
গত ৯ জুলাই একটি প্রোগ্রামে নাস্তায় অন্যান্য ফুড আইটেমের সঙ্গে আপেলও খেতে দেওয়া হয় আমাদের। কিন্তু আমি আপেলটি অফিসে নিয়ে আসি এবং টেবিলে রেখে দিই। আজ ১১ দিন অতিবাহিত হলেও আপেলটি সেইভাবে আছে এবং একটুও নরম হয়নি। তাহলে বুঝেন কি শক্তিশালী আপেল আমরা বাজার থেকে কিনে খাই! যা রীতিমতো ভয়ানক। আসলে আমরা বাজার থেকে ফল কিনে খাই না, খাই বিষ। অসাধু ব্যবসায়ীরা ভেজাল বা ফলে রাসায়নিক মেশায় যা মানবদেহের জন্য চরম হুমকি। এভাবে আমাদের সন্তানকে ফলের পরিবর্তে বিষ খাওয়াই। আমাদের বাজার মনিটরিং এতটা দুর্বল! যা অসৎ এবং অসাধু ব্যবসায়ীদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। এসব দুর্বলতার কারণে বাজারে সিন্ডিকেট গড়ে ওঠে এবং নানা ধান্দাবাজ সমাজে তৈরি হয়।
গত ২২ মার্চে বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশনের (বিএসটিআই) কর্তৃক পরিচালিত কয়েকটি অভিযানে বাজারে আমদানিনিষিদ্ধ, নকল, ভেজাল প্রসাধনী ও স্কিনকেয়ার পণ্য ধরা পড়ে। নিয়মিতভাবে এ ধরনের পণ্যের বিক্রি, বিপণন ও বিতরণ রোধে সংস্থাটির অভিযান চালানো খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বাজারে আমদানি বা বিপণন করা কসমেটিকস ও স্কিনকেয়ার পণ্যের অর্ধেকই ভেজাল ও নকল বলে অভিযোগ রয়েছে, যা জনস্বাস্থ্যের জন্য বড় হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। আবার অনেক ক্ষেত্রে এই অভিযোগ সত্য হিসেবে প্রমাণ হয়েছে। কিন্তু কঠোর বিচার হয় না। তাই এসব অপরাধের প্রবণতা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে।
ভেজাল ও গুণমানহীন বিদেশি কসমেটিকস বা প্রসাধনী, ফল জাতীয় পণ্য ও স্কিনকেয়ার পণ্য বিক্রির কারণে আমরা নানা ধরনের রোগে আক্রান্ত হচ্ছি। এমনকি অনেকে মরণব্যাধি ক্যান্সারের মতো রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। এসব পণ্য নিয়ে জনসচেতনতা বৃদ্ধির পাশাপাশি ভেজালকারী ব্যক্তিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির আওতায় আনা উচিত। গণমাধ্যমের সূত্র অনুযায়ী, সম্প্রতি বিএসটিআই আমদানি করা ৩৪টি পণ্য পরীক্ষা করে দেখতে পায় যে এসব পণ্যের ১৭টিই ভেজাল ও মানহীন। এক সময় করোনায় যখন বিশ্ব এক মহামারি ও অস্থির সময় অতিক্রম করেছিল, সেখানে বাংলাদেশের কিছু অসাধু ব্যবসায়ী ভুয়া মাস্ক ও হ্যান্ড স্যানিটাইজার বিক্রি করে ব্যবসা করেছিল। করোনাকালেও নকল বা ভেজাল ওষুধ বিক্রি করা বন্ধ হয়নি। বরং নকল মাস্ক, হ্যান্ড স্যানিটাইজার এবং নকল ওষুধের ব্যবসা রমরমা। করোনায় ওদের বিবেক জাগ্রত হয়েছিল না। খুবই দুঃখ লাগে। যেখানে যায় সেখানে নকল, ভেজাল ও অবৈধ পণ্যের বিস্তার। সে কারণে সৎ ব্যবসায়ীরা বাজারে টিকে থাকতে পারছে না। মানুষের নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যসহ জীবন রক্ষাকারী ওষুধও নকল বিক্রি হচ্ছে।
