ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ২০ জুলাই ২০২৫, ৪ শ্রাবণ ১৪৩২

ফুসফুসের ক্যান্সার ॥ সচেতনতা ও করণীয়

ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. শাহীনুর রহমান

প্রকাশিত: ২০:১৩, ১৯ জুলাই ২০২৫

ফুসফুসের ক্যান্সার ॥ সচেতনতা ও করণীয়

ফুসফুসের ক্যান্সার একটি ভয়াবহ রোগ। প্রতিবছর বিশ্বজুড়ে প্রায় ১৮ থেকে ২০ লাখ মানুষ এই রোগে মৃত্যুবরণ করেন। অনেক সময় রোগ নির্ণয়ের এক বছরের মধ্যেই মৃত্যুর আশঙ্কা থাকে। তবে আশার কথা হলো, যদি প্রাথমিক পর্যায়ে রোগ শনাক্ত করা যায় এবং যথাযথ চিকিৎসা শুরু করা হয়, তাহলে এই রোগ সম্পূর্ণভাবে নিরাময়যোগ্য।
ক্যান্সার কেন হয়
আমাদের দেহ গঠিত হয়েছে ৭৫ থেকে ১০০ ট্রিলিয়ন কোষ দিয়ে। এই কোষগুলো নির্দিষ্ট নিয়মে বিভাজিত হয়ে বৃদ্ধি পায় এবং একটি নির্দিষ্ট সংখ্যা পর্যন্ত পৌঁছালে বৃদ্ধি থেমে যায়। এই বৃদ্ধির পেছনে কাজ করে ক্রোমোজোমে থাকা জিন। কিন্তু কোনো কারণে যদি কোষ এই নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে এবং অনিয়ন্ত্রিতভাবে বাড়তে থাকে, তখন তা ক্যান্সার সৃষ্টি করে। এই অনিয়ন্ত্রিত কোষ সাধারণত শরীরের কোনো কাজেই আসে না বরং সেগুলো স্বাভাবিক কোষের কাজে বাধা সৃষ্টি করে। জিন অকেজো হয়ে যাওয়ার জন্য অনেক সময় জন্মগত দুর্বলতা দায়ী হলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে দায়ী পরিবেশগত ক্ষতিকর উপাদান।
ফুসফুসের ক্যান্সারের কারণ কি কি
ফুসফুসের ক্যান্সারের সবচেয়ে বড় কারণ হলো ধূমপান। ধূমপানের ধোঁয়ায় প্রায় ৪০০০ ধরনের রাসায়নিক পদার্থ থাকে, যার মধ্যে অন্তত ৬০টি সরাসরি ক্যান্সারের সঙ্গে সম্পৃক্ত। ধূমপানের পরে দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ কারণ হলো দূষিত বায়ু। কল-কারখানা, যানবাহনের ধোঁয়া, গাছপালা নিধন, জলাশয় ভরাট এবং অতিরিক্ত জনঘনত্ব পরিবেশ দূষণের অন্যতম উৎস। এই দূষণে থাকা অতিক্ষুদ্র কণা ও গ্যাসীয় পদার্থ ফুসফুসের ক্ষতি করে এবং ক্যান্সার সৃষ্টি করতে পারে।
ফুসফুস ক্যান্সারের লক্ষণ কি কি
ফুসফুসের ক্যান্সারের বেশকিছু লক্ষণ থাকে যা রোগের উপস্থিতি সম্পর্কে ইঙ্গিত দিতে পারে। দীর্ঘস্থায়ী কাশি, যা সাধারণ ওষুধে সারে না এবং কখনো কখনো রক্তসহ দেখা যায়, তা ফুসফুস ক্যান্সারের অন্যতম প্রধান উপসর্গ। যদি তিন সপ্তাহের বেশি সময় ধরে কাশি থাকে, তাহলে তা গুরুত্বসহকারে দেখা উচিত। বুকে একদিকে ব্যথা থাকা এবং শ্বাস নিতে গেলে ব্যথা বেড়ে যাওয়া, হালকা থেকে মাঝারি জ্বর যা রাতে বেশি হয় এবং দীর্ঘস্থায়ী শ্বাসকষ্ট- এই উপসর্গগুলোও ফুসফুস ক্যান্সারের ইঙ্গিত হতে পারে। কখনো কখনো ফুসফুসের বাইরে ক্যান্সার ছড়িয়ে পড়লে অন্যান্য অঙ্গের সমস্যাও দেখা দেয়, যেমন মস্তিষ্কে ছড়ালে মাথাব্যথা বা মেরুদণ্ডে ছড়ালে পিঠব্যথা। আবার কিছু ক্যান্সার কোষ হরমোন জাতীয় পদার্থ নিঃসরণ করে যা শরীরে ক্যালসিয়াম বাড়িয়ে দেয় এবং হাড় দুর্বল হয়ে যায়। রক্তশূন্যতা, ক্ষুধামন্দা এবং দুর্বলতাও ক্যান্সারের সাধারণ লক্ষণ হিসেবে বিবেচিত হয়।
ক্যান্সার সন্দেহ হলে কি করণীয়
