ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৮ মার্চ ২০২৫, ৪ চৈত্র ১৪৩১

বিচার বিভাগ সংস্কার ও সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল

খালিদ ইবনে আমিন

প্রকাশিত: ২০:১১, ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

বিচার বিভাগ সংস্কার ও সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল

স্বাধীন বিচার বিভাগীয় সচিবালয় প্রতিষ্ঠা করার মাধ্যমে দ্রুত বিচার প্রক্রিয়া সম্পন্ন, সর্বস্তরের আদালতে যোগ্য ও মেধাবী বিচারক নিয়োগে স্বচ্ছতা প্রতিষ্ঠার দাবি দীর্ঘদিনের। স্বাধীন বাংলাদেশে এ দাবি আইনজীবী ও অংশীজনসহ দেশবাসী সবার। জুলাই-আগস্ট বিপ্লবোত্তর নতুন বাংলাদেশে সরকার পরিবর্তনের পর রাষ্ট্রের ৬টি অঙ্গে সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হয়, যার মধ্যে বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন অন্যতম। পৃথক বিচার বিভাগীয় সচিবালয় প্রতিষ্ঠা, দেশের প্রান্তিক উপজেলা পর্যায়ে দেওয়ানি ও ফৌজদারি আদালত স্থাপন, বিভাগীয় শহরে হাইকোর্টের স্থায়ী বেঞ্চ গঠন, জেলা পর্যায়ে বাণিজ্যিক আদালত প্রতিষ্ঠা, স্থায়ী অ্যাটর্নি সার্ভিস গঠন অন্যতম। এ ছাড়া প্রধান বিচারপতি ছাড়া অন্য বিচারক নিয়োগে পৃথক কমিশন গঠনের প্রস্তাবও দেওয়া হয়েছে। জুলাই-আগস্ট বিপ্লবোত্তর, গত ৩ অক্টোবর আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি শাহ আবু নাঈম মোমিনুর রহমানকে প্রধান করে আট সদস্যের বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন গঠন করে অন্তর্বর্তী সরকার।
সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ যে মুহূর্তে ষোড়শ সংশোধনী বাতিল ঘোষণা করে সঙ্গে সঙ্গে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল বহাল হয়ে গেছে। ওই রায়ে বলা হয়েছে ১৬তম সংশোধনী বাতিল করা হলো। ফলে ১৫তম সংশোধনীতে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের যে বিধান ছিল, সেটা পুনর্বহাল হলো। সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল পুনর্বহাল হওয়ায় উচ্চ আদালত সম্পূর্ণ স্বাধীন। এখন বিচারপতিদের বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগ নিষ্পত্তির দ্বার উন্মোচিত। দেশবাসী তাদের অভিযোগ জানানোর একটি আইনি কর্তৃপক্ষ পেয়েছে। সকল অভিযোগের বিষয়ে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল তাদের মতো করে সিদ্ধান্ত নেবেন। এর মাধ্যমে বিচার বিভাগ রাজনীতির দুর্বৃত্তায়ন থেকে মুক্ত হবে। স্বাধীনভাবে দায়িত্ব পালনের একটা জায়গা পেয়েছে বিচার বিভাগ। সর্বোপরি, সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের ওপর ঐতিহাসিক গুরুদায়িত্ব অর্পিত হওয়ায় উচ্চ আদালতের ওপর মানুষের মনে আশার সঞ্চার হয়েছে।
বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন হাইকোর্টের বিকেন্দ্রীকরণের কথা বলেছে। যদিও আশির দশকে জেনারেল এরশাদ এক সামরিক ফরমানে হাইকোর্ট বিভাগের ছয়টি স্থায়ী বেঞ্চ ঢাকার বাইরে সিলেট, রংপুর, বরিশাল, চট্টগ্রাম, যশোর ও কুমিল্লা জেলায় স্থানান্তর করেন। কিন্তু ‘আনোয়ার হোসেন চৌধুরী বনাম বাংলাদেশ’ (১৯৮৯ BLD (Spl) ১) মামলায় হাইকোর্টের বিকেন্দ্রীকরণ বাতিল ঘোষণা করা হয়। বিচার বিভাগের বিকেন্দ্রীকরণ ও সম্প্রসারণ বিষয়ে কমিশনের প্রস্তাবনায় বলা হয়, প্রতিটি স্থায়ী বেঞ্চ কোন কোন এলাকা থেকে উদ্ভূত মামলা গ্রহণ করতে পারবে, তা সুনির্দিষ্ট করে দিতে হবে। তবে বিচারকাজ পরিচালনা এবং রায়, আদেশ, নির্দেশ ইত্যাদির ক্ষেত্রে হাইকোর্ট বিভাগের শতভাগ এখতিয়ারের পূর্ণাঙ্গতা থাকতে হবে। স্থায়ী বেঞ্চগুলো সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য আদালত ও সহায়ক কার্যালয়, বিচারক ও সহায়ক জনবলের জন্য নিরাপদ বাসস্থানসহ প্রয়োজনীয় অবকাঠামো স্থাপন ও বাজেট বরাদ্দ নিশ্চিত করা হবে। স্থায়ী বেঞ্চগুলো স্থাপনের কারণে দেশব্যাপী কর্তৃত্ব প্রয়োগের ক্ষেত্রে হাইকোর্ট বিভাগের এখতিয়ার কোনো ভৌগোলিক সীমারেখা দিয়ে বিভাজিত হবে না এবং রাষ্ট্রের একক চরিত্র অক্ষুণ্ন থাকবে। এর ফলে বিচারপ্রার্থী তাদের বাড়ির কাছাকাছি স্থায়ী বেঞ্চে মামলা করে আইনি সুবিধা পাবেন। সব স্থায়ী বেঞ্চ একই সঙ্গে কার্যকর করা কঠিন বিবেচিত হলে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে পর্যায়ক্রমে বিভাগীয় সদর দপ্তরগুলোতে স্থায়ী বেঞ্চ কার্যকর করার প্রস্তাব রয়েছে।
সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে প্রধান বিচারপতি নিয়োগ করার নিয়ম থাকলেও কখনো কখনো বিধি লঙ্ঘন করে রাজনৈতিক বিবেচনায় গত ৫৪ বছরে বিচারক নিয়োগ করা হয়েছে। এমনকি হাইকোর্ট বিভাগেও বিচারক নিয়োগে কখনো কখনো বিধি মানা হয়নি, রাজনৈতিক আনুগত্যই ছিল মুখ্য। মাসদার হোসেন মামলার রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে, বিচার বিভাগের পূর্ণাঙ্গ স্বাধীনতা নিশ্চিতকরণ এবং সর্বোপরি নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগের সম্পূর্ণ পৃথকীকরণে সুপ্রিম কোর্টের স্বতন্ত্র সচিবালয় স্থাপন করা প্রয়োজন। সেজন্য প্রণয়ন করতে হবে একটি স্বতন্ত্র আইন বা অধ্যাদেশ। প্রধান বিচারপতি ছাড়া অন্য বিচারকদের নিয়োগে স্বাধীন ও স্বতন্ত্র কমিশন গঠনের প্রস্তাব করা হয়েছে। দেশের উচ্চ আদালতের উভয় বিভাগে বিচারক নিয়োগের ক্ষেত্রে বর্তমানে প্রচলিত প্রধান বিচারপতির একক পরামর্শের পরিবর্তে একটি সম্মিলিত এবং প্রতিনিধিত্বশীল সুপারিশ পদ্ধতি প্রতিষ্ঠা করা ‘যৌক্তিক এবং বাঞ্ছনীয়’ বলে কমিশন মনে করে। সংস্কার কমিশনের সুপারিশ মানা হলে প্রধান বিচারপতি নিয়োগের প্রক্রিয়ায় রাষ্ট্রপতির কোনো স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতা থাকবে না বা নির্বাহী বিভাগের কোনো প্রভাব