ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ৩০ অগ্রাহায়ণ ১৪৩১

অনলাইন ব্যবহারের অন্ধকার দিক

মাহামুদুর রহমান সৌরভ

প্রকাশিত: ১৯:১১, ১৪ নভেম্বর ২০২৪

অনলাইন ব্যবহারের অন্ধকার দিক

আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তির যুগে ইন্টারনেটের সুবিধার্থে বিশ্ব আজ গেøাবাল ভিলেজের রুপ নিয়েছে। ইন্টারনেট স্মার্টফোনের মাধ্যমে জটিল কাজ যোগাযোগ ব্যবস্থাতে যেমন সময় শ্রমের লাঘব হয়, তেমনি পৃথিবীর যেকোনো দেশের কৃষ্টি,কালচার, রাষ্ট্র,সমাজব্যবস্থা সম্পর্কে জানতে পারা যায় খুব সহজে। পরিনত বয়সের আগে স্মার্টফোন ব্যবহারে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে তরুণ প্রজন্মের উপর। উন্নত ইন্টারনেট স্মার্টফোন দিয়ে  চাইলেই কেউ যেকোনো দেশের সার্ভারে প্রবেশ করতে পারে। ইন্টারনেটে রয়েছে অসংখ্য ওয়েবসাইট। ওয়েবসাইটগুলো ব্যবহার করে কাঙ্ক্ষিত বিষয়টি কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই খুঁজে পাওয়া যায়। ওয়েবসাইটগুলোর অপব্যবহারও চলছে সীমাহীনভাবে। এমনই একটি ওয়েবসাইট পর্ণো সাইট। পর্ণোগ্রাফি বা নীল সিনেমা গ্রীক শব্দ পর্ণোগ্রাফোস থেকে এসেছে, যার অর্থ পতিতা [পর্ণো] সম্পর্কে [গ্রাফি] লেখা। এটি মূলত গ্রীক মন্দিরগুলিতে পেইন্টিং বা লেখার বর্ণনা দিতে ব্যবহৃত হয়েছিল এবং ২০ শতকের গোড়ার দিকে এর আধুনিক অর্থ (অশ্লীল ছবি) পর্ণোগ্রাফি হল যৌন উত্তেজনা সৃষ্টিকারী ডিজাইন করা কামুক আচরণের চিত্র। অর্থাৎ, এটি সম্পূর্ণরূপে অভিনয়কৃতভাবে তৈরি করা দুজন ব্যক্তির উত্তেজনাময় শারিরীক মিলনের মুহুর্ত। ভারতীয় সংবাদমাধ্যম আনন্দবাজার পত্রিকার খবর অনুযায়ী, প্রথমবার সবাক চলচ্চিত্র শুরুর কয়েক বছর পরই শুরু হয় নীলছবির যাত্রা। প্রথমবার এর শুটিং হয় ১৮৯৬ সালে। সিনেমার অশ্লীলায়নে প্রথমবারের মতো  এগিয়ে আসে ফ্রান্স। ফরাসি পরিচালক ইউচিন পিরৌ এবং অ্যালবার্ট কির্চনার চলচ্চিত্রে যৌনতার অনুপ্রবেশ ঘটিয়ে একটি ভিডিও তৈরি করেন। স্বল্পদৈর্ঘ্যের সেই সিনেমার নাম দেওয়া হয়লে কৌচের দে লা মারি গবেষকদের মতে, একজন পর্ণো আসক্ত ব্যক্তি সামাজিক অর্থনৈতিক, মানসিক শারিরীক ক্ষতির শিকার হয়। তাহলে পর্ণোগ্রাফি কেন এতো ভয়াবহ? পরিণত বয়সের আগেই যখন একজন কিশোর কিশোরী যৌন মিলন সম্পর্কে ভিজুয়ালি অবগত হয়, তাদের মাঝে শারীরিক কামনা-বাসনার মাত্রা বেড়ে যায়। ফলস্বরূপ নাগরিক সভ্যতার আড়ালে যৌন চাহিদায় তৃপ্তি পাওয়ার জন্য øæ-ফিল্ম বা নীলছবিতে মত্ত থাকেন।

