‘শীতের শহর ডাকছে আমায়/ শুধু তোমায় পড়ছে মনে/ঠান্ডা হাওয়ার সন্ধ্যেগুলো/ভাঙছে ভীষণ অভিমানে...’ কুয়াশার চাদর জড়িয়ে নূপুর পায়ে ঝুনঝুন শব্দ করে গুটি গুটি পায়ে কিশোরী শীত উঁকি দিচ্ছে শহরের জানালায়। যেন জানান দিচ্ছেÑ আমার আসার সময় হয়েছে, তোমরা তৈরি তো? শীত মানেই কেমন যেন স্মৃতি কাতর হয়ে ওঠে শহুরে মন। কল্পনায় হেঁটে যায় পাড়া গাঁয়ের পথে। শিশির ভেজা ঘাস, সিক্ত ধানের শিষ, ফুলকপি-বাঁধাকপি-টমেটো-শিম-নানা রকম শাক-সবজির শিশির ভেজা খেত চোখের সামনে এসে লুটোপুটি খায়। ইচ্ছে হয় শিশিরে ভেজাই পা। সবুজ ধানের শীষে মুক্তোর মতো শিশির বিন্দু ছুঁয়ে আসি প্রতি সকালে। গ্রামে ভোরে বা সাঁঝের বেলায় খড়ি, শুকনো পাতা, খড় জমিয়ে আগুন জ্বালিয়ে ছোট-বড় সবাই জড়ো হয়ে উত্তাপ নেয় শীত থেকে রক্ষার্থে। নতুন ধান নিয়ে কিষাণ-কিষাণির ব্যস্ততা, ধান মাড়াই-উড়ানো, নতুন চালের পিঠা-পায়েস আর চুলার পাড়ে বসে গরম গরম ধোঁয়া ওঠা নানারকম পিঠা খাওয়াÑ সে এক মনোরম দৃশ্য! শহরে কোথায় সেই দৃশ্য! শুধু কর্মব্যস্ততা। রোজ সকালে ঘুম ভেঙে, লেপ-কম্বলের ওম ছেড়ে ছুটে চলা যান্ত্রিক জীবনের নানা কম ব্যস্ততায়। শহরে শীতের ব্যস্ততা থাকে শপিংমল আর ফুটপাতে। শীতের পোশাক কেনার ধুম পড়ে যায়। উচ্চবিত্ত বা মধ্যবিত্তরা ছুটে যান নতুন ফ্যাশনেবল শীতের পোশাক কিনতে বিভিন্ন শপিংমলে। আর নিম্নবিত্তরা যান ফুটপাতে। শহুরে শীত অনেকটা পোশাক কেন্দ্রিক। আর রোজ সন্ধ্যেবেলায় পথের ধারগুলো ব্যস্ত হয়ে ওঠে নানারকম পিঠা-পুলির সাজে। এমনিতেও বেশ কয়েক বছর যাবত স্ট্রিট ফুড খুব জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে ঢাকায়। আমাদের ছোটবেলায় পথের ধারের খাবার খাওয়ার প্রতি ছিল তীব্র নিষেধাজ্ঞা। স্কুল-কলেজে যাওয়ার সময় বাবা-মা বলে দিতেন, পথের পাশের খোলা খাবার যেন না খাই। গত প্রায় এক দশক যাবত হঠাৎ করেই জনপ্রিয় হয়ে ওঠেছে এই স্ট্রিট ফুড। নানা ডিজাইনের ভ্যান সাজিয়ে আকর্ষণীয় ফুডকোর্টগুলো দেখলে সত্যিই খাওয়ার প্রতি লোভ জাগে। তবে স্ট্রিট ফুডগুলো বেশিরভাগই হয় অস্বাস্থ্যকর। কিন্তু এসব ফুডকোর্ট দেখলে সে কথা আর মনেই থাকে না। তাছাড়া এখন বেশিরভাগ ফুডকার্টেই ক্রেতার সামনে খাবার তৈরি করা হয়, যার জন্য খেতে ইচ্ছেও জাগে। এসব ফুডকার্টে এখন বিভিন্নরকম মুখরোচক খাবারও পাওয়া যায়, যা আগে বড় কোনো খাবারের দোকান ছাড়া পাওয়া যেত না। আগে এসব জায়গায় পাওয়া যেত চটপটি, ফুচকা, মুড়ি-চানাচুর মাখা ইত্যাদি। এখন খাদ্য তালিকায় রয়েছেÑ পিজ্জা, বার্গার, নুডলস, চাওমিন, চিকেন ও ভেজিটেবল রোল, শর্মা, লুচি, পরোটা, বিভিন্ন রকম চিকেন-বিফ কাবাবসহ নানা লোভনীয় খাবার।