থাকবে না। এমনকি ক্ষমতাসীন দলও প্রধান বিচারপতি নিয়োগে খুব বেশি সুবিধা করতে পারবে না। খসড়া সুপারিশে জ্যেষ্ঠতম বিচারককে শীর্ষপদে রাখার প্রস্তাব করেছে কমিশন। ‘যথাসম্ভব স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় মেধা, সততা ও দক্ষতার মূল্যায়নকারী একটি স্বাধীন ও স্বতন্ত্র কমিশনের মাধ্যমে গ্রহণযোগ্য নিয়োগ-পদ্ধতি প্রবর্তন এবং কমিশনের সুপারিশের ভিত্তিতে সুপ্রিম কোর্টে বিচারপতি নিয়োগ করা প্রয়োজন। হাইকোর্ট বিভাগে অতিরিক্ত বিচারক ও স্থায়ী বিচারক এবং আপিল বিভাগের বিচারক নিয়োগে কমিশনের মতামতই প্রাধান্য পাবে।’ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, হাইকোর্টে বিচারক নিয়োগের ক্ষেত্রে ন্যূনতম বয়স ৪৮ বছর নির্ধারণের আলোকে কমিশন সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদ সংশোধন করে প্রধান বিচারপতি ও অন্যান্য বিচারকদের অবসরের বয়স ৭০ বছর পুনঃনির্ধারণ করার প্রস্তাব করেছে। যদিও তরুণ আইনজীবীরা এর বিরোধিতা করেছেন। তাদের যুক্তি হলো, বিচারকদের বয়স বাড়ালে তরুণ মেধাবী আইনজীবীদের যাত্রাপথ শ্লথ হবে।
এ নিয়োগে স্বচ্ছতা, দক্ষতা ও সততা নিশ্চিত করার জন্য যথাযথ পদ্ধতিসহ আনুষঙ্গিক বিষয়গুলো সুনির্দিষ্ট করতে একটি আইন প্রণয়ন এবং এ বিষয়ে সংবিধানে একটি নতুন অনুচ্ছেদ সংযুক্ত করার সুপারিশ করেছে কমিশন। আপিল বিভাগে বিচারক নিয়োগের ক্ষেত্রে নিয়োগ কমিশনের কার্যক্রমে স্বার্থের সংঘাত (ইন্টারেস্ট অব কনফ্লিক্ট) পরিহার করতে হাইকোর্ট বিভাগের দুজন বিচারক, অ্যাটর্নি জেনারেল, সুপ্রিম কোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি এবং সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবীকে সদস্য করা থেকে বিরত থাকার সুপারিশ করেছে কমিশন। এছাড়া সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠনের মাধ্যমে সুপ্রিম কোর্টের বিচারকদের পেশাগত জবাবদিহি ও শৃঙ্খলা বজায় রাখতে প্রস্তাব দিয়েছে এ কমিশন। পেশাগত অসদাচরণের জন্য বিচারপতি অপসারণ হবে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের মাধ্যমে।
উপজেলা সদরের ভৌগোলিক অবস্থান, জনসংখ্যার ঘনত্ব ও বিন্যাস, জেলা সদর থেকে দূরত্ব ও যাতায়াত ব্যবস্থা এবং মামলার চাপ বিবেচনা করে উপজেলায় আদালত স্থাপন করা। উপজেলা আদালতগুলোতে জ্যেষ্ঠ সহকারী জজ পর্যায়ের বিচারকদের পদায়ন করে তাদের দেওয়ানি ও ফৌজদারি- উভয় এখতিয়ার দিতে হবে। আইনগত সহায়তা কার্যক্রম ও বিকল্প  বিরোধ নিষ্পত্তির ব্যবস্থা, বিশেষত মধ্যস্থতা পদ্ধতি উপজেলা পর্যায় পর্যন্ত সম্প্রসারিত করতে হবে। যেসব স্থানে চৌকি আদালত রয়েছে, সেগুলো সচল রাখার প্রয়োজন আছে কি না, তা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে হবে।
