ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

১১ উইকেটের পতন, খালেদা খেলবেন কাদের নিয়ে!

প্রকাশিত: ০৪:৫১, ৩০ অক্টোবর ২০১৪

১১ উইকেটের পতন, খালেদা খেলবেন কাদের নিয়ে!

মোয়াজ্জেমুল হক, চট্টগ্রাম অফিস ॥ একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে অভিযুক্ত হয়ে এ পর্যন্ত ১০ মামলায় ১১ অপরাধীর মৃত্যুদ- ও আমৃত্যু কারাদ-াদেশ হয়েছে। এর মধ্যে একজনের ফাঁসি কার্যকর হয়েছে। আমৃত্যু কারাদ-ে দ-িত দুজন জেলের অভ্যন্তরে মৃত্যুবরণ করেছে। বাকি ৮ জন দ-াদেশের বিরুদ্ধে যে আপীল করেছেন তার রায়ের অপেক্ষার প্রহর গুনছেন। দ-িত সকলেই বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় শরীক জোটের প্রভাবশালী নেতা ছিলেন। এদের নিয়েই বিএনপির নেত্রী খালেদা জিয়া অতীতে সরকার চালিয়েছেন। মানবতাবিরোধী অপরাধের ভয়ঙ্কর অপরাধী দুজন আলবদর প্রধান মতিউর রহমান নিজামী ও আলী আহসান মুজাহিদকে মন্ত্রী পদে বসিয়ে জাতীয় পতাকার অবমাননা করেছিলেন। আলী আহসান মুজাহিদের ফাঁসির আদেশ আগেই হয়েছে। সর্বশেষ ফাঁসির দ- পেলেন নিজামী। তার হয়েছে ডাবল ফাঁসি। চট্টগ্রামে আটক দশ ট্রাক অস্ত্র মামলার রায়ে চলতি বছরের ২৪ জানুয়ারি জামায়াতের আমির নিজামীসহ ১৪ জনের ফাঁসির আদেশ হয়েছে। এ মামলায় বেগম জিয়ার আরেক সিপাহশালার সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরও ফাঁসির আদেশে দ-িত। বুধবার নিজামীকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ আদালত ফাঁসির আদেশে দ-িত করার পর হিসাব মেলাতে গিয়ে দেখা যায়, বিএনপি নেত্রীর একান্ত সহযোগী নিজ দল ও জামায়াতের অভিযুক্তদের মধ্যে ১১ জনের বিচারকার্য সম্পন্ন হয়েছে। ১১ জনই মৃত্যুদ- ও আমৃত্যু কারাদ-ে দ-িত হয়েছেন। এ যেন রাজনীতির খেলার মাঠের ১১ উইকেটের পতন ঘটল। ফলে জনমনে গুঞ্জন চলছে বিএনপি নেত্রী আন্দোলন আন্দোলন খেলার যে ডাক দিয়ে চলেছেনÑ তাতে খেলবেন কাদের নিয়ে? মূলত যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করার প্রস্তুতির শুরুতেই বিএনপিসহ আওয়ামী লীগবিরোধী বিভিন্ন মহল নানা বক্তব্য দিয়ে জাতিকে বিভ্রান্ত করার অপচেষ্টা চালিয়েছে। কিন্তু তা কোনভাবেই সফল হয়নি। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠন করে সরকার মাঠপর্যায়ে অভিযোগের শুনানি চালিয়ে মানবতাবিরোধীদের চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে। পরে শুরু হয় বিচার কার্যক্রম। বিচার কাজেও ঘটেছে ব্যতিক্রমী বেশকিছু ঘটনা। যা বিব্রত করেছে বিচারালয়কে। যে গতিতে বিচার কাজ শুরু হয়েছিল তাতে কিছুটা শ্লথগতিরও সৃষ্টি হয়েছিল। ফলে উৎস্যুক মহলে অজানা নানা প্রশ্নের জন্মও দিয়েছিল। মাওলানা দেওয়ার হোসেন সাঈদী ওরফে দেল্লা রাজাকারের ফাঁসির আদেশ হওয়ার পর উচ্চ আদালতে ফাঁসির বদলে আমৃত্যু কারাদ-ের আদেশের পর নানা গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়ে দেশজুড়ে। এর আগে মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীর চূড়ান্ত রায় ঘোষণাও থমকে গিয়েছিল। অবশেষে সব জল্পনাকল্পনার