
পাহাড়িকন্যা সোমেশ্বরী। লাল সিলিকন বালু বাংলাদেশ ও ভারতের আন্তঃসীমান্ত নদীটিকে করেছে মায়াবী; অপরূপ সৌন্দর্যের লীলাভূমি। এই নদীতে সারা বছর নৌকা চলত, মাছ পাওয়া যেত, পানি টলটল করত। কিন্তু এখন বর্ষাকালের দুই-তিন মাস ছাড়া অন্য সময়ে পানি থাকে না। অপরিকল্পিত বালু উত্তোলনই সর্বনাশ ডেকে এনেছে সোমেশ্বরী নদীর। শুধু সোমেশ্বরী নয়; বালু উত্তোলন, দখল-দূষণ, অপ্রতুল বৃষ্টি, টানা তাপপ্রবাহ নানা কারণে দেশের নদীগুলো ক্রমাগত শুকিয়ে যাচ্ছে। অনেক নদ-নদী আবার দৈর্ঘ্য ও প্রস্থে সংকুচিত হয়ে এসেছে। কিছু নদী এতটাই শুকিয়ে গেছে যে, সেগুলো নৌচলাচলের অযোগ্য হয়ে পড়েছে। দেশে এ রকম ৭৯টি নদী শুষ্ক মৌসুমে প্রায় পুরোপুরি শুকিয়ে যায় বলে রিভার অ্যান্ড ডেল্টা রিসার্চ সেন্টারের (আরডিআরসি) গবেষণায় উঠে এসেছে।
বাংলার নদীর দখল-দূষণ নিয়ে কম সম্পাদকীয় লেখেনি জনকণ্ঠ। নানা সুপারিশ এবং পরামর্শ দিয়েছে। যাদের অপরিণামদর্শিতার কারণে নদীগুলো তার যৌবন হারাচ্ছে, মৃতপ্রায় হয়ে পড়েছে, তাদের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের তাগিদ দিয়েছে। পরিতাপের বিষয় হলো, গণমাধ্যম বারবার সতর্ক করা সত্ত্বেও সজাগ হয়নি কর্তৃপক্ষ। বরং অসাধু চক্রের নদী দখল এবং অবৈধভাবে বালু উত্তোলনের মুনাফার ভাগ নিয়েছে। সার্বিক অনৈতিকতার ফলে আজ বাংলার নদীগুলো বিপন্নপ্রায়। রিভার অ্যান্ড ডেল্টা রিসার্চ সেন্টারের (আরডিআরসি) গবেষণায় পানি প্রবাহের অভাবে নদীসমূহের মুমূর্ষু দশা সম্পর্কে যে চিত্র উঠে এসেছে, তা অত্যন্ত উদ্বেগজনক।
‘বাংলাদেশের শুকিয়ে যাওয়া নদী’-শিরোনামে সংস্থাটির এক গবেষণায় বলা হয়েছে, দেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত সরকারি তালিকাভুক্ত ১ হাজার ১৫৬টি নদীর মধ্যে অন্তত ৭৯টি শুকিয়ে গেছে অথবা শুকিয়ে যাওয়ার পথে। জলবায়ু সংকট বৈশ্বিক আবহাওয়াকে দিন দিন বৈরী করে তুলেছে। এ কারণে শুধু নদ-নদীই নয়, এগুলোর ওপর নির্ভর করে জীবিকা নির্বাহ করা মানুষের ওপরও বিরূপ প্রভাব পড়ছে। কৃষিকাজ, জীববৈচিত্র্য, প্রাণপ্রকৃতি, জ্বালানি উৎপাদন কিংবা নদীকেন্দ্রিক পণ্য পরিবহনও এখন পড়েছে হুমকিতে।
আমরা মনে করি, সরকারকে অবিলম্বে এসব নদীর দিকে মনোযোগ দিতে হবে এবং নৌপরিবহনকে উৎসাহিত করতে হবে। গবেষণা অনুসারে, দেশে প্রায় ২৪ হাজার কিলোমিটার দীর্ঘ নদী, খাল ও স্রোতধারা রয়েছে। বর্ষাকালে এর মধ্যে প্রায় ৬ হাজার কিলোমিটার নৌচলাচলের উপযোগী থাকে। শুষ্ক মৌসুমে এই সংখ্যা নেমে আসে ৩ হাজার ৮০০ কিলোমিটারে। সড়কপথ ব্যবহারে প্রতি টন কিলোমিটারে ২.৮১-৩.৫১ টাকা এবং রেলপথে ১.৯৬ টাকা খরচ হয়। অথচ জলপথে খরচ হয় মাত্র ১.১২ টাকা। এ বিষয়ে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক মন্ত্রণালয় এবং পানিসম্পদ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান যথার্থই বলেছেন, কিছু নদী প্রাকৃতিক কারণে শুকিয়ে যায়, কিছু মানুষের কার্যকলাপের কারণে শুকিয়ে গেছে। কোনো পদক্ষেপ নেওয়ার আগে, প্রতিটি নদীর শুকিয়ে যাওয়ার কারণ নির্ধারণ করতে হবে। অন্তর্বর্তী সরকার নদী উদ্ধারের যে উদ্যোগ নিয়েছে তা আরও গতি পাক। একইসঙ্গে দখল-দূষণের জন্য দায়ী ব্যক্তিদের অবিলম্বে কঠোর আইনের আওতায় নিয়ে আসা হোক।
প্যানেল/মো.