ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৫ জানুয়ারি ২০২৫, ১২ মাঘ ১৪৩১

তরুণ প্রজন্মের সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জ

মো.আমিনুল ইসলাম মজুমদার

প্রকাশিত: ১৯:২৪, ৭ ডিসেম্বর ২০২৪

তরুণ প্রজন্মের সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জ

বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্ম দেশের মোট জনসংখ্যার একটি বৃহৎ অংশ এবং দেশের ভবিষ্যৎ উন্নয়নের অন্যতম প্রধান প্রাণশক্তি। দেশের মোট জন সংখ্যার প্রায় ৬৫ শতাংশ মানুষ ৩৫ বছরের নিচে, যা দেশের অর্থনীতি, সমাজ এবং রাজনীতিতে নতুন শক্তি উদ্ভাবনের সম্ভাবনা এনে দিয়েছে। এই তরুণ জনশক্তির মধ্যেই লুকিয়ে আছে দেশের ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব, প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন, এবং উন্নয়নের সম্ভাবনা। তবে সা¤প্রতিক গবেষণা পরিসংখ্যান বলছে, এই প্রজন্মের একটি বড় অংশ হতাশা, উদ্বেগ এবং মানসিক স্বাস্থ্য সংকটের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যানুসারে, বাংলাদেশে প্রতি পাঁচজনের একজন মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যায় আক্রান্ত, যার একটি বড় অংশ তরুণ। কর্মসংস্থান সংকট, শিক্ষার সীমাবদ্ধতা, প্রযুক্তির অপব্যবহার এবং সামাজিক চাপ তরুণদের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলছে। উচ্চশিক্ষা শেষ করার পরেও কর্মসংস্থানের সুযোগের অভাব তরুণদের হতাশার একটি প্রধান কারণ।

২০২৩ সালের বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যমতে, শিক্ষিত বেকারত্বের হার প্রায় ৪৭ শতাংশ, যা দেশের জন্য উদ্বেগজনক। বেসরকারি খাতে কাজের অস্থিরতা এবং সরকারি চাকরির জন্য দীর্ঘ প্রতিযোগিতার কারণে অনেক তরুণ তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তায় ভুগছে। পাশাপাশি, বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় সৃজনশীলতা এবং বাস্তবিক দক্ষতা অর্জনের সুযোগ সীমিত। এখানে শিক্ষার্থীদের মূলত পরীক্ষার নম্বর এবং সার্টিফিকেটের ভিত্তিতে মূল্যায়ন করা হয়, যা তাদের চাকরির বাজারে টিকতে ব্যর্থ করে। প্রযুক্তি এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম তরুণদের জীবনে গুরুত্বপূর্ণ মিকা পালন করলেও এর অতিরিক্ত ব্যবহার নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। ভার্চুয়াল জীবনের সঙ্গে বাস্তব জীবনের তুলনা, সাইবার বুলিং এবং নেতিবাচক কনটেন্ট তরুণদের মানসিক স্বাস্থ্যকে আরও সংকটে ফেলছে। সামাজিক চাপ এবং পরিবার থেকে নির্দিষ্ট পেশা গ্রহণের বাধ্যবাধকতাও তরুণদের হতাশার একটি বড় কারণ। অনেক পরিবার সন্তানদের স্বপ্ন এবং আগ্রহকে উপেক্ষা করে তাদের ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার বা সরকারি কর্মকর্তা হওয়ার জন্য চাপ প্রয়োগ করে, যা তাদের সৃজনশীলতাকে দমিয়ে দেয়। তরুণদের মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়ে বাংলাদেশের সমাজ এখনও যথেষ্ট পিছিয়ে রয়েছে। মানসিক সমস্যা নিয়ে কথা বলাকে লজ্জাজনক এবং দুর্বলতা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ফলে অনেক তরুণ তাদের সমস্যার সমাধান চাওয়ার সাহস পায় না এবং একাকীত্ব হতাশার গভীরে নিমজ্জিত হয়। হতাশা থেকে মুক্তি পেতে অনেক তরুণ মাদকাসক্তির পথে পা বাড়াচ্ছে, যা তাদের ব্যক্তিগত, পারিবারিক এবং সামাজিক জীবনে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলছে।

২০২২ সালে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয় যে মাদকাসক্তদের প্রায় ৬৫ শতাংশই তরুণ প্রজন্ম। হতাশা এবং মানসিক অস্থিরতা তরুণদের সৃজনশীল চিন্তাভাবনা এবং উদ্যোগ গ্রহণের ক্ষমতা কমিয়ে দিচ্ছে, যা শুধু তাদের ব্যক্তিগত উন্নয়নেই বাধা সৃষ্টি করছে না বরং দেশের অর্থনীতিকেও নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করছে। এই সংকট সমাধানে সরকার, পরিবার এবং সমাজকে একযোগে কাজ করতে হবে। কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং দক্ষতা উন্নয়নমূলক কার্যক্রম চালু করা অত্যন্ত জরুরি। শিক্ষা ব্যবস্থায় সৃজনশীলতা এবং বাস্তবিক দক্ষতা অর্জনের ওপর জোর দিতে হবে। তরুণদের মানসিক স্বাস্থ্য রক্ষার জন্য স্কুল, কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে মানসিক স্বাস্থ্য শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা উচিত। স্থানীয় পর্যায়ে কাউন্সেলিং সেন্টার এবং মানসিক স্বাস্থ্য সেবা সহজলভ্য করার মাধ্যমে তরুণদের সাহায্য করতে হবে। পরিবারকে তরুণদের প্রতি আরও সহানুভতিশীল হতে হবে এবং তাদের স্বপ্ন পূরণের ক্ষেত্রে সমর্থন প্রদান করতে হবে। তরুণদের ভার্চুয়াল জীবনের পাশাপাশি বাস্তব জীবনের কার্যক্রমে অংশগ্রহণে উৎসাহিত করা দরকার। তরুণ প্রজন্ম শুধু দেশের ভবিষ্যৎ নয়, বর্তমানের শক্তি। তাদের মানসিক স্বাস্থ্য রক্ষা এবং হতাশা দূর করতে পরিবার, সমাজ এবং সরকারের সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন। তরুণদের জন্য একটি ইতিবাচক পরিবেশ তৈরি করা গেলে তারা শুধু নিজেরাই সাফল্যের শিখরে পৌঁছাবে না বরং দেশের সামগ্রিক উন্নয়নেও উল্লেখযোগ্য অবদান রাখবে।   

শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

×