ফুসফুসে ক্যান্সার সন্দেহ হলে রোগ নির্ণয়ের প্রথম ধাপ হলো বুকের সিটিস্ক্যান। যদি সেখানে সন্দেহজনক কিছু দেখা যায়, তাহলে প্রয়োজন হয় টিস্যু সংগ্রহ করে মাইক্রোস্কোপে পরীক্ষা করা, যাকে বলা হয় বায়োপ্সি ও হিস্টোপ্যাথলজি। কখনো কখনো ক্যান্সারের ধরন নিশ্চিত করার জন্য ইমিউনো-হিস্টোকেমিস্ট্রি নামক বিশেষ পরীক্ষা প্রয়োজন হয়। যদি টিউমার ফুসফুসের কেন্দ্রের দিকে থাকে, তাহলে ব্রঙ্কোস্কোপি করে সহজেই টিস্যু সংগ্রহ করা যায়। রোগ শনাক্ত হওয়ার পর দ্বিতীয় ধাপ হলো ক্যান্সার শরীরে কতটা বিস্তৃত হয়েছে তা নির্ধারণ করা। এই বিস্তৃতির ভিত্তিতে ক্যান্সারকে চারটি স্তরে ভাগ করা হয়। স্টেজ ১ এবং ২ বোঝায় যে ক্যান্সার ছোট আকারের এবং কেবল ফুসফুস বা তার কাছাকাছি লসিকা গ্রন্থিতে সীমাবদ্ধ। স্টেজ ৩ বোঝায় বড় আকারের টিউমার অথবা দূরবর্তী লসিকা গ্রন্থিতে বিস্তার। আর স্টেজ ৪ বোঝায় ক্যান্সার শরীরের অন্য অঙ্গেও ছড়িয়ে পড়েছে।
ফুসফুস ক্যান্সারের চিকিৎসা কি
ফুসফুস ক্যান্সারের চিকিৎসায় ব্যবহৃত পদ্ধতিগুলোর মধ্যে রয়েছে সার্জারি, কেমোথেরাপি, রেডিওথেরাপি, টার্গেটেড থেরাপি ও ইমিউনোথেরাপি। তবে সব ধরনের চিকিৎসার কার্যকারিতা নির্ভর করে ক্যান্সারের স্টেজ ও রোগীর শারীরিক অবস্থার ওপর। প্রাথমিক পর্যায়ে রোগ ধরা পড়লে অর্থাৎ স্টেজ ১ বা ২ এ থাকলে অপারেশনের মাধ্যমে রোগীকে পুরোপুরি নিরাময় করা সম্ভব এবং রোগী একটি স্বাভাবিক জীবন ফিরে পেতে পারেন।
কোথায় অপারেশন করাবেন
বর্তমানে দেশে অত্যাধুনিক চিকিৎসার ব্যবস্থা রয়েছে এবং অভিজ্ঞ থোরাসিক সার্জনরা রয়েছেন। বিশেষ করে ঢাকা ও চট্টগ্রামের এভারকেয়ার হসপিটালে আন্তর্জাতিক মানের ক্যান্সার সার্জারি হচ্ছে নিয়মিত। বুকের অপারেশন নিয়ে একসময় সাধারণ মানুষের মাঝে ভয় থাকলেও আধুনিক যন্ত্রপাতি, নিরাপদ অ্যানেসথেসিয়া এবং অভিজ্ঞ সার্জনের কারণে এখন এই অপারেশন অনেক নিরাপদ, স্বাভাবিক এবং তুলনামূলকভাবে খরচও কম। তবে মনে রাখতে হবে, ফুসফুস ক্যান্সারের অপারেশন একটি প্রক্রিয়া যেখানে বিশেষ দক্ষতা প্রয়োজন হয়। শুধু টিউমার অপসারণ করলেই হয় না, ক্যান্সারের সম্ভাব্য বিস্তার রোধে নির্দিষ্ট লসিকা গ্রন্থিগুলোকেও (যেমন, স্টেশন- ২, ৩, ৪, ৫, ৬, ৭ ইত্যাদি) অপসারণ করতে হয়। একজন দক্ষ থোরাসিক সার্জনই কেবল এই বিষয়গুলি ভালোভাবে অনুধাবন করে যথাযথভাবে অপারেশন করতে পারেন। যারা ধূমপায়ী, অতীতে ধূমপায়ী ছিলেন, পরিবারে ক্যান্সারের ইতিহাস আছে অথবা কল-কারখানায় কাজ করেন, তাদের বছরে অন্তত একবার লো-ডোজ সিটিস্ক্যান করানো উচিত। এই স্ক্যানের রেডিয়েশনের মাত্রা কম হলেও এটি প্রাথমিক পর্যায়ে ফুসফুসের অসুস্থতা শনাক্ত করতে সাহায্য করে। ফুসফুস ক্যান্সার ভয়াবহ হলেও সচেতনতা ও সময়মতো চিকিৎসার মাধ্যমে এটি নিয়ন্ত্রণ ও নিরাময় সম্ভব। প্রাথমিক পর্যায়ে উপসর্গ তেমন স্পষ্ট না হলেও, দীর্ঘস্থায়ী কাশি, রক্তসহ কাশি, বুকে ব্যথা, শ্বাসকষ্ট দেখা দিলে অবহেলা না করে দ্রুত বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া জরুরি। সময়মতো সঠিক সিদ্ধান্তই হতে পারে জীবন বাঁচানোর চাবিকাঠি।

লেখক : অধ্যাপক, সিনিয়র কনসালটেন্ট ও কো-অর্ডিনেটর, থোরাসিক সার্জারি ডিপার্টমেন্ট, এভারকেয়ার হসপিটাল, ঢাকা  

 

 

প্যানেল/মো.

×