
অধিকার আর মূল্যবোধ সমার্থক নয়। তার পরেও সমন্বয় আর অবিচ্ছেদ্য বিষয় হিসেবে অস্বীকার করার কোনো পথ নেই। অধিকার রাষ্ট্র কর্তৃক প্রদত্তই শুধু নয় নিত্য জীবনের অতি প্রাসঙ্গিক হিসেবে বিবেচ্য হওয়া ও ন্যায্যতা দাবি করে। অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য- এই পাঁচটি মৌলিক অধিকার জনগণের নিত্য চাহিদারও প্রত্যয় হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে সেই পুরাকাল থেকে। জীবনযাপনের জন্য প্রথম সংস্থানের মধ্যে থাকে আহার সামগ্রী। অতি আদিম প্রাচীন সমাজ থেকেই। আদিম সমাজ দেখার সৌভাগ্য অনেকেরই হয়নি। তবে মাতৃজঠর থেকে শিশু পৃথিবীর আলো দেখার বিষয়টি মা থেকে প্রতিটি পরিবারই উপলব্ধি করেন। কাঁদতে কাঁদতে কোনো শিশু যখন জন্ম নেয় তখন মায়ের সযত্ন আদরই শুধু নয়- কান্না থামে যখন সদ্যজাত সন্তানকে মুখে কিছু দেওয়া হয়। সেই আদিম, অসভ্য, বর্বর যুগ থেকে এখন আমরা শিল্প প্রযুক্তির উন্নত বিশ্বের মধ্যগগনে অবস্থান করছি। আর সবার আগে অন্নের জোগান দেওয়া মনে হয় আজও মুখ্য বার্তা বয়ে বেড়াচ্ছে। সময়ের হেরফেরে পরিবর্তন, পরিবর্ধন আর যৌক্তিক পালাক্রমেও তেমন নিরেট বাস্তবতা আজও নাড়া দিয়ে যাচ্ছে। মানব সভ্যতা যতই এগিয়েছে প্রাপ্য অধিকারও নতুন সময়ের অনুষঙ্গ হয়েছে। তেমন ক্রমপ্রসারণে আচার, ব্যবহার আর শিষ্টাচারের মাত্রায় এসেছে মূল্যবোধ যা পারিপার্শ্বিক আর অন্তরের নিভৃত চেতনা থেকে সমৃদ্ধ হয়ে স্বজাত্যবোধ, মূল্যবোধকে আধুনিক সময়ের অনুষঙ্গ করেছে। সেখানে শুধু বংশগত ঐতিহ্যই নয় জাতিগত, সম্প্রদায়গত অবস্থান আরও বেগবান দৃঢ় বন্ধনে আটকে দিয়েছে। অধিকার বিভিন্নভাবে মূল্যবোধকে চালিত করা সময় ও নিয়মের অধীন। মানব সমাজ, অধিকার আর মূল্যবোধ বিষয়গুলো বৃহত্তর সামাজিক অঙ্গনের বন্ধনকে ত্বরান্বিত করে। এখন বিশ্বায়নের যুগে তা দ্রুততার সঙ্গে জগৎজোড়া সম্পর্কের ভিত্তি তৈরি করে যাচ্ছে।
বদলে যাওয়া আধুনিক ও নতুন বাংলাদেশ সময়ের গতি প্রবাহে হরেক ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ পথ পাড়ি দিয়ে নবতর নিশানায় আপন গন্তব্যে চলমান থাকাও পরিস্থিতির অপরিহার্যতা। ষোলো বছরের দীর্ঘ অপশাসনে কত অবাঞ্ছিত বিষয় গণমানুষকে তাড়া করেছে। স্বস্তি আর শান্তির বার্তায় কোানাভাবেই অতি সাধারণ মানুষের জীবন নির্বিঘ্ন, নিরাপদ ছিলই না। পদে পদে লঙ্ঘিত হয়েছে মানবাধিকার, মানবিক মূল্যবোধের চরম স্খলন। দীর্ঘ শাসনের একাধিপত্য আর একনায়কত্বে ক্ষমতার বেদখলই শুধু নয় স্বেচ্ছাচারিতাও স্খলনের প্রান্তসীমায় গিয়ে ঠেকে। দীর্ঘ শাসন কখনোই জাতি আর শাসকবর্গের জন্য মঙ্গলজনক হয়ই না। ক্ষমতার দাপট তার অপছায়া নৈরাজ্যকে আলিঙ্গন করে। সেটা শুধু অত্যাধুনিক উন্নত শিল্প প্রযুক্তির জন্যই হয়েছে তা কিন্তু নয়। ক্ষমতা বরাবরই স্বৈরশাসনের এক অঘোষিত অস্ত্র যা কি না প্রভাবশালী শাসকদের মারণাস্ত্র বললেও বেশি বলা হয় না। বিশ্ব ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় যুগে যুগে তা প্রমাণও হয়েছে।
ষোড়শ শতাব্দীতে আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানের জনক ম্যুাকিয়াভেলি তার দূরদর্শী রাষ্ট্রতত্ত্ব বোধে উচ্চারণ করেছিলেন- সকল ক্ষমতাই মানুষকে বিকৃত করে। চরম ক্ষমতা মানুষকে চরমভাবে স্বৈরাচারী করতে নির্ণায়কের ভূমিকায় নামে। ক্ষমতা এমন এক মোহময় শক্তি যাতে শাসকবর্গের মোহভঙ্গ হতেও দীর্ঘ সময় পার হয়ে যায়। ভারত উপমহাদেশ থেকে অতি ক্ষুদ্র বাংলাদেশ ও হরেক শাসনামলে বিভিন্ন রাজবংশের উত্থান-পতনের শিকার হয়েছে। তবে ক্ষুদ্র বাংলাদেশের স্বাধীন সত্তার ইতিহাস বর্ণিত হলেও উর্বর পলিমাটির বরেন্দ্র অঞ্চলের বিভিন্ন রাজা-বাদশাহদের একাধিপত্য থেকে মুক্তি না পাওয়া ও ইতিহাসের চরম অনিশ্চয়তা। ২৪ বছরের পাকিস্তানি শাসন থেকে মুক্ত হয়ে যে স্বাধীন বাংলাদেশের গোড়াপত্তন হয় সেখানেও স্বৈরাশাসনের নবতর অভিগমন ঐতিহাসিক পালাক্রমের বিবর্ণ অধ্যায়। আমাদের উর্বর পলিমাটির এই বরেন্দ্র বঙ্গভূমির নিত্যনতুন ইতিহাসও আধুনিক কোনো দিকনির্দেশনা দিতে ব্যর্থ হয়। গণতন্ত্র যে জনগণের দ্বারা, জনগণের জন্য এবং যথার্থ আম জনতার নিজস্ব ভিত্তি আর শক্তি সেটাও পরম্পরায় অবদমিত থাকে ঐতিহাসিক রূপান্তরের বিবর্ণ অধ্যায়। ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে রাষ্ট্র নায়করা একবার নির্বাচিত হতে পারলে আর পেছন ফিরে তাকান না পর্যন্ত। যতক্ষণ না তাদের গণআন্দোলন কিংবা অভ্যুত্থানের মাধ্যমে মসনদচ্যুত করা হয়েছে। মসনদই বটে! রাজা-বাদশাহ্্র মতো বংশানুক্রমিকভাবে ক্ষমতাকে মুষ্টিবদ্ধ করে জনগণ থেকে শুধু বিচ্ছিন্নই নয় বরং অধিকার, ন্যায্যতা, প্রাপ্যতা থেকে বঞ্চনার ক্রমাগত আর করুণ ইতিবৃত্ত জনগণকে বেপারোয়া করতেও পিছু হটাইনি। সাধারণ মানুষ এমন এক গণশক্তি যারা অস্ত্র নয় দেশপ্রেমের অবিশ্রান্ত জোয়ারে ভেসে চলা এক নিরবচ্ছিন্ন ধাবমান