আগারগাঁওয়ের এলজিআরডি মিলনায়তনে মতবিনিময় অনুষ্ঠানে ভার্চুয়ালি বক্তব্য দিচ্ছেন তারেক রহমান। ছবি: সংগৃহীত
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বলেছেন, আজ আমি শুধুমাত্র একজন রাজনৈতিক ব্যক্তি হিসেবে এখানে আসিনি। আমি এসেছি একজন ভাই, বন্ধু, কিংবা অভিভাবক হিসেবে আপনাদের পাশে দাঁড়ানোর প্রত্যয় নিয়ে এবং আপনাদের প্রতিভা ও আত্মনির্ভরশীলতা বিকাশে আমার ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক দায়বদ্ধতার জায়গা থেকে।কারণ আমি বিশ্বাস করি, আপনারা আমাদের পরিবারের অংশ, সমাজের অংশ, এবং দেশের অংশ। বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে, আমাদের সমাজ ও অর্থনীতিকে সচল রাখার ক্ষেত্রে, আপনাদের অসাধারণ ভূমিকা রয়েছে।
শনিবার বিকেলে রাজধানীর আগারগাঁওয়ে এলজিইডি-আরডিইসি ভবন মিলনায়তনে প্রতিবন্ধী নাগরিকদের সঙ্গে মতবিনিময়ে তিনি এ কথা বলেন ।
তারেক রহমান বলেন, আপনাদের জীবন ও সংগ্রাম আমাদের শেখায় যে, কর্মদক্ষতা, সক্ষমতা বা কাজের সামর্থ্য কেবল শারীরিক বা মানসিক অবস্থার মাধ্যমে নির্ধারিত হয় না। সব প্রতিকূলতা পেরিয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়ার যে অদম্য ইচ্ছাশক্তি, এবং সৃষ্টিকর্তার দেওয়া পরীক্ষাগুলোকে হাসিমুখে গ্রহণ করার যে সাহস আপনাদের রয়েছে, সেটিই সত্যিকারের সক্ষমতার পরিচয়।
আমরা যারা ভাগ্যবান, মহান আল্লাহর কৃপায় আপনাদের মতো কঠিন শারীরিক বা মানসিক পরীক্ষার মুখোমুখি হইনি, তারা অনেক সময় বুঝতেই পারি না কী অসীম বাধা অতিক্রম করে আপনারা স্বপ্ন দেখেন এবং আমাদেরও স্বপ্ন দেখতে শেখান। আপনারা আমাদের মনে করিয়ে দেন যে, সব অক্ষমতাকে জয় করে সমাজের প্রতিটি মানুষ মাথা উঁচু করে সম্মানের সঙ্গে বাঁচতে চায়, এবং দৃঢ়তার সাথে সসম্মানে বাঁচতে পারে।
তিনি বলেন, আপনাদের সেই সাহস, সংকল্প ও শক্তি আমাদের জন্য প্রেরণার উৎস। এটি আমাদের উদ্বুদ্ধ করে একটি সাম্য, মানবিক মর্যাদা এবং সামাজিক সুবিচারের ভিত্তিতে অন্তর্ভুক্তিমূলক ও বৈষম্যহীন বাংলাদেশ গড়ে তোলার লক্ষ্যে কাজ চালিয়ে যেতে।
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বলেন,আজ আমি আপনাদের এমন চারজন মানুষের জীবনের গল্প শোনাবো, সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত প্রচেষ্টায় যাঁদের অর্জিত সাফল্য আমাদের প্রেরণা যোগায়।প্রথম গল্পটি পটুয়াখালীর একজন ৬৮ বছর বয়সের মানুষের, যিনি বাক্প্রতিবন্ধী হলেও, ফ্রিল্যান্স আউটসোর্সিংয়ে গ্রাফিক ডিজাইনের কাজ করছেন। তরুণদের সাথে পাল্লা দিয়ে, বিদেশী ক্লায়েন্ট থেকে ডলার উপার্জন করে পরিবারের অর্থনৈতিক দায়িত্ব পালন করা এই মানুষটির সাফল্য প্রমাণ করে, বয়স বা প্রতিবন্ধকতা কখনো জীবনের গতিপথ বদলাতে পারে না।
দ্বিতীয় গল্পটি এক তরুণের, যাঁর কোমর থেকে পা পর্যন্ত অবশ। শারীরিক সীমাবদ্ধতা তাঁকে শিখিয়েছিলো, “আমার পা নেই তো কী হয়েছে? আমার হাত তো আছে।” তিনি নিজের পছন্দের শখের কাজ, কাঠের শিলপকলা তৈরির মধ্যে নিজের প্রতিভা প্রকাশ করতে শুরু করেন। পা না থাকলেও, হাতের নিপুণ কাজে তিনি অসাধারণ কাঠের পণ্য তৈরি করেন, যা স্থানীয় বাজারে বিক্রি হয় এবং তাঁর হাতের কাজ আজ দেশজুড়ে জনপ্রিয়।
তৃতীয় গল্পটি মৌলভীবাজারের এক দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী তরুণের, যিনি চা-বাগানের এক শ্রমিকের সন্তান। চোখে আলো নেই, কিন্তু মনের আলোর শক্তিতে এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ অর্জন করেছেন। তাঁর সংগ্রামী মনোবল আমাদের শিখিয়েছে, ইচ্ছাশক্তি আর মেধা কখনো শারীরিক সীমাবদ্ধতার কাছে হার মানে না।
