
লন্ডনের রাস্তায় তখন রবিবারের সকাল। ১৩ জুলাই। সাড়ে ৮টার মতো বাজে। প্রতিদিন এ সময়ে রাস্তায় রাস্তায় জীবনের মিছিল নেমে যেত, আজ এখনো সবকিছু ঝিমোচ্ছে। লোক ও গাড়ি চলাচল দুই-ই ফাঁকা। দোকানপাট বন্ধ। কফিশপের মনমাতানো গন্ধ শহরের বাতাসে পাক খেয়ে খেয়ে উড়ে যেতে শুরু করেছে কেবল। ঠিক এমন সময়, ইস্ট লন্ডনের মাইলঅ্যান্ড এলাকা থেকে এক বাসভর্তি আমরা ত্রিশ জন- কবি-সাহিত্যিক, সাংবাদিক, কণ্ঠশিল্পী, অভিনয়শিল্পীদের একটি দল, চলেছি লন্ডন ছেড়েদূরে, শেফিল্ড শহরে।
যুক্তরাজ্যের মানচিত্রে শেফিল্ডের অবস্থান সাইথ ইয়র্কশায়ার কাউন্টিতে। লোকসংখ্যা সাড়ে পাঁচশ’ হাজারের মতো। বাঙালির সংখ্যা সরকারি হিসেবে চার হাজার দুইশ ছেষট্টি জন, যা কিনা ওখানকার মোট জনসংখ্যার শূন্য দশমিক ৮ শতাংশ। শেফ নদের তীরে গড়ে ওঠা এই শহর ‘স্টিলের নগরী‘ হিসেবে খ্যাত। শিল্পবিপ্লবের সময়ে এখানে অনেকগুলো স্টিল-শিল্প নির্ভর কারখানা গড়ে উঠেছিল। এখানকার ‘শেফিল্ড স্টিল’ এবং কাটলারি (ছুরি, কাঁচি ইত্যাদি) এক সময় আন্তর্জাতিকভাবে পরিচিত ছিল। কালের বিবর্তনে অবশ্য ব্রিটেনের অন্য সব জায়গার মতোই শেফিল্ডও তার কারখানাগুলো গুটিয়ে নিতে বাধ্য হয়েছে। অতীতের বেশ কিছু স্মৃতি চিহ্ন বুকে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা এ শহর অতি মনোরম সবজ বন-বনানীতে ঘেরা। এখানে প্রায় ২৫০টিরও বেশি পার্ক, বন্য টিলা, উন্মুক্ত সবুজ বনাঞ্চল আছে যার পরিমাণ ব্রিটেনের অন্য যে কোনো শহরের চেয়ে বেশি। অতি সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল-থিয়েটার, মিউজিয়াম, লাইভ মিউজিক, ইংলিশ ফুটবলের দুটি ঐতিহ্যবাহী দল, দুটো আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি সম্পন্ন বিশ্ববিদ্যালয়- সবমিলিয়ে অতি জমজমাট একটি সমৃদ্ধ ঐতিহাসিক শহরে আজ আমাদের নিমন্ত্রণ। শেফিল্ড সাহিত্য একাডেমির বার্ষিক আয়োজন সাহিত্য উৎসবে যোগ দিতে চলেছি আমরা। আয়োজকরা অনুষ্ঠানটির নামকরণ করেছেন: শব্দ উৎসব। শেফিল্ড সাহিত্য একাডেমির সেøাগানটি হচ্ছে: এ শহরের হৃদয় রেখা, বাংলাভাষার নিঃশব্দ লেখা। পুরো ৪ ঘণ্টার ভ্রমণ শেষে (লন্ডন থেকে শেফিল্ডের দূরত্ব প্রায় ১৬৭ মাইল) যখন অকুস্থলে পৌঁছালাম, মনে হলো, তারা চাইলে সেøাগানটি এবার বদলে দিতে পারেন। হলভর্তি মানুষের কলকাকলিতে মুখরিত অনুষ্ঠানের আয়োজন করে আসছেন যারা গত তিন-চার বছর ধরে নিয়মিত ভাবে, তারা সেøাগানে ‘নিঃশব্দ’ শব্দটি বদলে ‘সশব্দ’ বসিয়ে দিতে পারেন এবার অনায়াসে।
