
বাংলাদেশের তরুণ সমাজ এক ভয়াবহ বিপদের মুখে দাঁড়িয়ে আছে—এই বিপদ কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ নয়, নয় কোনো বাইরের আগ্রাসন। এটি এক নীরব মহামারী—মাদক। বর্তমান সময়ে আমাদের তরুণ প্রজন্মের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ ধীরে ধীরে ঝুঁকে পড়ছে মাদকের দিকে। এই নেশাজনিত পথ যেন এক আত্মঘাতী যাত্রা, যার শেষ গন্তব্য মৃত্যু, অপরাধ কিংবা অপূরণীয় ক্ষতি।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যমতে, একজন মানুষের জীবনে ১৫ থেকে ৩৫ বছর বয়সটাই সবচেয়ে কার্যকর ও সম্ভাবনাময় সময়। কিন্তু দুঃখজনকভাবে, বাংলাদেশে এই বয়সের লাখো তরুণ এখন ইয়াবা, গাঁজা, ফেনসিডিল, আইস, হেরোইনসহ নানা ধরনের মাদকের শিকার। শুধু শহরেই নয়, মাদকের থাবা এখন গ্রাম-গঞ্জেও।
মাদকের বিস্তার ও বাস্তব চিত্র
প্রতিবছর বাংলাদেশে প্রায় ৭০ হাজার কোটি টাকার মাদক ব্যবসা হয় বলে বিভিন্ন সংস্থার জরিপে জানা গেছে। বিগত কয়েক বছরে মাদকসেবীর সংখ্যা ভয়াবহভাবে বেড়েছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের (ডিএনসি) তথ্যমতে, দেশে প্রায় ৭৫ লাখ মানুষ কোনো না কোনোভাবে মাদক সেবনের সঙ্গে জড়িত। এর মধ্যে ৮০ শতাংশই ১৫ থেকে ৩০ বছর বয়সী।
বিশেষ করে ইয়াবা এখন "গেইটওয়ে ড্রাগ" হিসেবে পরিচিত, যা তরুণদের প্রথম মাদক গ্রহণের দ্বার খুলে দেয়। আগে যেখানে মাদক গ্রহণ সীমিত ছিল কিছু নির্দিষ্ট অঞ্চলে, এখন তা ছড়িয়ে পড়েছে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় এমনকি মাদ্রাসার ছাত্রদের মাঝেও।
শিক্ষা ও ক্যারিয়ারে ধ্বংস
একজন মাদকাসক্ত তরুণ প্রথমে হারায় মনোযোগ ও অধ্যবসায়। পড়াশোনার প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলে, ফলাফল খারাপ হতে থাকে। ধীরে ধীরে সে হয়ে ওঠে অসামাজিক, পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন, ও অপরাধ প্রবণ। অনেক ক্ষেত্রে দেখা গেছে, ভালো ছাত্ররাও মাদকের শিকার হয়ে উঠেছে চুরি, ছিনতাই, এমনকি হত্যার মত অপরাধে জড়িত।
বিশ্ববিদ্যালয় বা কলেজ পড়ুয়া অনেক শিক্ষার্থীকেই এখন মাদকের কারণে পড়াশোনা বাদ দিয়ে ঘুরে বেড়াতে দেখা যায়। কেউ কেউ মাদক বিক্রেতার দলে নাম লেখায়, কেউ আবার বিদেশে কাজ করতে গিয়ে গ্রেপ্তার হয় মাদক বহনের দায়ে।
পরিবার ও সমাজে ভয়ানক প্রভাব
মাদক শুধু একজন ব্যক্তিকেই শেষ করে না, ধ্বংস করে একটি পরিবারকে। বাবা-মায়ের চোখের সামনে সন্তান ধ্বংস হয়ে যেতে দেখার মতো কষ্ট আর কিছু নেই। একেকটি পরিবার আর্থিক, মানসিক ও সামাজিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অনেক বাবা-মা বাধ্য হন সন্তানকে ঘর থেকে বের করে দিতে, অনেকেই মাথা উঁচু করে চলতে পারেন না সমাজে। সমাজে মাদকের কারণে বাড়ছে চুরি, ধর্ষণ, খুন, অপহরণ, সহিংসতা—এইসব অপরাধে জড়িতদের বড় অংশই মাদকসেবী বা মাদক বিক্রেতা।
মানসিক স্বাস্থ্য ও আত্মহত্যার প্রবণতা
মাদক শুধু শরীরের ক্ষতি করে না, মানসিক স্বাস্থ্যের উপরও ভয়ংকর প্রভাব ফেলে। একজন মাদকাসক্ত মানুষ ধীরে ধীরে বিষণ্নতা, অবসাদ, হ্যালুসিনেশন, সন্দেহপ্রবণতা, ক্ষিপ্রতা ইত্যাদি মানসিক সমস্যায় ভোগে। অনেকেই আত্মহত্যা পর্যন্ত করে ফেলেন।জাতিসংঘের প্রতিবেদন অনুযায়ী, দক্ষিণ এশিয়ায় তরুণদের মধ্যে আত্মহত্যার অন্যতম কারণ হলো মাদক।
কেন তরুণরা ঝুঁকে পড়ছে মাদকে?
