ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

বন নিধন বিপর্যস্ত পরিবেশ ও প্রকৃতি

প্রকাশিত: ০৪:৩৮, ২৬ অক্টোবর ২০১৪

বন নিধন  বিপর্যস্ত পরিবেশ ও প্রকৃতি

মেজবাহ উদ্দিন তুহিন বাংলাদেশের বনভূমি উজাড়ের ফলে জীববৈচিত্র্য ও পরিবেশ আজ ভারসাম্যহীন। বন ধ্বংস হওয়ায় দাবদাহ বেড়ে যাওয়ায় দুর্বিষহ হয়ে পড়েছে জনজীবন। দিনে দিনে গাছপালা হ্রাস পাওয়ায় বৃষ্টির পানি সরাসরি মাটিতে পড়ে ভূমির ক্ষয় ঘটছে। অথচ এ পানি গাছপালা চুইয়ে মাটির নিচের স্তরে জমা হলে শিকড়ের মাধ্যমে নানাস্তরে সঞ্চিত হয়। গাছের লতাপাতায় পানি জমে পচে তৈরি হয় জৈব সার। গাছ বাতাসের আর্দ্রতা ধরে রেখে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে, সুষম বৃষ্টিপাতে সহায়তা করে। ঝড়ঝঞ্ঝা ও বন্যা নিয়ন্ত্রণ করে। বিশ্বব্যাপী অবিরাম বন উজাড়ের ফলে প্রতিবছর ২.৪ মিলিয়ন টন কার্বন-ডাই অক্সাইড বাতাসে ছড়িয়ে পরিবেশ দূষিত করছে। বৃদ্ধি পাচ্ছে তাপমাত্রা। বিশ্বব্যাপী বন উজাড়ের ফলে প্রায় ৫০ প্রজাতির প্রাণী বিলুপ্তির পথে। উত্তরবঙ্গের অধিকাংশ এলাকা মরুতে পরিণত হতে যাচ্ছে। বাংলাদেশের উজানের ফারাক্কার প্রভাবও পড়ে এখানে। পানি প্রবাহ না থাকায় শুষ্ক মৌসুমে প্রচ- খরা এবং বর্ষা মৌসুমে অতিরিক্ত পানি প্রবাহের ফলে মহাপ্লাবনের সৃষ্টি হয়। এসব অঞ্চলে জলবায়ু ক্রমেই মরুময়তার দিকে যাচ্ছে। জীববৈচিত্র্যের বিনাশসহ নানা পরিবেশগত সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে। এক সময় সেচের জন্য ২৫% পানির চাহিদা মিটত নদী-নালা, খাল-বিল থেকে কিন্তু বর্তমানে তা পাওয়া যাচ্ছে না। উপকূলীয় অঞ্চল প্রতিবছর সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাসের কবলে পড়ছে। বন্যা, জলোচ্ছ্বাস, খরা, অধিক বৃষ্টিতে আক্রান্ত হচ্ছে দেশ।বন বিভাগের সূত্র মতে, দেশে ১০.৩ শতাংশ বা ১.৫২ মিলিয়ন হেক্টর ভূমিতে বন থাকলেও ওয়ার্ল্ড রিসোর্স ইনস্টিটিউটের হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশের মোট ভূখ-ের মাত্র পাঁচ শতাংশ বনভূমি রয়েছে। ১৯৫৫-৫৬ সাল পর্যন্ত বৃহত্তর ময়মনসিংহ, ঢাকা, রংপুর ও দিনাজপুরে গহীন শাল অরণ্য ছিল। প্রাকৃতিকভাবে শালগাছের ফল মাটিতে পড়ে বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মাসে চারা গজাত। স্থানীয় লোকজন নিজেদের স্বার্থেই প্রাকৃতিকভাবে গজানো এসব চারা যাতে নষ্ট না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতেন। ১৯৫৩ সালে ছোট ছোট এই শালবন বৃহৎ সরকারী বনে পরিণত হয়। ফলে এগুলো ফরেস্ট রেঞ্জের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। এরপর থেকেই