তবে শীত এলে ফুডকোটগুলো এসব খাবারের পাশাপাশি শীতের পিঠা-পুলিতে ভরে ওঠে। চিতই আর তেলের পিঠার সঙ্গে জায়গা করে নেয় দেশীয় বিভিন্ন ঐতিহ্যবাহী পিঠা। একটা সময় শীতে চিতই পিঠার পাশাপাশি পাওয়া যেত ভাপা পিঠা। তখন সবাই অপেক্ষায় থাকতো কবে শীত আসবে, তারপর ভাপা পিঠা খাবে। ভাপা আর শীত দুটো যেন ওতোপ্রোতোভাবে জড়িত। ইদানীং এগুলোর পাশাপাশি পাটিসাপটা, বিভিন্ন রকম পুলি পিঠা, পাকন পিঠা, কোথাও আবার ফিরনি-পায়েসেরও দেখা পাওয়া যায়। এতে করে শহুরে মানুষদের যেমন পিঠা খাওয়ার তৃষ্ণা মিটছে, তেমনি নিম্নবিত্তদের নিয়মিত একটা আয়েরও ব্যবস্থা হচ্ছে। নারী-পুরুষ উভয়ই এসব পিঠা বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করে। এতে করে অনেক দরিদ্র পরিবার দেখতে পায় সচ্ছলতার মুখ।
আশার বিষয় হচ্ছে, ইদানীং অনেক সচ্ছল পরিবারের মেয়েরাও এগিয়ে এসেছে পিঠা-পুলির ব্যবসায়। বিভিন্ন জায়গায় নিজেদের উদ্যোগে অনুষ্ঠিত হয় পিঠা উৎসব ও মেলার। যার ফলে বিলুপ্ত প্রায় অনেক পিঠাও দেখা যায়। এটা সত্যিই আশার বিষয়। কিছুদিন আগে খোঁজ পেলাম নরসিংদী জেলার বিলুপ্ত প্রায় পিঠা-পায়েস মিডুরি, সতীনমোচন পিঠা, চমচম পিঠার। অবাক হয়েছি, খুব ছোটবেলায় যখন গ্রামে যেতাম, তখন এই মিডুরি নামটা শুনেছিলাম- ঝাপসা স্মৃতিতে মনে পড়ে। সেই থেকে ভেবেছি মিডুরি হয়তো ফিরনি-পায়েসের নরসিংদীর আঞ্চলিক নাম। তাই কাউকে লোভনীয় খাবারের কথা মজা করে বলতে গেলে বলতাম- মিডুরি খাবে? সেদিন জানতে পারলাম মিডুরি আসলেই ফিরনি-পায়েসের মতোই আরেকটি খাবার, যা বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বা বাড়িতে মেহমান এলে রান্না হয়। এটি রান্না হয় দুধ, পোলাও চাল, সাগুদানা, কোড়ানো নারিকেল, বাতাসা, চিনি ও খেজুর গুড় দিয়ে। এক সৌখিন রাঁধুনির কাছে এই মিডুরির রেসিপি পেলাম। তিনি নরসিংদীর বিলুপ্তপ্রায় এসব ঐতিহ্যবাহী পিঠা ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছেন।
