
মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর
দিন যত যাচ্ছে পরিস্থিতি তত জটিল হচ্ছে বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। শনিবার দুপুরে জাতীয় প্রেস ক্লাবে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তি উপলক্ষে গণতন্ত্র মঞ্চ আয়োজিত ‘গণঅভ্যুত্থানের প্রত্যাশা ও দেশে গণতান্ত্রিক উত্তরণের পথ’ শীর্ষক আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এ মন্তব্য করেন।
ফখরুল বলেন, আমার কাছে যেটা মনে হয়, যারা গণতন্ত্র বিশ্বাস করে না, যারা জনগণের অগ্রযাত্রা বিশ্বাস করে না, যারা একটা শোষণহীন সমাজ গড়ে ওঠার যে রাজনীতি, সেই রাজনীতি বিশ্বাস করে না, তারা আবার জোট পাকাচ্ছে। আমার কাছে মনে হয়েছে যে, ফ্যাসিস্ট যাকে আমরা বিতাড়িত করতে সক্ষম হয়েছিলাম, তারা ভেতরে ভেতরে আবার সংগঠিত হচ্ছে এবং ক্ষমতা ফিরে পাওয়ার চক্রান্তে লিপ্ত হয়েছে। সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে।
ফখরুল বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি আহ্বান জানাতে চাই, আপনরা দয়া করে বিলম্ব না করে যত দ্রুত সম্ভব জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ব্যবস্থা করুন। নির্বাচন দিতে যত দেরি করছেন, ততই কিন্তু পরিস্থিতি আরও ঘোলাটে হচ্ছে। গণঅভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে যারা ছিল, বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যারা রয়েছে, গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে যারা রয়েছে, তারা আবার সংগঠিত হয়ে সেই গণতন্ত্রকে নস্যাৎ করার জন্য কাজ শুরু করেছে। তাই আর দেরি না করে যত দ্রুত সংস্কার, সনদ এবং নির্বাচন এই তিনটি বিষয়কে যত দ্রুত এগিয়ে যায়, ততই দেশের জন্য মঙ্গল হবে। দায়িত্বটা নিসন্দেহে এই অন্তর্বর্তী সরকারের।
আমরা খুব আশাবাদী যে, আমাদের সরকারের যিনি নেতা, তিনি এদেশের একজন বরেণ্য ব্যক্তিত্ব, তিনি আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত একজন ব্যক্তি, যিনি তার বুদ্ধিমত্তা, প্রজ্ঞা, সততা এবং দেশপ্রেম দিয়ে গোটা জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে আমাদের সেই লক্ষ্যে পৌঁছে দিতে সক্ষম হবেন।
মির্জা ফখরুল বলেন, হাসিনা পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছেন, তাই আমরা একটা সুযোগ পেয়েছি নতুন করে বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে প্রতিষ্ঠিত করার। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমরা দেখছি, যত দিন যাচ্ছে পরিস্থিতি যেন তত জটিল হয়ে উঠছে।
বিএনপি মহাসচিব বলেন, একটা কথা আমি মনে করিয়ে দিচ্ছি, ১৯৭১ হচ্ছে আমাদের মূল কথা, স্বাধীনতা যুদ্ধ আমাদের মূল কথা। এখানে আমাদের কোনো কমপ্রোমাইজ নাই।
আমাদের কোনো কমপ্রোমাইজ নাই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায়, আমরা অবশ্যই গণতন্ত্রে বিশ্বাস করি এবং গণতন্ত্র আমরা চাই। বাকি সব আলোচনার মাধ্যমে ঠিক করব আমরা। গণতন্ত্রের মূল বিষয় হচ্ছে আলোচনা, সহনশীলতা, অন্যের মতকে মেনে নেওয়া। সব নিয়ে আমরা অবশ্যই এমন একটা জায়গায় পৌঁছাতে পারব, যেখান থেকে আমরা আবার নতুন করে একটা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় ফিরে যেতে পারব।