চতুর্থ গল্পটি এমন একজন মানুষের, যাঁর চলার শক্তি নেই, একমাত্র ডান হাতের বৃদ্ধাঙ্গুল নড়াতে পারেন। সেই আঙুল দিয়েই তিনি কম্পিউটারে কাজ করেন। কুমিল্লার এক ছোট ঘরে বসে তিনি বেলজিয়ামের প্রতিষ্ঠানের জন্য পণ্যের ক্যাটালগ ডিজাইন করেন, একক প্রচেষ্ঠায় নিশ্চিত করে চলছেন অর্থনৈতিক মুক্তি ও সামাজিক অগ্রযাত্রা।
এই চারজন ব্যক্তি আমাদের দেখিয়েছেন যে, প্রকৃত সক্ষমতা শরীর দিয়ে নয়, মনের জোর, ইচ্ছাশক্তি আর কঠোর পরিশ্রম দিয়ে মাপা হয়। তাঁদের গল্প আমাদের শিখিয়েছে, “বাধা” শুধু একটি শব্দ, যা চেষ্টার মাধ্যমে জয় করা সম্ভব। আমাদের দায়িত্ব – তাঁদের লড়াইকে সম্মান জানানো, তাঁদের পাশে দাঁড়ানো। আমরা এমন একটি বাংলাদেশ গড়তে চাই, যেখানে প্রতিটি মানুষ তার সীমাবদ্ধতাকে জয় করে নিজের স্বপ্ন পূরণের সুযোগ পাবে।
শারীরিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করেও যাঁরা নিজ উদ্যোগে অর্থনীতিতে অবদান রাখছেন, তাঁদের বিজয়ের গল্প আমাদের আলোর পথ দেখায়। আমি প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি, আগামীর বাংলাদেশে শারীরিক সীমাবদ্ধতা যেন কাউকে বৈষম্যের শিকার না করে, পিছিয়ে না রাখে, সেই বহুমুখী উদ্যোগ নিয়ে, জীবনযুদ্ধে বিজয়ের অজস্র প্রেরণাদায়ী গল্প সৃষ্টি করা হবে। এক সাথে কাজ করে আমরা এমন একটি সমাজ গড়ে তুলব, যেখানে প্রতিটি মানুষ তার পূর্ণ সম্ভাবনায় পৌঁছাতে পারবে, ইনশাআল্লাহ।
তিনি আরও বলেন, গত ১৬ বছর ধরে আমরা এমন একটি বাংলাদেশে বসবাস করেছি, যেখানে আমাদের প্রাপ্য নাগরিক অধিকার ও স্বাধীনতা একে একে কেড়ে নেওয়া হয়েছে। সমাজের প্রতিটি শ্রেণী ও পেশার মানুষ রাষ্ট্রীয় সহায়তা থেকে বঞ্চিত হয়েছে, এবং আপনারাও তার ব্যতিক্রম নন। এর ফলে, আপনাদের জীবনের মান উন্নয়নে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি, যা ব্যক্তিগতভাবে আমিও অনুভব করেছি।
তারেক রহমান বলেন, আপনারা অনেকেই জানেন, ২০০১ সালে তৎকালীন বিএনপি সরকার বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রতিবন্ধীদের ভাতা প্রদান শুরু করলেও, আওয়ামী লীগ সেই ভাতাকে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির সাথে সামঞ্জস্য না রেখে, নিজেদের নেতা-কর্মীদের মাঝে লুটে নিয়েছে। অর্থনৈতিক বাস্তবতার সাথে সামঞ্জস্য রেখে, আমরা প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য ভাতার পরিমাণ বাড়িয়ে, তা ন্যায্যভাবে পুনর্নির্ধারণ করতে চাই। নিবন্ধন প্রক্রিয়াকে সহজ ও স্বচ্ছ করার লক্ষ্যে, আমরা সমাজকল্যাণ, স্বাস্থ্য এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মধ্যে সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ করবো, যাতে একজন প্রতিবন্ধীও সামাজিক সুবিধা থেকে বাদ না পড়ে।
দেশে কিছু প্রাইভেট অর্গানাইজেশন শারীরিক প্রতিবন্ধীদের নানা ধরনের ট্রেনিং প্রদান করে। তবে, এই ট্রেনিং শেষে চাকরির ব্যবস্থা করতে গিয়ে তারা হিমশিম খায়। এই সমস্যার সমাধানে, আমরা উদ্যোগ গ্রহণ করবো যাতে দেশের বড় ব্যবসাগুলো একটি নির্দিষ্ট শতাংশ শারীরিকভাবে চ্যালেঞ্জড ব্যক্তিদের নিয়োগ করতে উৎসাহিত হয়। উদাহরণস্বরূপ, বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন ব্যক্তিদের নিয়োগ করলে, আমরা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোকে কিছু ট্যাক্স সুবিধা বা কমপ্লায়েন্স সার্টিফিকেট প্রদান করার চিন্তা করতে পারি।