একটা সময় এসব পিঠা-পুলি নিয়ে শুধু দরিদ্র শ্রেণির পুরুষ-মহিলারাই বসতেন পথের ধারে। বর্তমানে অনেক স্বচ্ছল পরিবারের মেয়েরাও বিভিন্ন রকম রান্নার সঙ্গে পিঠা বিক্রি করছেন। এতে করে মেয়েরা যেমন ঘরে বসে আয় করে নিজেদের স্বাবলম্বী করতে পারছে, তেমনি হারিয়ে যাওয়া বিভিন্ন আঞ্চলিক পিঠাগুলোও ফিরে আসছে। কারণ, প্রত্যেকেরই লক্ষ্য থাকে নিজ জেলায় হারিয়ে যাওয়া পিঠাগুলোকে ফিরিয়ে আনা এবং সবার কাছে পরিচিত করে তোলা।
শীত মানেই যেন পিঠা-পুলিতে ভরপুর এক উৎসবমুখর বাংলাদেশ। গ্রামের সারি সারি খেজুর গাছে ঝুলে থাকে খেজুর রসের কলস। এই হিম হিম শীতে সকালে আর সন্ধ্যায় খেজুর রস খাওয়া জীবনে আলাদা এক মাত্রা যোগ করে। জীবনে একবারই এই রস খাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল ঝিনাইদহ আমার আপুর শ্বশুরবাড়ি বেড়াতে গিয়ে। খুব ঠান্ডা থাকে এই রস, কিন্তু খুব স্বাদ। তবে আমার কাছে সকালের চেয়ে সন্ধ্যার রসটা বেশি সুস্বাদু লেগেছে। বিকেলে পেতে রাখা হাঁড়ির রস একদম তাজা থাকে। নতুন রসের ফিরনি-পায়েস আর পিঠা-পুলি খাওয়ার আনন্দই আলাদা। আর সেই রস জ্বাল দিয়ে যখন গুড় বানানো হয়, সারা বাড়ি এমনকি এলাকায়ও গুড় জ্বালের মিষ্টি ঘ্রাণে ম ম করে। নতুন খেজুরের গুড় দিয়ে বানানো হয় নান রকম পিঠা-পুলি। রসের পায়েস মুখে লেগে থাকার মতো স্বাদ। শহরেও কম-বেশি যে যতখানি জানেন, ঘরে পিঠা বানিয়ে আপনজনদের নিয়ে খাওয়ার চেষ্টা করেন। শীতের বিশেষ পিঠা বলতে সবাই সাধারণত ভাপা পিঠাকেই বোঝে। গুড় আর কোড়ানো নারকেল দিয়ে তৈরি এই পিঠা প্রায় সবারই খুব প্রিয়। গত বছর পথের পাশে বানানো এই পিঠা জায়গা ভেদে ২০/৩০ টাকা পর্যন্ত দাম উঠেছিল। কোথাও আবার ১০ টাকায়ও পাওয়া গেছে। আর চিতই পিঠা যারা ঘরে তৈরি করতে না পারেন, তারা পথের ধার থেকে কিনে নিয়ে নতুন খেজুরের রস বা গুড় দিয়ে তৈরি করেন দুধ চিতই। সেটাও শীতের আরেকটি ঐতিহ্যবাহী পিঠা।
তবু শহরে শীত নামে। শীতের অপেক্ষায় থাকে শহুরে মানুষ। পথের পাশে জমে ওঠে পিঠাউৎসব। দরিদ্র শ্রেণি থেকে উচ্চবিত্তরা পর্যন্ত খুব আয়েস করে সেখানে মেতে ওঠে পিঠা খাওয়ার উৎসবে। ভোরের কুয়াশাচ্ছন্ন রাজপথে চলতে গিয়ে মন উদাস হয়।
‘পৌষ তোদের ডাক দিয়েছে/আয় রে চলে, আয় আয় আয়/ডালা যে তার ভরেছে আজ পাকা ফসলে/মরি হায় হায় হায়...’
লেখক : সাংবাদিক
স্ট্রিট ফুডে পিঠাপুলি
শীর্ষ সংবাদ: