ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ৩০ অগ্রাহায়ণ ১৪৩১

যুক্তরাষ্ট্রের সমাজজীবন ও মানবিক অবক্ষয়

ড. ইউসুফ খান

প্রকাশিত: ২০:০৮, ১৪ নভেম্বর ২০২৪

যুক্তরাষ্ট্রের সমাজজীবন ও মানবিক অবক্ষয়

সবাই বলে স্বপ্নের দেশ আমেরিকা। আমি বলি কর্মের দেশ আমেরিকা। কর্ম করলে স্বপ্ন এমনি এসে ধরা দেয়। কর্মের মাধ্যমে জিরো থেকে হিরো হয়েছেন, জীবনে প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন, সাফল্যের মুকুট পরেছেন এমন শত শত নজির রয়েছে দেশটিতে। এজন্যই আমেরিকাকে বলা হয় ‘ল্যান্ড অব অপরচুনিটি’। শুধু কাজ আর কাজ। দেশটির মূলমন্ত্রই হলো নো ওয়ার্ক, নো পে, নো ফুড। আমেরিকার পূর্ণাঙ্গ নাম হচ্ছে ইউনাইটেড স্টেটস অব আমেরিকা। সংক্ষেপে ইউএসএ বা স্টেটস বা যুক্তরাষ্ট্র অথবা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও বলা হয়। দেশটির আয়তন ৩৫ লাখ ৩৬ হাজার ৩৪১ বর্গমাইল। বাংলাদেশের চেয়ে প্রায় ৭০ গুণ বড়। ৫০টি স্টেট বা অঙ্গরাজ্য নিয়ে দেশটি গঠিত। বিশাল আয়তনের দেশটির লোকসংখ্যা ৩০ কোটি ছাড়িয়ে গেছে। তন্মধ্যে হোয়াইট আমেরিকান প্রায় ৮০ শতাংশ এবং অবশিষ্টাংশের মধ্যে ব্ল্যাক আমেরিকান, নেটিভ আমেরিকান (স্প্যানিশ), এশিয়ান আমেরিকান ও অন্যান্য। পৃথিবী নামক গোলকে বাংলাদেশের বিপরীতে আমেরিকার অবস্থান। বিপরীতমুখী অবস্থানের কারণেই বাংলাদেশে যখন রাত আমেরিকায় তখন দিন। আমেরিকার এক প্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে বিমানে যেতে সময় লাগে ৬ ঘণ্টার বেশি। আর টাইম জোন হচ্ছে ৪টি। অর্থাৎ এক প্রান্তে যখন বিকেল ৫টা, অন্যপ্রান্তে তখন রাত ৮টা। ইতালির নাগরিক ক্রিস্টোফার কলম্বাস ১৪৯২ সালে আমেরিকা নামের দুনিয়া আবিষ্কার করেন।
পৃথিবীর ১০০টির বেশি দেশের মানুষ আমেরিকায় স্থায়ীভাবে বসবাস করে। এত ভাষাভাষীর দেশ বিশ্বের আর কোথাও নেই। এজন্যই আমেরিকাকে ‘ল্যান্ড অব ইমিগ্র্যান্ট’ বলা হয়। ওখানকার আদিবাসী হচ্ছে রেড ইন্ডিয়ান। এর পরেই হলো আফ্রিকা থেকে আগত কৃষ্ণ অধিবাসী। এই কৃষ্ণরা দূর অতীতে এক সময় শ্বেতাঙ্গদের ক্রীতদাস ছিল। পরবর্তীতে প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকনের প্রচেষ্টায় বিলোপ করা হয় দাস প্রথা । এই কালো আর সাদার মধ্যে কিন্তু একটা ভেতরগত বৈরী ভাব আছে, যা মাঝে মাঝে বিভিন্ন ঘটনার মাধ্যমে প্রকাশ পায়। আমেরিকার মোট জনসংখার অর্ধেকের বেশি নারী। ওদেশে নারী-পুরুষের আচার-আচরণ ও কর্মকাণ্ডের মধ্যে তেমন কোনো পার্থক্য নেই। নারীরা পুরুষের মতোই প্রকাশ্যে সিগারেট ও মদ্যপান করে থাকে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, আমেরিকানরা পৃথিবীর অন্য কোনো দেশের রীতিনীতি বা কালচারকে সহজে ফলো করতে চায় না। নিজেদের উদ্ভাবিত নিয়মনীতির ওপর চলাকে আত্মমর্যাদা ও গর্বের ব্যাপার বলে মনে করে। যেমনÑ ইলেকট্রিক সুইচগুলো ওপরের দিকে প্রেস করে অন করতে হয়। গাড়ি বামদিকে বসে ড্রাইভ করতে হয়। গোটা পৃথিবীর ২৫ শতাংশ কর্মসংস্থান হয় আমেরিকায়। আমেরিকার জনগণের কথা বলতে বোঝায় বৈচিত্র্য, অভিবাসন ও অভিবাসী। সুন্দর এই বৃহৎ দেশ আমেরিকা অফুরন্ত প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ। আমেরিকায় রয়েছে সবচেয়ে উর্বর মৃত্তিকা, প্রচুর জলরাশি, চমৎকার জলপথ, স্থলপথ ও দিগন্তজোড়া রাস্তাঘাট।
আমেরিকা পৃথিবীর ধনী দেশগুলোর অন্যতম। রাজনীতি, অর্থনীতি, সামরিক সর্বক্ষেত্রেই রয়েছে আধিপত্য। বলতে গেলে গোটা পৃথিবীটাকেই তারা শাসন করছে। এত ক্ষমতা এবং এত সম্পদের অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও তাদের মধ্যে রয়েছে আরও চাওয়া এবং পাওয়ার তীব্র আকাক্সক্ষা। ফলে স্বভাবতই তারা হতাশাগ্রস্ত। উন্নত আমেরিকার অতি বুদ্ধিমান মানুষ বুঝতে পারে সংসার অসার এবং কেউ কারও নয়। প্রয়োজনে পরিবার-পরিজন, মায়া-মমতা, স্নেহবন্ধন সবই ত্যাগ করা যায়। একটি মাত্র জীবন, সীমিত সময়। এর মধ্যেই নিত্যনতুন আনন্দ ও আমেজে তারা বাঁচতে চায়। পুরাতন জুতা, পুরাতন বন্ধু এরা বিষের মতো মনে করে। আর কাঙ্গালের মতো আই লাভ ইউ, আই লাভ ইউ বলে পথে পথে শিকার খোঁজে, স্বার্থ খোঁজে। নিত্যনতুন প্রেম এদের ডেমোক্র্যাটিক রাইট। নতুন প্রেম, নতুন আশায় বুক ভরে ওঠে। উন্নত দেশে উন্নত মানুষের বাঁচার এটা একটা স্টাইল, একটা পথ।
একটি অংশ আছে যাদের মধ্যে ধর্ম নেই, মাথায়ও ধর্ম নেই। আছে শুধু যৌন প্রেমের ক্ষুধা। প্রেমের তালে তালে এরা জীবনের সব দুঃখ-হতাশা ভুলতে চেষ্টা করে। এরা মনে করে যৌন প্রেম সকল হতাশা ও নিরানন্দ রোগের মহৌষধ। জীবনবোধ ও মানবিকতার কোনো মূল্যই নেই এদের কাছে। এ ভ্রান্ত ধারণার পরিণতি বড়ই মর্মান্তিক। অস্থির ও অশান্ত জীবনে থাকে না কোনো পারিবারিক শান্তি। যৌবনের উন্মাদনা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে জীবন হয়ে ওঠে নিঃসঙ্গ, দুর্বিষহ। স্ত্রী, ছেলেমেয়ে হয়ে যায় বিচ্ছিন্ন। ফলে বৃদ্ধ বয়সটা হয়ে দাঁড়ায় বড়ই করুণ, উপেক্ষিত। এ সময় শুধু পোষা কুকুরই থাকে নিঃসঙ্গ জীবনের একমাত্র সঙ্গী।
আমাদের দেশ অতটা উন্নত না হলেও ধর্ম আছে এবং সেই ধর্মের প্রতি রয়েছে মানুষের অগাধ বিশ্বাস। এ ধর্ম মানুষের মধ্যে মানবতা ও বিবেকবোধকে জাগ্রত করে অনৈতিক কাজে অংশগ্রহণ করা থেকে বিরত রাখে। আমাদের দেশের মানুষের অভাব আছে, কিন্তু অভাববোধ অত্যন্ত কম। মোটা ভাত, মোটা কাপড় হলেই পরিতৃপ্ত। আমেরিকানদের মতো চাঁদে গিয়ে বসবাস করার আকাক্সক্ষায় কেউ হতাশাগ্রস্ত নয়। ধর্মের অনুশাসন আছে বলেই পরকীয়া প্রেমের সংখ্যা নগণ্য। এই আধুনিক যুগেও কোনো ছেলেমেয়ে প্রেম করতে গিয়ে জানাজানি হলে অপবাদ রটে। সামাজিক বিচার বসে। তবে ইদানীং আকাশ সংস্কৃতির প্রভাবে পরকীয়া প্রেমের অস্থিরতার মাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
আমেরিকার সমাজ ও জীবনাচার বড়ই অদ্ভুত। সেদেশের তরুণ-তরুণীরা বিয়ের পরিবর্তে একসঙ্গে বসবাস অর্থাৎ লিভ টুগেদারের পক্ষপাতী। বিয়ে এখন অনেকটা সেকেলে হয়ে গেছে। পূর্বসূরিদের মতো বিয়ে করার চেয়ে খোলামেলা স্বাধীন জীবনযাপনের প্রতিই তারা বেশি আকৃষ্ট। বিয়ে নামক প্রতিশ্রুতির বন্ধনে নিজেদের জড়াতে রাজি নয় তারা। বিয়ে করে অনেকদিন সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার মাধ্যমে সন্তান-সন্ততি নিয়ে সংসার করার পক্ষপাতী নয় তারা। তাদের বিশ্বাস, সেক্স শুধু উপভোগের। এর সঙ্গে ডিভোর্সের ভয় মিশ্রিত বিয়ে নামক অদৃশ্য কোনো বন্ধন থাকে না। তাছাড়া বিয়েটা তারা একটা অর্থনৈতিক দায়বদ্ধতা হিসেবেও বিবেচনা করে থাকে।
আমেরিকার সমাজ ক্রেজি সমাজ। ওদের কাছে পরিবেশ-পরিস্থিতি, পাত্র-পাত্রীর কোনো ভেদাভেদ নেই। টেলিভিশনে জেরিস স্প্রিং শোতে প্রায়ই দেখা যায়, মেয়ের বয়ফ্রেন্ডের সঙ্গে মা শয্যাসঙ্গিনী হচ্ছে। মেয়ে এর প্রতিবাদ করলে মা মেয়েকে তার নিজ ফিগারের প্রতি যত্নশীল হওয়ার জন্য পরামর্শ দিচ্ছে। বাবা তার ছেলের অনুপস্থিতিতে ছেলের গার্লফ্রেন্ডকে পটিয়ে বিছানায় নিয়ে যাচ্ছে। মা হয়তো তার বয়ফ্রেন্ডের সঙ্গে একা বেড়াতে যাচ্ছেন, ছেলেমেয়ে বিষয়টিকে খুব স্বাভাবিকভাবে নিয়ে মনে করছেন মা তার বয়ফ্রেন্ডের সঙ্গে ‘ফান’ করতে যাচ্ছেন।
প্রায়ই দেখা যায় অনেক তরুণ-তরুণী রাস্তাঘাটে উন্মুক্ত জায়গায় দাঁড়িয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা জড়াজড়ি করে পরস্পরকে নিবিড়ভাবে চুম্বন করছে, যা তাদের যৌন ক্ষুধারই বহির্প্রকাশ। কোনো পথচারী ফিরেও তাকাচ্ছে না সেদিকে। ডেটিং এবং সেক্স তাদের কাছে ভাত-মাছের মতো। তবে এজন্য উভয়ের সম্মতির প্রয়োজন রয়েছে। শুধু ভালোলাগা ও ভালোবাসার মাধ্যমেই এ মিলন হতে পারে, অন্যথায় নয়। ইচ্ছা-অনিচ্ছাকে ওদেশে মূল্যায়ন করা হয়। জোর করে কারও ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোনো কিছু করার জন্য রয়েছে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা। সহৃদয় পাঠক-পাঠিকাদের অবগতির জন্য একটি ঘটনার বিশদ বিবরণের মাধ্যমে বিষয়টিকে আরও পরিষ্কার করা যেতে পারে। আমেরিকার সোনালি একচেঞ্জে কর্মরত থাকাকালীন আমার প্রতিবেশী ছিলেন এক পাকিস্তানি দম্পতি। সংসারের চাপে স্বামী-স্ত্রী উভয়েই চাকরি করতেন। স্ত্রীর বয়ফ্রেন্ড ছিল তারই অফিসের এক সহকর্মী। স্বামী-স্ত্রী একই ছাদের নিচে বসবাস করলেও স্বামীর জৈবিক চাহিদা মেটানোর ব্যাপারে স্ত্রী ছিলেন উদাসীন। এমনি এক রাতে স্বামী তার অধিকার ফলাতে জোর করেই স্ত্রীর ইচ্ছার বিরুদ্ধে সেক্স করলেন। ক্ষুব্ধ স্ত্রী তার পরদিনই স্বামীর বিরুদ্ধে রেপ কেসের মামলা ঠুকে দিলে পুলিশ স্বামী বেচারাকে গ্রেফতার করে জেলহাজতে নিয়ে যায়।
সবচেয়ে অবাক লাগে যখন এক মেয়ে আরেক মেয়েকে বিয়ে করে সগর্বে বলে বেড়ায় তারা স্বামী-স্ত্রী। একজন আরেকজনকে দেখিয়ে বলে, ‘সি ইজ মাই সুইট হার্ট, সুইট ওয়াইফ’। ভালোবাসা প্রকাশ করার সময় পরস্পরকে ‘হানি, বেবি, সুইট হার্ট’ ইত্যাদি বলে সম্বোধন করে এবং চলাফেরা, আচার-আচরণে বুঝিয়ে থাকে তারা খুব সুখী দম্পতি। একইভাবে এক ছেলে আরেক ছেলেকে বিয়ে করছে এবং নিজেদের সুখী দম্পতি হিসেবে জাহির করতেও কার্পণ্য করে না। আমেরিকার ক্রেজি সোসাইটিতে এ ধরনের হোমো সেক্সুয়াল অর্থাৎ ‘লেসবিয়ান’ ও ‘গে’ দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। ক্যাসিনো, নাইট ক্লাব, স্ট্রিপটিজ ক্লাব, সেক্স ক্লাব ইত্যাদির প্রভাবে ছেলে-মেয়েরা দিশেহারা হয়ে পড়ছে। হতাশায় ভুগছে। ড্রাগ এডিক্ট হচ্ছে। প্রণয়ঘটিত অপরাধ, খুন-খারাবি বাড়ছে। এমনকি জুনিয়র হাইস্কুলে সেভেন-এইট গ্রেডে পড়ুয়া অপ্রাপ্তবয়স্ক ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যেও এর যথেষ্ট প্রভাব পরিলক্ষিত হয়।