এই চক্রের রয়েছে বিশাল নেটওয়ার্ক। তারা অনেক টাকা হাতিয়ে নিয়েছে এবং বিদেশে পাচার করছে। এসব নকল বা ভেজাল পণ্য কিনে আমাদের স্বাস্থ্যে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। দেশ-বিদেশের বিখ্যাত কোম্পানির প্রায় সব পণ্য নকল বাজারে পাওয়া যায়। শপিং মল, ফুটপাত এবং ছোটখাটো সব বাজারে এসব নকল পণ্য বিক্রি হচ্ছে সস্তা দামে। নানা কৌশলে এসব পণ্য বিক্রি হচ্ছে, যা আমাদের মতো সাধারণ ক্রেতার পক্ষে যাচাই করা কঠিন। এতে শুধু আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি না, বরং সরকার রাজস্ব আয় থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
পুরান ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় অবৈধ কারখানায় তৈরি হচ্ছে নামি-দামি ব্র্যান্ডের নকল পণ্য। কিছু অসাধু ও ধান্দাবাজ লোক বিদেশ থেকে দামি ব্র্যান্ডের পণ্যের প্যাকেট দেশে নিয়ে আসে। এরপর ওই প্যাকেটে নকল পণ্য ঢুকিয়ে তা বাজারে বিক্রি করছে। নকল ও ভেজাল পণ্যের উৎপাদন ও বাজারজাতকরণ বন্ধ করতে দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কাজ করছে এবং অনেক অভিযানে পণ্য আটক হচ্ছে। অভিযুক্তরা গ্রেপ্তার হলেও নকল পণ্যের উৎপাদন ও সরবরাহ বন্ধ করা যাচ্ছে না। নকল ও অবৈধভাবে পণ্য যেসব বাজারে বিক্রি হচ্ছে এর মধ্যে প্রসাধনী, ওষুধ, সিগারেট, মোবাইল ফোনসেট ও ইলেকট্রনিক ডিভাইস উল্লেখযোগ্য।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তথ্য অনুসারে, ১৫টি চক্র বছরে অন্তত ১০ কোটি টাকার নকল ওষুধ বাজারজাত করছে। ২০২৪ সালের জুনে রাজধানীর বাবুবাজার থেকে ৩০ লাখ টাকা মূল্যমানের নিবন্ধনহীন নকল ওষুধ জব্দ করেছে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর। এছাড়াও এক প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০১৯ সালে প্রায় ৩২ কোটি টাকা মূল্যের নকল ওষুধ জব্দ এবং উচ্চ আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী প্রায় ৪৭ কোটি টাকা মূল্যের মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ ধ্বংস করা হয়। আমরা সাধারণ ক্রেতারা কোথায় যাব এবং কাকে বিশ্বাস করব। বিভিন্ন ইস্যুতে প্রিয়জনকে উপহার দিতে গিয়ে দিচ্ছি বিষ বা ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ। হাত বাড়ালেই মিলছে নকল আর ভেজাল প্রসাধনী।
বিভিন্ন স্বাস্থ্য সুরক্ষাসামগ্রীর দাম অনেক ক্ষেত্রে লাগামহীন। এর মধ্যে বহু সুরক্ষাসামগ্রীর মানও খারাপ। অতীতে সংবাদপত্রে দেখতে পেয়েছি, কেউ কেউ হাসপাতালে ব্যবহারের পর ফেলে দেওয়া গ্লাভস, মাস্কসহ অন্যান্য সামগ্রী সংগ্রহ করে তা রিসাইকল করে আবার বাজারে বিক্রি করছে করোনার সময়। এছাড়া এসব স্বাস্থ্যসামগ্রীর চাহিদা বৃদ্ধি পেলে একদল অসাধু ব্যবসায়ী এসবের মূল্যবৃদ্ধি ও বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে। সংশ্লিষ্টদের পরামর্শ, স্বাস্থ্য সুরক্ষাসামগ্রীর দাম ও মান নিয়ে ব্যাপক আইনি মনিটরিং দরকার। অন্যথায় পরিস্থিতি আরও মারাত্মক আকার ধারণ করবে।