"সুবর্ণ নাগরিক কার্ড" নামক যে তথাকথিত কার্ড রয়েছে, সেটিকে গতিশীল করে আমরা এর আওতায় স্বাস্থ্য বীমা, শিক্ষা বৃত্তি, পরিবহন ডিসকাউন্টসহ অন্যান্য সামাজিক সুবিধা প্রদান করতে চাই। বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন ব্যক্তিরা যাতে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হতে পারেন, আমরা তাঁদের জন্য বাস্তবসম্মত ভোকেশনাল ও টেকনিকাল ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করবো।
বিশেষত আউটসোর্সিং, ডাটা প্রসেসিং, এবং ফ্রিল্যান্সিংয়ের ক্ষেত্রে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন কিন্তু মেধাবী তরুণদের জন্য সুনির্দিষ্ট কারিগরি ও কাঠামোগত সুবিধা প্রদানের পাশাপাশি, ট্যাক্স ওয়েভার এবং ওয়ার্ক স্টেশন সৃষ্টির সুযোগ কার্যকরভাবে বিবেচনা করা যেতে পারে। অন্যান্য ক্ষেত্রেও, উদ্যমী ও সফল প্রতিবন্ধীদের জন্য সহজ শর্তে বিশেষ ঋণ সুবিধা প্রদান করে উদ্যোক্তা সৃষ্টির প্রচেষ্টা চালানো যাবে।
আমরা গণপরিবহন ও বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি স্থাপনাকে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য উপযোগী করে তোলার লক্ষ্যে একটি সমন্বিত পরিকল্পনা গ্রহণ করতে চাই। পাশাপাশি, সরকারি চাকরিতে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য আমরা একটি নির্দিষ্ট অংশীদারিত্ব নিশ্চিত করার উদ্যোগ নিতে চাই।
আমরা প্রতিবন্ধী শিশুদের শিক্ষার বিষয়টি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে আনার বিষয়টি বিবেচনা করবো এবং তাঁদের স্বাস্থ্যসেবা বিদ্যমান স্বাস্থ্য ব্যবস্থার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য কাজ করতে চাই। তাঁদের জন্য ফাস্ট-ট্র্যাক সেবা প্রদান, প্রায়োরিটি সল্যুশন, এবং বিভিন্ন এডমিশনে নির্দিষ্ট অংশ সংরক্ষণের পরিকল্পনা রয়েছে। বিচারিক প্রক্রিয়ায় প্রয়োজনীয় সংস্কার এনে প্রতিবন্ধীসহ প্রান্তিক জনগণের ন্যায্য বিচার পাওয়ার সুযোগ আরও সুগম করার উদ্যোগ নিতে চাই।
বিএনপি সরকার গঠন করলে, জেলা পর্যায়ে বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিক্ষার্থীদের জন্য বিশেষায়িত স্কুল প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা থাকবে, যেখানে সাইন ল্যাঙ্গুয়েজ, ব্রেইলসহ ইনক্লুসিভ এডুকেশনের আধুনিক পদ্ধতি অন্তর্ভুক্ত করার চেষ্টা করা হবে। পাশাপাশি, কারিগরি ও পেশাগত শিক্ষার মাধ্যমে কর্মজীবনে প্রবেশের সুযোগ তৈরি এবং প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের জন্য স্কলারশিপ ও প্রয়োজনীয় শিক্ষা উপকরণ সরবরাহের ব্যবস্থা বিবেচনা করা হবে।
অনুষ্ঠানে অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। বিএনপির স্বাস্থ্য বিষয়ক সম্পাদক ডাঃ রফিকুল ইসলাম,সহ-স্বাস্থ্য বিষয়ক সম্পাদক ডাঃ পারভেজ রেজা কাকন ও ‘আমরা বিএনপি পরিবার-এর আহবায়ক আতিকুর রহমান রুমন। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের উপদেষ্টা ডক্টর মাহাদী আমিন, স্বেচ্ছাসেবক দলের সাধারণ সম্পাদক রাজীব আহসান, বিএনপি মিডিয়া সেলের সদস্য ডাঃ মোস্তফা আজিজ সুমন,সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ফারজানা শারমিন পুতুল, সাংবাদিক জাহিদুল ইসলাম রনি, এম সাঈদ খান, ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম-সম্পাদক ফারহান আরিফ।
দেশের বিভিন্নপ্রান্ত আসা অন্তত দেড় শতাধিক প্রতিবন্ধী নাগরিক মতবিনিময় অনুষ্ঠানে অংশ নেন। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন প্রতিবন্ধী নাগরিক সংগঠনের পরিষদ (পিএনএসপি)-এর সাধারণ সম্পাদক সালমা মাহবুব (তিনি হুইল চেয়ারে বসা প্রতিবন্ধী) এবং আরেকজন সঞ্চালক ইফতেখার মাহবুব (তিনি নিজেও দৃষ্টি প্রতিবন্ধী)।
নাহিদা