বিদেশের মাটিতে যারা বাংলা ভাষার চর্চা করেন এবং সেটির সচকিত শোরগোল তুলতে গাঁটের পয়সা খরচ করে নিয়মিত অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন, তাদের বেশ অনেকখানি ‘খ্যাপাটে‘ হতে হয়। যেখানে প্রতি মিনিটকে মাপা হয় পাউন্ডের কড়ে-আঙুলে, সেখানে দিনের পর দিন আপাত একটি ‘লস প্রজেক্টে‘ নিজেকে নিয়োজিত রেখে, মন-প্রাণ ঢেলে তাতে নিজেকে ব্যস্ত রাখা মানুষগুলোর প্রাণশক্তি ও বাংলাসংস্কৃতির প্রতি আদি ও অকৃত্রিম প্রেম- তা বাহির থেকে বোঝা এবং শব্দ-বাক্যে সাজিয়ে বোঝানো- এক কথায় অসম্ভব। একথা বলাই বাহুল্য যে, ইংল্যান্ডজুড়ে বাংলা ভাষার ও সাহিত্যের চর্চা প্রতি বছরই সংকুচিত হয়ে আসছে। এখানকার আর কোনো স্কুলেই এখন আর বাংলা পড়ানো হয় না, জিসিএসসিতে বাংলা নিতে হলে এতটা কাঠ-খড় পোড়াতে হয় এখন যে সেই চেষ্টা বাচ্চারাতো অবশ্যই, অভিভাবকরাও করতে ভরসা পান না। অতীতে কাউন্সিলগুলো সাংস্কৃতিক চর্চার জন্য প্রতি বছর কিছু অনুদান দিতো। সেসব এখন অতীতেরই গল্প। লাইব্রেরিগুলোতে বাংলা বই কমতে কমতে ন্যূনতম সংখ্যায় এসে ঠেকেছে। যেগুলো এখনো আছে, সেগুলোও সটকে পড়বে যে কোনো দিন। পাঠক না থাকলে বই সাজিয়ে রেখে কী হবে- এই হলো সহজ সমীকরণ। ফলে বাংলা বইয়ের তাকে বাংলা বইকে হটিয়ে অন্যান্য এশিয়ান ভাষার বইয়ের কলেবর বৃদ্ধি পাচ্ছে ক্রমশ। স্বয়ং লন্ডন শহরের বাঙালি অধ্যুষিত এলাকাগুলোর অবস্থা যখন এই, তখন অনেক দূরের শহর শেফিল্ডে অতি অল্প সংখ্যক বাঙালিদের জন্য সরকারি-মাথাব্যথা থাকবে না, সেটা সহজেই অনুমেয়।
কিন্তু সরকারি-মাথাব্যথা না থাক, এই ছোট্ট কমিউনিটিতেই এমন কয়েকজন বাঙালি আছেন, যারা বাংলা ভাষা আর সাহিত্য নিয়ে নিজেরা মেতে থাকেন, অন্যদের নিয়ে মেতে উঠতে চান। তাদের একগুঁয়ে গোঁ, জেদ, আর বনের খেয়ে মোষ তাড়ানোর প্রতিজ্ঞায় গড়ে ওঠা শেফিল্ড সাহিত্য একাডেমি। বিশেষত তিনজন মানুষ: কবি আবু মকসুদ, কবি আহমেদ হোসেন হেলাল এবং কবি নুরুল হক, যুক্তরাজ্যের সাহিত্যপ্রেমীরা যাদের আদর করে ডাকেন- ত্রিরত্ন, আয়োজন করেছেন আমাদের নিমন্ত্রণ পাওয়া আজকের অনুষ্ঠানটির। এই মানুষকে আমি অনেক দিন ধরেই জানি। জানি সাহিত্য নিয়ে তাদের বিপুল উদ্দীপনা আর সে উদ্দীপনাকে জিইয়ে রাখার বিপরীতে প্রতিদিনকার সংগ্রামের কথা। কিন্তু শত বিপত্তিতেও হাল ছেড়ে না দিয়ে, শেফিল্ডের মতো জায়গায়- যেখানে বাঙালিই হাতে গোনা তো শিল্প-সাহিত্য উৎসাহির সংখ্যা বলাই বাহুল্য- এক পা এক পা করে এগিয়েছেন, চন্দ্র উৎসব, বর্ষার কবিতা, রবীন্দ্র-নজরুল পাঠ, জাতীয় দিবসের অনুষ্ঠান- এমন নিয়মিত আয়োজন জারি রেখে অসীম ধৈর্যে তৈরি করেছেন ভীত। আর কয়েক বছর ধরে আয়োজন করে আসছেন এই বার্ষিক অনুষ্ঠানের, যেখানে লন্ডনের কবি-সাহিত্যিক ছাড়াও যুক্তরাজ্যের অন্যান্য শহরের কিছু স্বপ্নভুক মানুষ এসে হাজির হন বাংলাভাষার কবিতা, গল্প, গানের আকর্ষণে। ব্যাপার এতদূর গড়িয়েছে যে এই উৎসবকে কেন্দ্র করে গ্রন্থ প্রকাশ পর্যন্ত হয়েছে, উৎসব কাণ্ডারীর যৌথ গল্পগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে ‘প্রবাসের তিনছায়া’ নাম দিয়ে। উৎসব হলের ঠিক প্রবেশ পথেই ছিল বইয়ের প্রদর্শনী আর বিকি-কিনির সুবিধা। বিলেতে প্রবাসী অন্যান্য অনেক সাহিত্যিকের বইও সেখানে প্রদর্শিত হচ্ছিল।