অবসান ঘটিয়ে বুধবার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ নিজামীর বিরুদ্ধে আনীত ১৬ অভিযোগের মধ্যে ৮টির সুনির্দিষ্ট প্রমাণে সন্তুষ্ট হয়ে তাকে মৃত্যুদ-ে দ-িত করেছে। দুপুরের আগেই আদেশ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সারাদেশেই যেন আনন্দের জোয়ার বয়ে এসেছে। বিশেষ করে স্বাধীনতার স্বপক্ষের শক্তি নতুন উদ্দীপনায় মেতে উঠেছে। আশান্বিত হয়েছে অবশিষ্ট অভিযুক্তদেরও শেষ রক্ষা হবে না। পাশাপাশি সরকারী ঘোষণা অনুযায়ী মানবতাবিরোধী অপরাধ ট্রাইব্যুনালের কর্মকা- চলমান থাকার প্রেক্ষাপটে এ জাতীয় অপরাধীদের বিচার কাজও অব্যাহত থাকবে। জাতীয় রাজনীতিতে বিএনপির দক্ষিণ হস্ত হিসেবে জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ ইতোমধ্যে পরিচিতি লাভ করেছে। সেই জামায়াতের শীর্ষ নেতারা একে একে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে দ-িত হচ্ছে। ইতোমধ্যেই এ দলের নেতা কাদের মোল্লা ফাঁসি কাষ্ঠে ঝুলেছেন। সাবেক আমির গোলাম আযম ও বিএনপি নেতা আবদুল আলীম আমৃত্যু কারাদ-ে দ-িত হয়ে ইতোমধ্যে জেল অভ্যন্তরে বয়সের ভারে প্রাণ হারিয়েছেন। বিএনপির আরেক নেতা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী দেশবিরোধী আরেক পরিচিতি সাকা হিসেবে তিনিও ফাঁসির দ-ে দ-িত হয়েছেন। এছাড়া জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মোহাম্মদ কামারুজ্জামান, আলবদর বাহিনীর দুই শীর্ষ নেতা চৌধুরী মঈনুদ্দীন ও আশরাফুজ্জামান খান, জামায়াতের সাবেক রোকন আবুল কালাম আজাদ ওরফে বাচ্চু রাজাকার (৩ জনই বিচার শুরু হওয়ার আগেই পলাতক) ফাঁসির দ-ে দ-িত হয়েছেন। সর্বশেষ বুধবার নিজামীর বিচার কাজ শেষে রায়ের বিষয়টি দীর্ঘসময় ঝুলে থাকার পর তার অবসান ঘটেছে। তারও শেষ রক্ষা হলো না। ফাঁসির দড়ি এখন তার জন্য অপেক্ষমান। তার পক্ষে বুধবারই আপীল করার কথা জানানো হয়েছে। এখন শুধু অপেক্ষার পালা। বুধবার বিচারের রায় ঘোষিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই দেশজুড়ে যেন স্বস্তি নেমে এসেছে। বিএনপি টু-শব্দ করেনি। মাজাভাঙ্গা জামায়াত দেশের কয়েকটি স্থানে বিক্ষিপ্তভাবে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির অপপ্রয়াস চালাবার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছে। কারণ, দেশজুড়েই ছিল নিরাপত্তার চাদরে ঢাকা। বন্দরনগরী চট্টগ্রামেও ব্যাপক নিরাপত্তা বলবৎ ছিল। রায় ঘোষণার পর স্বল্পসংখ্যক কর্মী সমর্থক নিয়ে জামায়াত শিবির দুটি স্থানে আচমকা একটি মিছিল করে গা ঢাকা দেয়। দেশের অন্যান্য স্থানের মতো চট্টগ্রামজুড়েও বুধবার ছিল নিজামীর মৃত্যুদ-াদেশ নিয়ে সরস আলোচনা। চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় উৎস্যুক মানুষের মুখে ছিল একটি মাত্র উক্তি। যার সারমর্ম হচ্ছে পাপ বাপকেও ছাড়ে না। মানবতার বিরুদ্ধে ভয়ঙ্কর অপরাধে অভিযুক্তদের গডফাদাররা যখন একে একে আমৃত্যু জেল ও ফাঁসির আদেশে দ-িত হচ্ছে তারপরও বিএনপি এদের দলকে ছাড়তে নারাজ। আবার এরা যখন বিচারের রায়ে জেল ও মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতে যাচ্ছে তখন বিএনপি নেত্রী ও তার দল তাদের নিয়ে সমবেদনা জানাতেও নারাজ। বিএনপির এ বৈপরীত্য ভূমিকায় জামায়াত শিবির বহু আগে থেকেই চরম নাখোশ। যে কারণে জামায়াত শিবিরের ক্যাডারবাহিনী বর্তমান সময়ে বিএনপিকে আর ভাল চোখে দেখছে না। আর এ দেখছে না বলেই বিএনপি একের পর এক আন্দোলন ডেকে মাঠ গরম করতে বার বার ব্যর্থ হচ্ছে। এক সময়ে চট্টগ্রামকে জামায়াতের ঘাঁটি বলা হতো। সেই দুর্ভেদ্য ঘাঁটি তছনছ হয়ে গেছে। জামায়াত শিবির অনেকটা ‘চাচা আপন জান বাঁচা’Ñ ভূমিকায় রয়েছে। অতীতে বিএনপিকে সমর্থন দিয়ে জামায়াত নিজেদের উন্নতি করানোর স্বপ্নে বিভোর ছিল। বিএনপি ক্ষমতা হারানোর পর সবই গুড়েবালি। দেশের বেশিরভাগ সাধারণ মানুষ জামায়াত-শিবিরের অপরাজনীতি পছন্দ করে না। পাশাপাশি জামায়াতের অতীত ভূমিকা অর্থাৎ মুক্তিযুদ্ধে বিরোধিতা এবং পাকিস্তানী বাহিনীর দোসর হয়ে রাজাকার, আলবদর, আল শামসবাহিনী গঠন করে নিজ দেশের মানুষের উপর নির্বিচার, অত্যাচার ও গণহত্যা চালানোর বিষয়টি বিলম্বে হলেও বিচারের কাঠগড়ায় এসেছে। পরিষ্কার হয়েছে এদের অতীত কার্যক্রম। ফলে অতীতে জামায়াত শিবির সমর্থনকারীদের অনেকে নিজেদের তাদের কাছ থেকে সরিয়ে নিয়েছে। বিশেষ করে নতুন প্রজন্মের বিশাল অংশ জামায়াত শিবিরকে খুনী ও রগ কাটার দল হিসেবে বিবেচনা করে থাকে। ফলে এ দলের প্রতি নতুন করে সমর্থন আর বাড়ছে না। বরঞ্চ যা ছিল তাও হ্রাস পেয়েছে। বর্তমানে মানবতাবিরোধী অপরাধ ট্রাইব্যুনালে এদের আমৃত্যু জেল ও মৃত্যুদ- স্পষ্ট করে দিচ্ছে আসলে এরা কারা। এদের নিয়ে বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া সরকার গঠন করে কলঙ্কের অধ্যায় রচনা করেছে বলেই মানুষের অনুভূতিতে বড় ধরনের ধাক্কা দিচ্ছে। তাদের দ্বারা জাতীয় পতাকাকে কলঙ্কিত করা হয়েছে বলেও নিদ্ধিধায় সরব আলোচনা চলছে। সঙ্গত কারণে বলা হচ্ছে, রাজনীতিতে বেগম জিয়ার যাদের নিয়ে এতদিন খেলে আসছিলেন এবং আগামীতেও খেলার স্বপ্ন দেখছিলেন তাতে একে একে যেভাবে অভিযুক্তরা ধরা খাচ্ছে তা ক্রিকেট খেলায় ক্রমাগতভাবে উইকেট হারানোর মতো অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। উইকেটই যদি না থাকে তাহলে সে খেলা আর চলে না। আম্পায়ার হাতের ইশারায় সমাপ্তি ঘটে খেলার। বাচ্চু রাজাকার থেকে সর্বশেষ নিজামী পর্যন্ত বিচারের রায়ে ফেঁসে যাওয়ার পর আলোচিত হচ্ছে এ যেন জোটনেত্রীর এগোর উইকেটেরই পতন ঘটেছে। এক্সটা হিসেবে বিএনপি নেতা সাবেক দাপুটে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরও ফাঁসির আদেশ নিয়ে জেল অভ্যন্তরে আপীল রায়ের অপেক্ষার প্রহর গুনছেন। দেশের রাজনীতিতে বিএনপির অবস্থা এমনিতেই ব্যাপক নড়বড়ে বলেই প্রতীয়মান। তার উপরে মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত তার প্রতি আপনদের জন্য যে বার্তা আদালতের রায়ে আসছে তাতে তার নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের রীতিমত হার্ট এ্যাটাকে আক্রান্ত হওয়ার অবস্থাই ডেকে এনেছে বলে রাজনৈতিক অঙ্গনে গুঞ্জন শুরু হয়েছে।
×