কতিপয় অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীর সহযোগিতায় বন ধ্বংস হতে থাকে। তারা বন বিক্রি করে গড়তে থাকে নিজেদের অঢেল সহায় সম্পদ। টাঙ্গাইলের মধুপুর গড়ে এক সময় বাঘ বাস করলেও সেখানে বানর ও পাখি ছাড়া অন্য কোন বন্যপ্রাণী দেখা যায় না। হারিয়ে গেছে ঔষধি গাছ। আমাদের রয়েছে পৃথিবীর বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল সুন্দরবন। সুন্দরবন বাংলাদেশের বৃহত্তম ও বিশ্বের অন্যতম বনভূমি। এর মোট আয়তন ৫৬৬৮.৪৫ বর্গকিলোমিটার। এর বেশিরভাগই (৯৯%) খুলনা অঞ্চলে অর্থাৎ খুলনা, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরায় অবস্থিত। অতি সামান্য অংশ (১%) পটুয়াখালী, পিরোজপুর ও বরগুনা জেলায় অবস্থিত। মোট আয়তনের ৩৫ ভাগ পানি এবং ৬৫ ভাগ ভূমি। অসংখ্য ছোট-বড় চারণভূমির ওপর অরণ্য গড়ে উঠেছে। এই বনে প্রায় সাড়ে চারশত ছোট-বড় নদী ১ লাখ ৭৫ হাজার ৬৮৫ হেক্টর এলাকা নিয়ে বয়ে চলেছে।এখানকার পানিতে ১২০ ধরনের মাছ রয়েছে। বনে পাওয়া যায় ৩২৫ প্রজাতির বৃক্ষলতা। সুন্দরী, গেওরা, ধুন্দুল, গোলপাতা, ওড়া, পশুর আমুর, বাইন, ব্যাঁতাল, ফিসচুলা প্রভৃতি বনের প্রধান বৃক্ষ। বনের গাছগুলো ৩০ থেকে ৬০ ফুট পর্যন্ত লম্বা তবে সুন্দরী বৃক্ষ ২০ মিটার পর্যন্ত লম্বা হয়। এ বনে প্রতিদিন ফুল ফোটে আপন নিয়মে ঝরে পড়ে। এখানে রয়েছে বনজ সম্পদের ভা-ার। জীববৈচিত্র্যে অনন্য এই বনাঞ্চল। ১৭৬৫ সালে সুন্দরবনের জঙ্গল কাটা শুরু হয়। ১৮৮৫ সাল থেকে ১৯৫১ সাল পর্যন্ত সুন্দরবনের পুরোটাই সংরক্ষিত বন হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।এই গহীন অরণ্য নিবিড়, কণ্টকাকীর্ণ, হিংস্র, শ্বাপদসঙ্কুল ও কর্দমাক্ত বলে জনসাধারণের জন্য একসময় ভীতিকর থাকলেও মানুষের অবাধ বিচরণ এবং একশ্রেণীর বন কর্মকতা-কর্মচারীদের অর্থলিপ্সার কারণে এই বনও এখন ধ্বংসের মুখে। প্রতিদিন বিচরণ ঘটে মৌয়ালী, বাওয়ালীদের। সংগ্রহ করে ঝিনুক, শামুক, মধু ও বনজ ঔষধসহ নানা মূল্যবান সম্পদ। অপরাধী জলদুস্য, ডাকাত ও সন্ত্রাসীদের অবাধ বিচরণস্থলও এই সুন্দরবন। প্রকৃতির অপরূপ দান এই সুন্দরবন নানাভাবেই ধ্বংস হতে যাচ্ছে। হারাচ্ছে স্বর্ণোজ্জ্বল ঐতিহ্য। সামাজিক বনায়নের নামে টাকা খরচ করে বৃক্ষরোপণ করা হলেও অসাধু ব্যক্তিদের জোর-জুলুমের কারণে সরকারের সদিচ্ছা ব্যাহত হচ্ছে। কোন দেশের প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষার জন্য প্রয়োজন ৩৩ শতাংশ বনভূমি। কিন্তু সে দিক দিয়ে আমাদের অবস্থা নাজুক। বন কমে যাওয়ায় আমরা বন্যা ও খরার মোকাবেলা করছি সমানভাবে। পরিবেশ ও অর্থনীতির স্বার্থ রক্ষায় আমাদের সকলের এগিয়ে আসা উচিত। লেখক : গবেষক, উপ-আঞ্চলিক পরিচালক, বাউবি
×