ব্রিটেনে এখন গ্রীষ্মকাল। উজ্জ্বল রোদের রং, দিব্যি টি-শার্ট পরে বাইরে বেরুনো চলে। ছাতা কিংবা রেইনকোটের মতো উচ্ছিষ্ট সঙ্গে নেবার কথা ভাবতে হয় না। লোকজনের গায়ে রঙের বাহার। তার আভাস চোখে-মুখেও। আমাদের বাসভর্তি কবি, সাংবাদিক, শিল্পী। স্বভাবতই যা হওয়ার কথা, তাই হতে শুরু হলো বাস রাস্তায় গড়াতে না গড়াতেই। আবৃত্তি, রাস্তা-মাতিয়ে গান। যেতে যেতে রবিবারের সকালে ঘুম-ঘুম লোকজনকে সচকিত করে আমাদের বাস ভর দুপুরে এসে পৌঁছাল আন্তর্জাতিক গাছের নগরী স্বীকৃতি পাওয়া শেফিল্ডে। হলভর্তি মানুষ। গান হচ্ছে। অতি সাদরে, রীতিমতো বুকে জড়িয়ে বরণ করে নেওয়া হলো আমাদের। যুক্তরাজ্যের অন্যান্য শহর- ম্যানচেষ্টার, লিডস, লিভারপুল, ওল্ডহাম, হাইড প্রভৃতি জায়গা থেকে আসা মানুষকে দেখেও মন আমোদে ভরে উঠল সহসা, নিমেষে মাথা ছাড়া দিয়ে উঠল আদি ও অকৃত্রিম সৌহার্দ্য। দিনভর আবৃত্তি, গান, কবিকণ্ঠে কবিতা, বক্তৃতা, হাসি-ঠাট্টা, আড্ডায় মুহূর্তে মেতে উঠলাম আমরা আর সবার সঙ্গে। বাদ গেল না একক অভিনয়ও। তার সঙ্গে বিয়ে বাড়ির মতো বিবিধ খাওয়ার আয়োজন, গেলাস ভর্তি চা, প্লেট ভর্তি চানাচুর- মেতে উঠতে আর কী লাগে। প্রবীণ ও নবীন নানা প্রজন্মের মানুষের সম্মিলনে সময় উড়ে যেতে লাগল যেন নিমেষে। বাংলাগানে গলা মিলালেন ছেলে-বুড়ো সবাই। প্রাণ ভরে গাওয়া গেল: আমি বাংলার গান গাই, আমি বাংলায় গান গাই...। বিলেতে কিছু কিছু অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত করানোর কিঞ্চিত অভিজ্ঞতা আছে বলেই এত বড় একটি আয়োজনের পেছনের কারিগর মাত্র তিনজন মানুষ জেনে রীতিমতো চোখ কপালে তুলতে হলো। বিদেশের শক্ত মাটিতে আমাদের নরম সাহিত্য আগামী কয় প্রজন্ম টিকে থাকবে- সে ভবিষ্যৎ ভেবে প্রায়ই হতাশ হই বটে, তবে এমন সাহিত্য-উৎসাহী ব্যক্তিরা যে সহসা বাংলা সাহিত্য চর্চাকে বিলেত থেকে নড়বড়ে হতে দেবেন না, সে আশ্বাসের বাণীই যেন কানে পশতে লাগল সারাদিন ধরে। বাংলা সংস্কৃতি উৎসাহী মানুষদের জন্য এমন একটি মিলনমেলার অতি মনোরম আয়োজনে যোগ দিতে পেরে নিজেকে তৃপ্ত মনে হচ্ছিল। জয়তু শেফিল্ড সাহিত্য একাডেমি।
লন্ডন ফিরে এলাম গভীর রাতে। বাড়ি ফিরতে ফিরতে মনে হচ্ছিল, বাংলাদেশ থেকে হাজার মাইল দূরের এই ইংরেজ ভূমিতে কত কত মানুষ কত চড়াই, কত উতরাই পেরিয়ে, ঘরগেরস্থালির দৈনন্দিনের দাবিকে উপেক্ষা করে এই যে এখনো স্বপ্ন দেখেন বাংলায়, বাংলায় লিখেন, পড়েন, গলা তুলে মাইক বাজিয়ে গান করেন, বাংলাভাষা ও তার সংস্কৃতিকে পরপ্রজন্মের কাছে চারিয়ে দিতে ভিনদেশের ভিনসংস্কৃতির শক্তমাটিতে দাঁড়িয়ে দিনের পর দিন খ্যাপা মানুষের মতো কাজ করে চলেছেন- এমন কখনো কি হবে যে বাংলাদেশ তাদের এই সন্তানদের চিনবে, জানবে, তাদের কাজের মূল্যায়ন করবে, স্বীকৃতি দিতে শুরু করবে কোনো একদিন?
১৭ জুলাই ২০২৫
[email protected]
প্যানেল/মো.