্বালাও-পোড়াও, লুটতরাজ, গণহত্যাসহ বিভিন্ন অপকর্ম সংঘটিত হয়েছে ওইসব এলাকার স্বজনহারা ও ভুক্তভোগী এবং নৃশংস ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীরাও কামারুজ্জামানের রায়ে আনন্দ প্রকাশ করেছে। বিশেষ করে সদর উপজেলার কামারিয়া ইউনিয়নের সূর্যদী গ্রাম, শহরের শেরী ব্রিজ এলাকা এবং নয়ানী বাজারস্থ সুরেন্দ্র মোহন সাহার বাড়ি, ঝিনাইগাতী উপজেলার আহম্মদনগর ও জগৎপুর, নালিতাবাড়ী উপজেলার সোহাগপুর বিধবা পল্লীর ভুক্তভোগী, স্বজনহারা ও সাধারণ গ্রামবাসী কামারুজ্জামানের রায়ের কথা শুনে এলাকায় ঘুরে ঘুরে শুধু স্মৃতি হাতরিয়ে বেড়াচ্ছে আর বীভৎস সেসব দৃশ্যের কথা মনে করে দীর্ঘশ্বাস ফেলছে। বিভিন্ন মহলের প্রতিক্রিয়া ॥ একাত্তরের ঘাতক কামারুজ্জামানের ফাঁসির আদেশ বহাল থাকায় শেরপুর জেলা সেক্টর কমান্ডার্স ফোরামের সভাপতি মুক্তিযুদ্ধের যুব সংগঠক আমজাদ আলী এক প্রতিক্রিয়ায় বলেন, শহীদ মোস্তফাসহ সোহাগপুরের গণহত্যায় শহীদদের স্বজনরা দীর্ঘ ৪৩ বছর শেরপুরের ‘কুলাঙ্গার’ হিসেবে চিহ্নিত ঘাতক কামারুজ্জামানের শাস্তি দেখার অপেক্ষায় ছিলেন। এখন তাঁর সর্বোচ্চ শাস্তি ফাঁসির আদেশ বহাল থাকায় তাঁদের স্বজনদের প্রতীক্ষার অবসানসহ শেরপুরবাসী কলঙ্কমুক্ত হয়েছে। শেরপুর সদর উপজেলার চেয়ারম্যান ছানুয়ার হোসেন ছানু বলেন, কামারুজ্জামানের চূড়ান্ত রায়ের মধ্য দিয়ে শেরপুরবাসী আজ কলঙ্কমুক্ত। একই কথা জানিয়ে শেরপুর পৌরসভার মেয়র হুমায়ুন কবীর রুমান বলেন, এখন ওই রায় কার্যকর দেখতে চায় শহীদদের স্বজনরাসহ শেরপুরবাসী। শহীদ গোলাম মোস্তফার ভাই মোশারফ হোসেন তালুকদার মানিক জানান, তাঁরা ওই রায়ে সন্তুষ্ট। শহীদ গোলাম মোস্তফ হত্যার উপযুক্ত বিচার পেয়েছি। উচ্চ আদালতের রায়ে শেরপুর তথা দেশবাসী কলঙ্কমুক্ত হলো, মুক্তিযোদ্ধাদের আত্মা শান্তি পেল বলে মন্তব্য করেন মুক্তিযোদ্ধা তালাপতুফ হোসেন মঞ্জু। আত্মস্বীকৃত আলবদর সদস্য কামারুজ্জামানের নির্যাতন সেলের দারোয়ান ও রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষী মোহন মুন্সি বলেন, আলবদর হয়ে যে পাপ করেছিলাম এ রায়ের মধ্য দিয়ে আমার সে পাপ ও কলঙ্ক মোচন হয়েছে। আমি দেশবাসীর কাছে ক্ষমা চাই। রায়ে আমি খুব খুশি। রায়ে সন্তোষ জানিয়ে মামলার সাক্ষী মজিবর রহমান পানু বলেন, আমি তাড়াতাড়ি এই ফাঁসির রায় কার্যকর দেখতে চাই। এছাড়া ওই রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করে তা দ্রুত কার্যকরের দাবি জানিয়েছেন মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক মুহসীন আলী মাস্টার, জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি এ্যাডভোকেট একেএম মোছাদ্দেক ফেরদৌসী, মুক্তিযোদ্ধার সন্তান সংগঠনের সভাপতি, চেম্বার সভাপতি গোলাম মোহাম্মদ কিবরিয়া লিটন, বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ অধ্যক্ষ মুহাম্মদ আখতারুজ্জামান, জেলা আওয়ামী লীগের মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক সম্পাদক আলহাজ আব্দুল ওয়াদুদ অদু, জেলা জাসদ সভাপতি মনিরুল ইসলাম লিটন, উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা ইউনিট কমান্ডার এ্যাডভোকেট মোখলেসুর রহমান আকন্দ ও সোহাগপুর শহীদ পরিবার কল্যাণ সমিতির সভাপতি মোঃ জালাল উদ্দিন। সোহাগপুর বিধবা পল্লীতে আনন্দাশ্রু যুদ্ধাপরাধের মামলায় একাত্তরের ঘাতক কামারুজ্জামানের ফাঁসির রায় বহাল থাকায় শেষ চাওয়া-পাওয়ার তৃপ্তির উচ্ছ্বাসে ভাসছে সীমান্তবর্তী নালিতাবাড়ী উপজেলার সোহাগপুর বিধবা পল্লী। ’৭১-এর সেই নির্যাতন ও হত্যাকা-ের বিবরণ দিতে গিয়ে আবেগ আপ্লুত হয়ে এখানকার বয়সের ভারে ন্যুব্জ হওয়া বিধবা জরিতন বেওয়া ও দিলমনি রাকসাম সোমবার বিকেলে বলেন, ৪৩ বছর ধরে কাঁদতে কাঁদতে তাঁদের চোখের পানি শুকিয়ে গেছে। পাক বাহিনী ও আলবদর-রাজাকাদের সোহাগপুরে নৃশংসতা ও তাদের স্বামী সন্তানদের হত্যার নায়ক কামারুজ্জামানের ফাঁসির আদেশ বহাল হোকÑএমনটাই ছিল প্রাণের দাবি। এখন তা পূরণ হওয়ায় তাঁরা বেজায় খুশি। একই কথা জানান জরিতন বেওয়া, জবেদা বেওয়া, হাজেরা বেওয়া ও হাসিনা বেওয়াসহ বিধবা পল্লীর অন্য বিধবারা। ওইসময় স্বামী-সন্তানসহ পরিবারের সবাইকে হায়েনাদের গুলিতে হারানোর শিকার শহীদ খেজুর আলীর স্ত্রী জরিতন বেওয়া কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ‘মরবার আগে আমার স্বামী ও পুলারে যারা মারছে সেই তাগোরে ফাঁসি দেইখ্যা মরবার বড় আশা মনে আছিল। আইজ কামারুজ্জামানের ফাঁসির সাজার কতা হুইন্না বুহের ভিতর থাইক্কা একটা চাপা দেয়া পাত্তর হইরা (সরে) গেলো।’ তিনি বলেন, ‘আমার স্বামীরে ঘর থেইক্যা টাইন্যা লইয়্যা আইয়্যা উঠানে ফালাইয়্যা পরথমে ছয়ডা গুলি করে। গুলি খাইয়্যা পানি চাইলে আরেকটা গুলি করে। ওই গুলিতে উডানেই তার জীবন যায়। পরে আমার সোনা মানিক বুকের ধন হাশেমরে ধইর‌্যা নিয়্যা বাপের লাশের উফরে ফালাইয়্যা গুলি করে। এরপর আমার দেওররে ধইর‌্যা নিয়্যা বন্দুকের নল দিয়্যা কেচাইতে থাহে, পরে মুহের ভিতরে বন্দুক দিয়্যা গুলি করে। তহনি তার পরান বাইরইয়্যা যায়।’ শহীদ ফজর আলীর স্ত্রী জবেদা বেওয়া বলেন, ‘যারা আংগর বেডাইনরে (পুরুষ মানুষ) মারছে, ওগর নেতা কামারুজ্জামানের ফাঁসির সাজা বহাল অইছে, হুইন্না আংগর কইলজাডা অহন এহেবারেই জুড়াইল।’ তবে শহীদ ছফির উদ্দিনের ২ ছেলে জালাল উদ্দিন ও আলাল উদ্দিন বলেন, ‘কামারুজ্জামানের ফাঁসি বহালের রায়ে আমরা বিধবাপল্লীর শহীদ পরিবারের স্বজনরাসহ সবাই প্রচ- খুশি। তবে আমরা এহন কিছুডা ডরের (আতঙ্কের) মধ্যে আছি। কারণ আমাদের নানাভাবে শায়েস্তা করা হবে, ক্ষমতা পরিবর্তন হলে দেখে নেয়া হবে বলে কামারুজ্জামানের পক্ষের লোকেরা নানাভাবে হুমকি ছড়িয়ে আসছে।’
×