ফখরুল বলেন, সংস্কার তো আমরাই দিয়েছি। আলোচনার মধ্য দিয়ে তা শেষ হতে পারে। সরকারকে আহ্বান করব, অযথা বিলম্ব না করে সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে কথা বলুন। কথা বলে সেই সমস্যা শেষ করে নির্বাচনের দিকে এগিয়ে যান, সেটাই বোধহয় একমাত্র পথ।
ফখরুল বলেন, আমরা হঠাৎ লক্ষ্য করছি যে, মবোক্রেসি, হত্যা, ছিনতাই, গুম ভয়ানকভাবে বেড়ে যাচ্ছে। বিষয়গুলো বিশেষ করে সচেতন নাগরিক এবং রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে আমাদের অত্যন্ত উদ্বিগ্ন করে তুলছে। আমি পার্টিকুলারলি কোনো রাজনৈতিক দল বা ব্যক্তির প্রতি কোনো কথা বলতে চাই না এবং বলিও না। আমি সংক্ষেপে যে কথাটা বলতে চাই, যে সুযোগ আমাদের সামনে এসেছে, সেই সুযোগকে যদি আমরা হারিয়ে ফেলি, তাহলে বাংলাদেশ আরও বহু বছর পিছিয়ে যাবে।
ফখরুল বলেন, প্রতিবার একটা করে অভ্যুত্থান হবে, জনগণ প্রাণ দেবে, আমাদের ছেলেরা প্রাণ দেবে আর আমরা আমাদের দায়িত্বহীনতার কারণে সুযোগ হারাব, এটা হতে দেওয়া উচিত নয়। ফ্যাসিস্টবিরোধী আন্দোলনে রাজনৈতিক দলগুলোর ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমরা প্রমাণ করেছি যে, আমরা দেশকে ভালোবাসি।
আমাদের শক্তি ক্ষুদ্র হোক, বৃহৎ হোক, আমাদের যতটুকু শক্তি আছে, সেই শক্তি দিয়ে আমরা এদেশকে কিন্তু ফ্যাসিবাদ মুক্ত করার জন্য চেষ্টা করেছি। কেউ রক্তাক্ত হয়েছে, কেউ প্রাণ দিয়েছে, কেউ কারাগারে গেছে এবং দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া পর্যন্ত দীর্ঘ ৬ বছর কারাগারে কাটিয়েছেন, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান নির্বাসিত অবস্থায় আছেন।
ফখরুল বলেন, আজকে যে দায়িত্বশীলতা আমরা বিরোধী দলগুলো দেখিয়েছি, আমরা আশা করব যে, সরকারের প্রতিটি পর্যায়ে যারা দায়িত্বে রয়েছেন, সকল দলের কাছে গ্রহণযোগ্য একটা ব্যবস্থা, যেটা জনগণের বন্দোবস্ত, সেই বন্দোবস্তের একটা রূপরেখা আমাদের সামনে তুলে ধরবে এবং সেই রূপরেখা নিয়ে একমত হয়ে আমরা জনগণের কাছে যাব। নির্বাচন হবে, সেই নির্বাচনে আমাদের বিএনপির যে অঙ্গীকার, আমরা সবাই মিলে দেশকে নির্মাণ করার জন্য যে বিষয়গুলো অঙ্গীকার করেছি, সেই ৩১ দফা সংস্কার বাস্তবায়ন করব।
ফখরুল বলেন, আমি নেতিবাচক কথা বলতে চাই না। আমি শুধু এইটুকু বলতে চাই যে, আমরা অনেকের কাছে অনেকভাবে একটা নেতিবাচক, হতাশাব্যঞ্জক কথা শুনতে পাচ্ছি। আমরা মনে করি, আমরা অতীতে যেমন পেরেছি, এবারও পারব। অতীতে যেমন সমস্ত প্রতিবন্ধতাকে উপেক্ষা করে আমরা ঘুরে দাঁড়িয়েছি, জেল-জুলুম-গুলি কোনো কিছুই আমাদের ঠেকাতে পারেনি, আগামী দিনগুলোতে কোনো বাধাই ঠেকাতে পারবে না। তাই আসুন, আমরা সবাই একটা বিষয় একমত হই যে, আমাদের এই দেশকে এই রাষ্ট্রকে আবার ফ্যাসিবাদের হাতে ছেড়ে দেব না। আমাদের যে আকাক্সক্ষা, সেই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ফিরে যাওয়ার জন্য আমরা সবাই একমত হতে পারব ইনশাল্লাহ। হয়তো বিভিন্ন জায়গায় মতভেদ থাকতে পাওে, সেগুলো আবার কেটে যাবে।