বাণিজ্যিক বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য পৃথক বাণিজ্যিক আদালত স্থাপনে যথাযথ বিধানসংবলিত আইন প্রণয়ন করতে হবে এবং দেওয়ানি কার্যবিধিসহ অন্যান্য আইনের প্রয়োজনীয় সংশোধনী আনতে হবে। সালিশ আইন সংশোধন করে সালিশ-সংক্রান্ত বিষয়াদি (আন্তর্জাতিক বাণিজ্যিক সালিশ ছাড়া) বাণিজ্যিক আদালতের ওপর ন্যস্ত করা বাঞ্ছনীয়। বিচার বিভাগকে দুর্নীতিমুক্ত রাখতে কয়েকটি পদক্ষেপ জরুরিভাবে নেওয়া প্রয়োজন বলে প্রস্তাবনায় জোর দেওয়া হয়েছে। তিন বছর পরপর সুপ্রিম কোর্ট এবং অধস্তন আদালতের বিচারকদের সম্পত্তির বিবরণ সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে দিয়ে জনগণকে জানানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। জাতীয় আইনগত সহায়তা প্রদান সংস্থার বিদ্যমান সেবাগুলোর পরিধি বাড়িয়ে আইনি সহায়তার পাশাপাশি মীমাংসা ও মধ্যস্থতার মাধ্যমে মামলা ও বিরোধ নিষ্পত্তির ক্ষেত্র সৃষ্টি করে মধ্যস্থতার কার্যক্রমকে দেশে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। স্থায়ী ও স্বতন্ত্র সরকারি অ্যাটর্নি সার্ভিস গঠনের প্রস্তাব করা হয়েছে। রাজনৈতিক বিবেচনায় অস্থায়ীভাবে সরকারি আইন কর্মকর্তা নিয়োগের পরিবর্তে একটি স্থায়ী অ্যাটর্নি সার্ভিস প্রতিষ্ঠা প্রয়োজন। এই স্থায়ী অ্যাটর্নি সার্ভিস হবে একটি পেনশনযোগ্য স্থায়ী সরকারি। এ বিষয়ে সংবিধানে একটি নতুন অনুচ্ছেদ যুক্ত করার প্রস্তাব দিয়েছে কমিশন।
ইতিহাস অনুসন্ধানে জানা যায়, ভারতবর্ষে সর্বপ্রথম ১৭৯৩ সালে লর্ড কর্নওয়ালিস নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগ পৃথকীকরণের ধারণা দেন। তিনি মূলত দুটি প্রধান বিষয় তুলে ধরেছিলেন- বিচার বিভাগ নির্বাহী বিভাগ থেকে পৃথক করা এবং নির্বাহী বিভাগকে বিচার বিভাগের অধীন করা। ব্রিটিশ ও পাকিস্তান আমলে বাস্তবায়ন না হলেও স্বাধীন বাংলাদেশে সংবিধানের ২২ অনুচ্ছেদে রাষ্ট্রের নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগের পৃথকীকরণের বিষয়ে বলা হলেও তা বাস্তবায়ন সম্ভব হয় সুপ্রিম কোর্টের হস্তক্ষেপ ‘(সচিব, অর্থ মন্ত্রণালয় বনাম মাসদার হোসেন এবং অন্যান্য (৫২ DLR (AD)৮২) মামলার রায়ে। প্রাচীন ভারতবর্ষের এ অঞ্চলে ঐতিহাসিক বিচার কাঠামোর সঙ্গে ব্রিটিশ বিচার ব্যবস্থার মিশেলে তৈরি হয়েছে আজকের আধুনিক বাংলাদেশের বিচারিক ব্যবস্থা। সময়ের হাত ধরে বাংলাদেশের সাংবিধানিক গণতন্ত্র, ন্যায়বিচার, সমতা এবং আইনের শাসনের দাবি জনমানসপটে জেগে উঠেছে বারবার। কায়েমি স্বার্থবাদী হস্তক্ষেপে এ পথ কখনো মসৃণ ছিল না। এরপরও সীমিত ভৌগোলিক সীমায় অধিক জনসংখ্যার দেশে ক্রমবর্ধমান মামলার চাপ মোকাবিলা ও প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারসহ কিছু চ্যালেঞ্জ বিচার বিভাগের সামনে রয়েছে। দেশের উচ্চ আদালত যেন হয় জাতি, ধর্ম-বর্ণ, গোত্র নির্বিশেষে আপামর জনসাধারণের আশা-আকাক্সক্ষার অসীম আশ্রয়স্থল- সেটাই দেশবাসীর একান্ত প্রত্যাশা।
লেখক : সাংবাদিক

×