তরুণদের মাদকাসক্ত হওয়ার মূল কারণগুলো হলো—
1. বন্ধু প্রভাব (Peer Pressure)
2. কৌতূহল ও ভুল সিদ্ধান্ত
3. পরিবারে অবহেলা বা অশান্তি
4. প্রেমে ব্যর্থতা বা মানসিক চাপ
5. সহজলভ্যতা ও নিয়ন্ত্রণহীন পরিবেশ
6. অসত্ সংবাদ মাধ্যম ও নায়কোচিত উপস্থাপন
বিশেষ করে শহুরে তরুণদের অনেকেই নেশাকে "স্টাইল" বা "ম্যাচুরিটি" হিসেবে দেখে শুরু করে, পরে আর বের হতে পারে না।
মাদক নিয়ন্ত্রণে রাষ্ট্রের ভূমিকা কতটা কার্যকর?
সরকার প্রতিবছর কোটি কোটি টাকা ব্যয় করে মাদকবিরোধী অভিযান চালায়। "জিরো টলারেন্স" নীতি ঘোষণা করা হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, অনেক জায়গায় অভিযান হচ্ছে লোক দেখানো, আবার অনেক সময় রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়ায় মাদক ব্যবসায়ীরা পার পেয়ে যাচ্ছে।
পুলিশ ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কিছু অসাধু সদস্যের সংশ্লিষ্টতার অভিযোগও রয়েছে। আর সবচেয়ে বড় কথা, মাদকের উৎস ও সরবরাহ লাইন সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করা যাচ্ছে না।
সমাধানের পথ: আমরা কী করতে পারি?
পারিবারিক বন্ধন জোরদার: সন্তানের প্রতি সময় দিন, কথা বলুন, বন্ধুর মতো আচরণ করুন।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সচেতনতা: নিয়মিত ক্যাম্পেইন, কাউন্সেলিং, ও মাদকবিরোধী নাটক-আলোচনা কার্যকর ভূমিকা রাখে।
কঠোর আইন প্রয়োগ: মাদক ব্যবসায়ীদের কোনো ছাড় নয়—রাজনৈতিক ছত্রছায়া বাদ দিতে হবে।
পুনর্বাসন কেন্দ্রের সংখ্যা বাড়ানো: অনেক তরুণ মাদক ছাড়তে চায়, কিন্তু পায় না সহায়তা। সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগ দরকার।
মিডিয়া ও সংস্কৃতির ইতিবাচক ভূমিকা: নাটক, সিনেমা, গান—সবখানে মাদকের বিরুদ্ধে বার্তা পৌঁছাতে হবে।
তরুণরা জাতির ভবিষ্যৎ। যদি তারা আজ মাদকের পথে ধ্বংস হয়, আগামীকাল আমাদের সমাজ-রাষ্ট্রও ধ্বংস হয়ে যাবে। তাই এখনই সময়—মাদকের বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলার। পরিবার, সমাজ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, প্রশাসন—সবাইকে একসাথে কাজ করতে হবে। একটি জাতিকে ধ্বংস করতে যুদ্ধ লাগে না, মাদকই যথেষ্ট। তরুণদের হাতেই জাতির পতাকা—তারা যেন সেই হাতেই আর মাদকের প্যাকেট না ধরে, সেই প্রার্থনা আমাদের সকলের।
লেখক: শরিফুল খান প্লাবন, সাংবাদিক ও কলাম লেখক
নোভা