দেশে দক্ষিণপন্থির উত্থান দেখা যাচ্ছে বলে মন্তব্য করে বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, এক বছর পেছনে যদি একটু তাঁকাই, তাহলে আমরা দেখব এক বছরে গোটা রাজনীতির একটা গুণগত পরিবর্তন হয়েছে। আমাদের চিন্তার দিক থেকে মতাদর্শের দিক থেকে, রাজনীতির দিক থেকে একটা দক্ষিণপন্থি চিন্তার, দক্ষিণপন্থি ভাবাদর্শের একটা উত্থান এখানে সংগঠিত হয়েছে। আমরা দেখছি, এই অন্তর্বর্তী সরকার তাদের কোলে নিয়ে, বুকে নিয়ে, তারা এই জায়গাটা তৈরি করছেন।
অনেকে গাছেরটাও খাচ্ছেন, আবার নিচেরটাও কুড়ানোর চেষ্টা করছেন। কিন্তু দেশটা যাচ্ছে কোথায়? গোটা লড়াই ছিল বৈষম্যের বিরুদ্ধে। বৈষম্য মানে কি? কোনো রাষ্ট্র তার নাগরিককে তার রাজনৈতিক বিশ্বাস, ধর্ম বিশ্বাসের জন্য, সাংস্কৃতিক বিশ্বাসের জন্য, নাগরিকের গণতান্ত্রিক সাংবিধানিক অধিকারের মধ্যে কোনো পার্থক্য করবে না। বাংলাদেশ কি সেই পথে হাঁটতে পারছে? খুবই দুর্ভাগ্যজনক যে, আমরা অনেক আলোচনা করছি কিন্তু সরকার এখনো কিন্তু ঠিকমতো সেই পথে এগোতে পারছি না।
গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি বলেন, নানা লক্ষণ আমরা দেখছি।
মিটফোর্ডে যেভাবে একটা হত্যাকা- ঘটানো হয়েছে এবং যেভাবে তার ভিডিও ফুটেজ, ন্যারেটিভ হাজির হয়েছে, তাতে পরিষ্কারভাবে মনে হচ্ছে ষড়যন্ত্র চলছে। যেভাবে গোপালগঞ্জে হামলা হয়েছে, তাতে মনে হচ্ছে দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি দেখানোর জন্য ষড়যন্ত্র চলছে। তবে মনে রাখা দরকার, আজকে বিচার, সংস্কার ও নির্বাচন এই তিনটা জিনিসই আমাদের রাজনৈতিক উত্তরণের জন্য অপরিহার্য বিষয়ে পরিণত হয়েছে। আমরা বিচার চাই, সংস্কার চাই, আমরা সংস্কার সম্পন্ন করার জন্য নির্বাচন চাই। নির্বাচন ছাড়া সংস্কার সম্পন্ন হবে না, জনগণের অংশগ্রহণ ছাড়া সংস্কার সম্পন্ন হবে না। কাজেই কোনোভাবে নির্বাচনকে ব্যাহত করার চেষ্টা আসলে বিচার এবং সংস্কারকেও ব্যাহত করা হবে।
গণতন্ত্র মঞ্চের সমন্বয়ক ভাসানী জনশক্তি পার্টির সভাপতি শেখ শহিদুল ইসলাম বাবলুর সভাপতিত্বে ও মহাসচিব আবু ইউসুফ সেলিমের সঞ্চালনায় আলোচনা সভায় আরও বক্তব্য রাখেন জাতীয় পার্টির (কাজী জাফর) চেয়ারম্যান মোস্তফা জামাল হায়দার, রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের সমন্বয়ক হাসনাত কাইয়ুম, জেএসডির সহসভাপতি তানিয়া রব, এবি পার্টির চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান মঞ্জু, জাতীয় নাগরিক পার্টির সদস্য সচিব আখতার হোসেন, নাগরিক ঐক্যের সাধারণ সম্পাদক শহীদুল্লাহ কায়সার, গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নূর, গণফোরামের নেতা এম মিজানুর রহমান, গণসংহতি আন্দোলনের নেতা আবুল হাসান রুবেল, বাংলাদেশ জাসদের নেতা নাজমুল হক প্রধান প্রমুখ।
প্যানেল হু