
ছবি: জনকণ্ঠ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আবিদুল ইসলাম খান এক সাক্ষাৎকারে বলেন, স্বৈরাচারী শেখ হাসিনার পতনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি নতুন অধ্যায় সূচিত হয়েছে। তিনি স্মরণ করেন, আন্দোলনের শেষ দিন শাহবাগ থানার সামনে কাদার মধ্যে ৪০ মিনিট ঘুমিয়ে ছিলেন, কারণ তিনি পূর্বে ঘোষণা দিয়েছিলেন—যেদিন হাসিনা ক্ষমতা ছাড়বে, সেদিন তিনি রাজপথেই ঘুমাবেন। তাঁর মতে, এই গণঅভ্যুত্থান কোনো আকস্মিক ঘটনা নয়, বরং দীর্ঘ পরিকল্পনা, ছাত্রদের সাহসিকতা এবং রাজনৈতিক নেতৃত্বের কৌশলের ফসল।
আবিদুল বলেন, ২০১৮ সালের কোটা সংস্কার আন্দোলন থেকেই এই আন্দোলনের বীজ রোপিত হয়। ৫ জুন কোটার পুনর্বহাল ঘটলে তখন থেকেই তারা ভাবতে থাকেন, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে একটি বড় আন্দোলনের ক্ষেত্র তৈরি হতে পারে। সাধারণ ছাত্রদের সঙ্গে রাজনৈতিক সংগঠনের প্রতিনিধি হিসেবে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি ছিল ভিন্ন। ফলে তারা ‘আন্দোলন পর্যালোচনা’ নামে একটি মেসেঞ্জার গ্রুপের মাধ্যমে আলাদা প্ল্যাটফর্ম তৈরি করেন। এখান থেকে তারা আন্দোলনকে কৌশলগতভাবে এগিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনা করেন এবং রাজনৈতিক ছাত্রদের সাধারণ আন্দোলনের সঙ্গে জেনারেলাইজ করে নেতৃত্বে আনার পদক্ষেপ নেন।
তিনি বলেন, তাদের প্রথম লক্ষ্য ছিল জুনিয়রদের আন্দোলনে সম্পৃক্ত করা, যাতে আন্দোলনটি গণভিত্তি পায়। দ্বিতীয়ত, সরকার বা স্বৈরাচারী পক্ষ যেন কোনো ভুল করে, সেই পরিবেশ তৈরি করা। ১৪ জুলাই রাতে শেখ হাসিনার একটি বক্তব্য—“মুক্তিযোদ্ধার নাতি পাবে, রাজাকারের নাতি পাবে না”—আন্দোলনটিকে দিক পরিবর্তনের সুযোগ করে দেয়। তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জিয়া হলের ছাত্রদলের নেতা রিজভ আলম “কে বলেছে, কে বলেছে, স্বৈরাচার স্বৈরাচার” এই স্লোগান গ্রুপে ছড়িয়ে দেন এবং জসিম উদ্দিন হলের সিফাত ইবনে আমিন তা রাজু ভাস্কর্যে প্রচার করেন। এই স্লোগান থেকেই সারা দেশে “হাসিনা স্বৈরাচার” হিসেবে চিহ্নিত হন এবং আন্দোলনের আবেগ আরও গভীর হয়।
তিনি জানান, আন্দোলনকে তিনি চারটি পর্যায়ে ভাগ করেন। প্রথম ধাপে ৫ জুন থেকে ১৪ জুলাই পর্যন্ত আন্দোলনের গোড়াপত্তন হয়। দ্বিতীয় ধাপে ১৫ জুলাই থেকে ১৮ জুলাই পর্যন্ত আন্দোলন এক দফার দাবির দিকে মোড় নেয়। তৃতীয় ধাপে ১৯ জুলাই থেকে ২ আগস্ট পর্যন্ত দেশজুড়ে গণঅভ্যুত্থানের জোয়ার সৃষ্টি হয়—সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী, শিক্ষক, রেমিট্যান্স যোদ্ধা, আইনজীবীসহ সবাই রাজপথে নামেন। চতুর্থ ধাপে ৩ থেকে ৫ আগস্ট আন্দোলন চূড়ান্ত রূপ নেয় এবং স্বৈরাচার পতনের দাবি পূর্ণমাত্রায় প্রতিষ্ঠিত হয়।
৫ আগস্ট চাঁনখারপুলে সংঘটিত ঘটনার স্মৃতিচারণ করে আবিদুল বলেন, সেদিন পুলিশের স্নাইপার হামলায় মুন্সিগঞ্জ পৌর ছাত্রদলের সদস্য সচিব মানিক মিয়া প্রথম গুলিবিদ্ধ হন। এরপর আরও চারজন শহীদ হন, যাদের একজন আনাস, যিনি আন্দোলনে যাওয়ার আগে বাবার উদ্দেশ্যে একটি আবেগঘন চিঠি লিখে যান—“যদি আর না ফিরি তবে গর্বিত হয়েও জীবনের প্রতিটি ভুলের জন্য ক্ষমা চাই।” ওই দিনের ঘটনাগুলো ছিল অবর্ণনীয়; আন্দোলনের প্রতিটি মুহূর্ত ছিল জীবন-মরণ সংগ্রাম। এরপর তারা শাহবাগে অবস্থান নেন এবং সেখানে স্লোগান দেন। কিছু সময় পরই খবর আসে—“হাসিনা ভারতে পালিয়ে গেছেন।”
আবিদুল বলেন, এই আন্দোলনের পরিকল্পনা, কৌশল এবং বাস্তবায়নের পেছনে ছাত্রনেতাদের যে ভূমিকা ছিল, তা অনেকটাই গণমাধ্যমের আড়ালে রয়ে গেছে। বিশেষ করে ‘কোটা পর্যালোচনা গ্রুপ’ নামে যেসব ছাত্রনেতারা গোপনে এই আন্দোলনের পরিকল্পনা করেছিল, তাদের অবদান এখনো সবার কাছে অজানা। তাঁর মতে, হাসিনাকে সরানো কোনো সহজ কাজ ছিল না। গণঅভ্যুত্থান ছাড়া অন্য কোনো পথ খোলা ছিল না। সেই পথেই তাঁরা সফল হয়েছেন এবং নতুন একটি রাজনৈতিক বাস্তবতা সৃষ্টি করেছেন।
ছামিয়া