সামুদ্রিক ঢেউ বললেও কম বলা হয়। তেমন জোয়ারে স্বৈরশাসনের পতনোন্মুখ রাজ সিংহাসনও ধুলায় লুণ্ঠিত হয়ে দেশ ও জনরোষের ভীত হয়ে পলায়নবৃত্তি মেনে নেয়। দুঃশাসন নিজেই এক পলাতক, ভীরু, অপরিণামদর্শিতার চরম আস্ফালন। যার কাঁপন ধরা অপশক্তি জাতি ও জনগণকে সাময়িক বেকায়দায় ফেললেও ঘুরে দাঁড়ানোর অজেয় শক্তিমত্তাও যেন জেগে ওঠে। যা যুগ ও সময়ের দুরন্ত গতিবেগের এক নির্মোহ আবেগই নয় বরং ভেতরের বোধে জিইয়ে থাকা যথার্থ দেশাত্মবোধের অনির্বাণ দীপ্তি।
আমরা এখন উদ্দীপ্ত জুলাইয়ের পরম বৈপ্লবিক সময়কে আলিঙ্গন করছি। অপরাজেয় স্রোতশক্তির পরম বরমাল্যে ছুটে চলা অস্ট্রিক জাতিগোষ্ঠীর লড়াকু বিজয় গাঁথার অমূল্য সম্ভার। মানবাধিকার জনগণের পরম শক্তি আর আপন শৌর্যে এগিয়ে যাওয়ার অনন্য বরমাল্য। গণঅভ্যুত্থানের বছর পূর্তিতেই ঢাকায় মানবাধিকার কার্যালয়ের দ্বার উন্মোচন জাতির জন্য পরম সৌভাগ্য। আধুনিক ও বদলে যাওয়া নতুন বাংলাদেশের জন্য সামনে এগিয়ে চলার নবতর নিশানা তো বটেই। জুলাইয়ের রক্তঝরা অভিযাত্রায় নতুন বাংলাদেশের অভ্যুত্থান আর এক স্মরণীয় বরণীয় অধ্যায় সংযুক্ত হলো অপরাজেয়ও যুগ-যুগান্তরের স্বাধীন বঙ্গভূমির মানচিত্র। গৌরবময় অর্জনের এই যাত্রাপথ কখনো নিষ্টণ্টক কিংবা নিরাপদ থাকে না। নানামাত্রিক দাবি দাওয়া পরিস্থিতি বেসামাল করতে সময় নেবে না। তবে এই মুহূর্তে প্রয়োজন শান্তি-শৃঙ্খলা মেনে সামনে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য সুষম অবস্থা তৈরি করাই শুধু নয়, টিকিয়ে রাখাও বাঞ্ছনীয়। প্রতিকূল পরিস্থিতিতে অন্তর্বর্তী সরকার প্রতিষ্ঠা ও জরুরি ছিল অস্বীকার করার উপায়ই নেই। তবে ঠান্ডা মাথায় যৌক্তিক বিচার-বুদ্ধি, বিবেচনায় সামনে একটি সার্বজনীন নির্বাচনের প্রত্যাশা অনিবার্য। যার জন্য কিছু সময় তো লাগবেই। নির্বাচন পদ্ধতিও হরেক সংস্কার-অপসংস্কারের মান্ধাতা আমলের নানামাত্রিক বিপত্তিকে সামলানো আর এক অবশ্য পালনীয় কর্মযোগ। সেটা করতে গেলে সময়-সুযোগ অনিবার্য। তাড়াহুড়া করে পুরানো বিধিকে নির্মূল করা অত সহজসাধ্য নয়। অনেক অসহনীয় নিয়মকানুন সমাজ কাঠামোর অভ্যন্তরে গেঁথে আছে। যা যথার্থভাবে নির্মূল করতে ব্যর্থ হলে সময়ের নতুন বাংলাদেশ সামনে এগিয়ে যেতে হোঁচট খেতে পারে। তাই ভেতরের সমস্ত আবর্জনা উপড়ে ফেলে নতুন সময়ের বরমাল্যে আধুনিক ও যৌক্তিক বাংলাদেশ সামগ্রিক পরিস্থিতির অপরিহার্যতা।
প্যানেল/মো.