১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনের ২৫ (গ)-এর ১(ঙ) ধারায় খাদ্যে ভেজাল, ওষুধে ভেজাল মেশালে বা ভেজাল খাদ্য ও ওষুধ বিক্রি করলে বা বিক্রির জন্য প্রদর্শন করার অপরাধ প্রমাণ হলে মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে। তবে এই আইনের প্রয়োগ নেই বললেই চলে। কিন্তু আইনে কিছু মামলা হলেও শাস্তির নজির আমাদের চোখে পড়ছে না। বর্তমানে নকল ও ভেজাল পণ্য রোধে বিশুদ্ধ খাদ্য অধ্যাদেশ ও বিএসটিআই অর্ডিন্যান্স অনুযায়ী ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হয়। বিএসটিআই আইন-১৯৮৫ সংশোধন করে ২০১৮ সালে নতুন আইন করা হয়। নতুন আইনেও জরিমানা দুই লাখ টাকা এবং সাজার মেয়াদ সর্বোচ্চ দুই বছর নির্ণয় করা হয়। আইনে দুই লাখ টাকা জরিমানা তেমন কিছুই মনে করছে না অসাধু ব্যবসায়ীরা। এটা এক ধরনের দুর্বলতা। আইনের এই দুর্বলতা দূর করা দরকার। আইনটি হওয়া উচিত জামিন অযোগ্য। কারণ অপরাধীরা অপরাধ করে জামিন পেয়ে যায়। নতুন আইন না হওয়া পর্যন্ত প্রচলিত আইনের কঠোর প্রয়োগে নকল ও ভেজাল পণ্য রোধে ভূমিকা সরকার রাখতে পারে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, নকল বা ভেজাল পণ্য উৎপাদন ও বাজারজাত বন্ধ করতে না পারলে দেশের আর্থিক ক্ষতি ও স্বাস্থ্যঝুঁকিও তীব্র আকারে বাড়বে। নকল বা ভেজাল পণ্যে সরকারের আর্থিক ক্ষতি হাজার হাজার কোটি টাকা। তাই সরকারকে যেভাবেই হোক এসব বন্ধে যুগান্তকারী পদক্ষেপ নিতে হবে। শুধু পদক্ষেপ নিলে হবে না, তা সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে। নকল পণ্য রোধে সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। নকল পণ্যের বিষয়ে সাধারণ ভোক্তা বা নাগরিককে সচেতন করতে হবে, যাতে তাঁরা ক্রয়ের সময় অধিকতর সতর্ক থাকে। সচেতনতা তৈরি হলে ভোক্তা নিজেই নকল পণ্য ক্রয় থেকে বিরত থাকবে। নকল পণ্য ঠেকাতে সরকার এবং আমাদের সবাইকে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। নকল পণ্য এক ধরনের নীরব ঘাতক এবং শিশুদের চরম ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিচ্ছে। ছোট থেকে ভেজাল জিনিস খেতে হচ্ছে, যা তাঁদের মানসিক ও শারীরিক বিকাশে সমস্যা সৃষ্টি করছে। প্রয়োজনে আরও কঠোর আইন করে হলেও সমাজের এই নীরব ব্যাধি বন্ধ করতে হবে। নকল বা ভেজালবিরোধী কার্যক্রমে উল্লেখযোগ্য ভূমিকার জন্য বিভিন্ন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে পুরস্কার ও সম্মাননা দেওয়া যেতে পারে, যা নকল পণ্য রোধে কার্যকর হবে। নকল পণ্য বন্ধে সরকারের ওপর শুধু দায়িত্ব দিলে হবে না। বড় শিল্প প্রতিষ্ঠানের উচিত নকল প্রতিরোধে নিজস্ব সক্ষমতা বাড়ানো ও নিজস্ব টিম তৈরি করা। নকল ও ভেজাল পণ্য রোধ করা আমাদের জন্য চ্যালেঞ্জ। তবে সরকারকে এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে সাধারণ জনগণের প্রত্যাশা পূরণ করবে এটাই আমাদের কামনা। সরকার খুবই তৎপর হলে এখানেও সফলতা আসবে।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, হিসাববিজ্ঞান ও তথ্য পদ্ধতি বিভাগ, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ
প্যানেল/মো.