টেলিভিশন খুললেই দেখা যায় গার্লফ্রেন্ডকে কেন্দ্র করে খুন-খারাবি হচ্ছে। শিক্ষক শাসন করতে গেলে তাকেও গুলি করতে দ্বিধাবোধ করছে না। পারিবারিক ও সামাজিকভাবে যারা সুস্থ আছেন তারাও প্রভাবিত হয়ে নানা সমস্যায় ভুগছেন। এ সামাজিক অবক্ষয় চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। তাদের বাইরের কৃত্রিম চোখ ঝলসানো রূপ-সৌন্দর্য দেখে বোঝার উপায় নেই যে, তারা ভুগছেন চরম হতাশায়। গোটা সমাজটাই যেন শান্ত, অস্থির এবং ক্লান্ত। মনে হয় সারাক্ষণই ডলার এবং সেক্সের পেছনে ছুটছে। এ সমাজের কোনো স্ট্রং ফাউন্ডেশন নেই। শুধু ল’ এবং অর্ডার সিচুয়েশন ঠিক আছে বলেই তাদের সমাজ চলছে। কিন্তু ঘুণেধরা সেক্স ক্রেজি সোসাইটি যে কোনো সময় ভেঙ্গে পড়তে পারে। তারা পৃথিবীর পরাশক্তির অধিকারী হতে পারে, কিন্তু সিভিলাইজড বলতে যা বোঝায় তা নয়। অন্যায়-অবিচার, ষড়যন্ত্র, কিডন্যাপ, সন্ত্রাস, ঘুষ-দুর্নীতি, এমনকি দিনদুপুরে মুখোশ পরে ডাকাতি পর্যন্ত হচ্ছে তারা। পুলিশ-প্রশাসন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। আইন আছে এবং আইনের যথাযথ প্রয়োগও আছে। সবার জন্য একই আইন, কোনো ভেদাভেদ নেই। আইনের কঠোর শাসনে দেশের প্রেসিডেন্টকেও আসামির কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়, যা আমরা ভূতপূর্ব প্রসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের ক্ষেত্রেও দেখেছি।
আমেরিকার মতো উন্নত দেশের উদার সমাজব্যবস্থার তুলনায় অনুন্নত দেশের সমাজব্যবস্থা অনেকটাই কঠিন বিধায় সবকিছুরই রয়েছে যথেষ্ট সীমাবদ্ধতা। অনুন্নত দেশের মানুষ যখন আমেরিকার মতো বিশাল দেশে এসে পড়ে তখন মুক্ত হরিণের মতো বিচরণ করে তারা। নেই কোনো বাধা, নেই কোনো বন্ধন, এ যেন স্বপ্নের দেশ। নারী-পুরুষ সবাই পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী কারেন্সি ডলার উপার্জন করে বিধায় কেউ কাউকে পরোয়া করে না। প্রবাসীরা দুটি কথা প্রায়ই বলে থাকেÑএকটি ‘হু কেয়ারস’ এবং অপরটি ‘আই ডু নট কেয়ার’। স্ত্রীরা চাকরি করে। তাই তাদের স্বাধীনতায় স্বামীদের হস্তক্ষেপ কাম্য নয়।
সেদেশের কালচার অনুকরণের দিক থেকে আমাদের প্রবাসী বাংলাদেশীরাও পিছিয়ে নেই। সংসারের উপার্জন বাড়ানোর লক্ষ্যে স্বামীদের পাশাপাশি স্ত্রীরাও চাকরি করছেন। উপার্জন বাড়ছে ঠিকই, কিন্তু স্বামীর সঙ্গে স্ত্রী বা স্ত্রীর সঙ্গে স্বামীর কাজের ক্যাজুয়েল মিলছে না বলে দেখা-সাক্ষাৎও কম হচ্ছে। সংসারের চাপে উভয়েই বহির্ম্খুী হওয়ায় ভালোবাসার গভীরতাও ধীরে ধীরে কমে আসতে থাকে। একদিকে শক্তিশালী ডলার উপার্জন, অন্যদিকে অবাধ স্বাধীনতার ফলে সেদেশের সংস্কৃতির প্রতি তারা ঝুঁকে পড়ে। পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও জীবন সংগ্রামের প্রতিযোগিতায় ব্যস্ত থাকার ফলে শাশ্বত