ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

সেকেন্ড হোমে টাকা পাচারকারীদের ধরতে মাঠে এনবিআর ও দুদক

প্রকাশিত: ০৪:১৭, ২ নভেম্বর ২০১৪

সেকেন্ড হোমে টাকা পাচারকারীদের ধরতে মাঠে এনবিআর ও দুদক

অর্থনৈতিক রিপোর্টার ॥ ‘সেকেন্ড হোম বা দ্বিতীয় আবাস’ গড়ার নামে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে পাচার হচ্ছে হাজার হাজার কোটি টাকা। সেই পাচার করা অর্থ ও পাচারকারীদের ধরতে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) পর এবার মাঠে নেমেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। আর অভিযোগের তীর দেশের রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী ও আমলাসহ চিহ্নিত একটি দুর্নীতিবাজ চক্রের দিকে। যাঁরা গত পাঁচ বছরে অন্তত চার হাজার ৯৮৬ কোটি টাকার সমপরিমাণ মার্কিন ডলার বিদেশে পাচার করেছেন। ওই অভিযোগ আমলে নিয়ে চলিত বছরে অনুসন্ধান শুরু করে দুদক। এজন্য কাজ করছেন দুদকের উপ-পরিচালক মোহাম্মদ মোরশেদ আলমের নেতৃত্বে তিন সদস্যের একটি বিশেষ টিম। ইতোমধ্যে তাঁরা বাংলাদেশ ব্যাংক ও এনবিআরসহ বিভিন্ন মানি চেঞ্জারের কাছ থেকে নথিপত্র সংগ্রহ করেন। নথিপত্র সংগ্রহ করা হচ্ছে গোয়েন্দাদের কাছ থেকেও। এ বিষয়ে দুদক চেয়ারম্যান মোঃ বদিউজ্জামান জানিয়েছেন, সেকেন্ড হোম প্রজেক্টটি বর্তমানে মালয়েশিয়ায় চালু রয়েছে। বাংলাদেশ থেকে ওই প্রকল্পে অনেক বিত্তশালী বাড়ি বানিয়েছেন বা আবেদন করেছেন এমন অভিযোগের অনুসন্ধান চলছে। এদিকে এনবিআর সূত্রে জানা যায়, দেশের টাকা পাচার কিংবা বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমতি ছাড়া বিদেশে সেকেন্ড হোম নির্মাণ করছেন এমন বাংলাদেশের নাগরিকের বিরুদ্ধে এনবিআরও অভিযানে নামছে। এনবিআরের দাবি এ জাতীয় ব্যক্তিরা কোন কর প্রদান করেন না। অথচ তাঁদের কাছ থেকে কর আদায় করতে পারলে হাজার হাজার কোটি টাকার রাজস্ব আহরণ সম্ভব হতো। তাই দেশের টাকায় বিদেশে সেকেন্ড হোম নির্মাণকারীদের বিরুদ্ধেও কাজ শুরু করেছে প্রতিষ্ঠানটি। এ বিষয়ে এনবিআর কর্মকর্তারা বলেন, দেশের টাকায় বিদেশে সেকেন্ড হোম নির্মাণকারীদের বিরুদ্ধে খুব শিগগিরই অভিযানে নামা হবে। বিদেশে টাকা পাচার ও কর ফাঁকির বিষয় দেখতে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোতে যোগাযোগ করা হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, প্রাথমিকভাবে মালয়েশিয়া, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কানাডা ও কাতারের দূতাবাসের মাধ্যমে সেসব দেশে সেকেন্ড হোম নির্মাণকারীদের তথ্য চাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। বিভিন্ন সূত্রে এ বিষয়ে আরও জানা যায়, রাজনৈতিক অস্থিরতায় নিরাপদ আশ্রয় খোঁজার উদ্দেশ্য নিয়েই এ ধরনের তৎপরতা শুরু হয়। আর এই নেপথ্যের মূল কারণ হলো কালো টাকা বিদেশে পাচার করা। সেকেন্ড হোম প্রকল্পের ব্যানারে দেশ থেকে মোটা অঙ্কের অর্থ নিয়ে বিদেশে পাড়ি জমানোর ওই তালিকার শীর্ষে রয়েছেন রাজনীতিবিদরা। সুবিধাভোগী শিল্পপতি, ব্যবসায়ী ও আমলারা দ্বিতীয় নম্বরে রয়েছেন। এদিকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন সূত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী বর্তমান সরকারের প্রথম মেয়াদের শেষদিকে বিদেশে পাড়ি জমানোর জন্য সেকেন্ড হোম প্রকল্পে নতুন করে আবেদন করেছিলেন ৬৪৮ জন বিশিষ্ট ব্যক্তি। যার মধ্যে রয়েছেন আওয়ামী লীগের ২৮৭ জন, বিএনপি-জামায়াতের ৯৬ জন এবং বাকি ২৬৫ জন সুবিধাভোগী শিল্পপতি, ব্যবসায়ী ও আমলা। আর এদের পছন্দের তালিকায় সবার ওপরে মালয়েশিয়া। এরপরেই রয়েছে কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড ও সিঙ্গাপুরসহ মধ্যপ্রাচ্যের বেশ কয়েকটি দেশ। এ দেশগুলো বাংলাদেশ থেকে ‘বিনিয়োগকারী’, ‘উদ্যোক্তা’ ও ‘স্বকর্মসংস্থান’ কোটায় সহজেই ভিসা দিচ্ছে। দুদক সূত্রে জানা যায়, অর্থ পাচারের সবচেয়ে প্রচলিত পন্থা হলো মানি চেঞ্জার। ঢাকায় টাকা ডলারে রূপান্তরিত করার পর একই মানি চেঞ্জারের একটি নির্দিষ্ট শাখা থেকে ডলারের পরিবর্তে ওই দেশীয় মুদ্রায় রূপান্তর করা হয়। কোন আইনী পদ্ধতিতে এ ধরনের লেনদেনের সুযোগ নেই, যা হচ্ছে সব বেআইনী। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে অর্থ পাচার নিয়ে গবেষণা করে থাকে গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটি বা জিএফআই। তাদের প্রকাশিত এক গবেষণা রিপোর্ট থেকে জানা যায়, ২০০২ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত এক দশকে বাংলাদেশ থেকে অন্তত এক হাজার ৬০৭ কোটি ৭০ লাখ ডলার বা এক লাখ ২৮ হাজার ৬১৬ কোটি টাকা অবৈধভাবে বাইরে চলে গেছে। বিশ্বের যে ১৫০টি উন্নয়নশীল দেশ থেকে অবৈধভাবে অর্থ স্থানান্তর হয়েছে, যেখানে বাংলাদেশের অবস্থান দাঁড়িয়েছে ৪৭তম। আর দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশের অবস্থান দ্বিতীয়। এতে দেখা যায়, আলোচ্য সময়ে গড়ে প্রতিবছর ১৬০ কোটি ৮০ লাখ ডলার বা ১২ হাজার ৮৬৪ কোটি টাকা অবৈধ পথে বাংলাদেশের বাইরে স্থানান্তর করা হয়েছে। অস্বচ্ছ ব্যবসায়িক লেনদেন, দুর্নীতি ও কর ফাঁকির মাধ্যমে এ অর্থ স্থানান্তর করা হয়েছে বলেও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছিল।
×