বাঙালি রমণী তার নমনীয়তা ও কমনীয়তা হারিয়ে ফেলে। সর্বোপরি সংসারের প্রতি তাদের থাকে না কোনো আন্তরিকতা ও একাগ্রতা। স্ত্রীর প্রতি স্বামীর আস্থা কমে আসতে থাকে এবং স্বামীর প্রতিও স্ত্রীর আস্থা কমে আসে। পরবর্তীতে উভয়েই অবিশ্বাস ও সন্দেহের দোলায় দুলতে থাকে। সংসার নামক বস্তুটি হয়ে ওঠে তখন দুর্বিষহ। ফলে তারাও সেদেশীয় কায়দায় পরকীয়া প্রেম ভাইরাস রোগে আক্রান্ত হতে থাকেন।
আমেরিকায় প্রকাশিত বিভিন্ন সাপ্তাহিক বাংলা পত্রিকায় প্রায়ই দেখা যায় যে, প্রবাসী বাংলাদেশীদের পরিবার ভেঙে যাওয়ার সমস্যা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। কাজের চাপে বাবা-মা সন্তানের সঠিক খোঁজ-খবর নিতে পারছে না। ফলে অনেক ছেলেমেয়েই সেদেশীয় কালচারে রপ্ত হচ্ছে। স্কুলের নাম করে অল্প বয়সেই গার্লফ্রেন্ড-বয়ফ্রেন্ডের সঙ্গে ঘুরে বেড়াচ্ছে। পোশাক-আশাক ফ্যাশনেও হয়ে যাচ্ছে সেদেশের ছেলেমেয়েদের মতো। দেখলে বোঝার উপায় নেই যে, তারা বাঙালি পরিবারের সন্তান। অপরদিকে, এ ক্রেজি সমাজজীবনের চাপ, ফার্স্টলাইফ, কর্মজীবনে দক্ষতার মান উন্নয়নের সার্বক্ষণিক তাড়া সইতে না পেরে অনেক বাবা-মা-ই হতাশায় ভুগছেন বা হৃদযন্ত্রের অসুখে আক্রান্ত হচ্ছেন। জীবনযাত্রার মান সেদেশে উঁচু, দৈনন্দিন সুযোগ-সুবিধা অনেক বেশি, কিন্তু এটুকু বাদ দিলে সর্বক্ষেত্রে রয়েছে অবিরাম সংগ্রাম ও প্রতিযোগিতা। তারপরও আমেরিকা ইজ আমেরিকা।
স্বপ্নের দেশ আমেরিকা। এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, সমৃদ্ধি ও প্রাচুর্যের বিচারে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান বিশ্বে সর্বশীর্ষে। আজকের এ আমেরিকার উন্নয়নে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল অভিবাসীরই বিন্দু বিন্দু শ্রম, ঘাম ও যথেষ্ট ত্যাগ-তিতিক্ষা রয়েছে এ কথা অনস্বীকার্য। ২৭০ ইলেকটোরাল কলেজের ম্যাজিক ফিগার অতিক্রম করে রিপাবলিকান পার্টির প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের ৪৭তম প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন। তার গতিশীল নেতৃত্বে যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরে প্রবাসীদের কর্মসংস্থানের সুযোগ বৃদ্ধি, অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ এবং সারাবিশ্বে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি, স্থিতিশীলতা ও নিরবচ্ছিন্ন শান্তিই প্রত্যাশা।

লেখক : চেয়ারপারসন, ব্যুরো বাংলাদেশ

×