আবার অনেকে পর্ণোগ্রাফিকে আধুনিক মাদক বলেও আক্ষায়িত করেন। মাদক এবং পর্ণোগ্রাফি দুটি ভিন্ন বিষয়। তবে দুটি বিষয়ই ব্যক্তির মস্তিষ্কের সাথে জড়িত। মাদকাসক্তির সাধারণ সংজ্ঞামতে সেসব বস্তুর ( যেমন- মদ, তামাক এবং অন্যান্য মাদক দ্রব্য) ব্যবহার বোঝায়, যা গ্রহণ করার পরে রক্ত মস্তিষ্কের প্রতিবন্ধক অতিক্রম করে সাময়িকভাবে মস্তিষ্কের রাসায়নিক দ্রব্যের পারিপার্শ্বিক অবস্থা পরিবর্তন করে। চিকিৎসাবীদদের ভাষ্য মতে, ব্যক্তি যখন মাদক গ্রহণ করে তখন তার মস্তিষ্ক দিয়ে একধরনের ডোপামিন নিঃসরিত হয়। যার ফলে কিছু সময়ের জন্য ব্যক্তির ভালো লাগা কাজ করে। মাদক গ্রহণের ফলে মানুষের মস্তিষ্ক থেকে যে ডোপামিন রিলিজ হয়, ঠিক একই ডোপামিন পর্ণোগ্রাফি দেখলে মস্তিষ্ক থেকে রিলিজ হয়। ফলে ব্যক্তি পুনরায় একই কাজে লিপ্ত হয়ে নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়ে।

বর্তমান বিশ্বে পশ্চিমা সংস্কৃতির ব্যাপক প্রয়োগের ফলে অনেকটা ম্যানুপুলেট করা হচ্ছে তাদের কৃষ্টি কালচারের প্রতি, যার আসক্তির জালে সমাজ,জাতি ভবিষ্যৎ প্রজন্ম জড়িয়ে পড়ছে খুব সহজে। কিশোর কিশোরীরা পর্ণো আসক্ত হয়ে একাডেমিক পাঠদান সামাজিক কার্যক্রম হতে বিচ্যুত হচ্ছে। তাছাড়াও পর্ণো গ্রাফির আড়ালে রয়েছে ভয়ঙ্কর এক অর্থনৈতিক ব্যবসা।বেডবিবল ওয়েবসাইটের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বর্তমানে পর্ণো শিল্প থেকে বিশ্বব্যাপী বার্ষিক আয় প্রায় ১০০ বিলিয়ন ডলার। যার মধ্যে শুধু সমাজমাধ্যম থেকেই আয় ৮৫ শতাংশ। অর্থাৎ, লাখ কোটি টাকার বেশি। বাকি টাকা আসে পত্রিকা এবং ডিভিডি বিক্রি করে। বিশ্বব্যাপী মোট আয়ের মধ্যে আমেরিকা থেকে পর্ণো শিল্পের বার্ষিক আয় লাখ কোটির বেশি। এই জগতের সঙ্গে যুক্ত বিশেষজ্ঞদের মতে দুদশক আগেও পর্ণো শিল্প কখনই এত বিস্তৃত ছিল না। আগামী ১০ থেকে ২০ বছরে এই শিল্পের আয় আরও ফুলেফেঁপে উঠবে বলেই মনে করছেন তারা। একটি রিপোর্ট মতে, আসলে পর্ণোগ্রাফির ভয়াবহতা কোনো সামাজিক সমস্যা নয়, এটি একটি দেশের জাতীয় রাষ্ট্রীয় সমস্যায় পরিনত হচ্ছে। একজন ব্যক্তির পর্নোগ্রাফিতে আসক্ত হওয়ার একাধিক কারণ থাকতে পারে। কিশোর কিশোরী প্রথম পর্যায়ে সহপাঠীদের মাধ্যমে উৎসাহিত হয়ে পর্ণো জগতে প্রবেশ করে, পরবর্তীতে ক্ষতির প্রভাব অনুভব করার আগেই তারা আসক্ত হয়ে যায়। পর্নোগ্রাফির রয়েছে সুদূর প্রসারিত ক্ষতি। পর্ণো আসক্ত ব্যক্তির মাঝে বিষন্নতা, হীনমন্যতা আত্মবিশ্বাসহীনতা পরিলক্ষিত হয়। ফলস্বরূপ তাদের মধ্যে সর্বদা অশান্তি, অস্তিরতা অমনোযোগীতা কাজ করে। আসক্ত ব্যক্তির চঞ্চলতা, উদ্দীপনা উদ্ভাবনী শক্তি লোপ পায়।

যেহেতু এটি দেখলে মস্তিষ্ক থেকে ডোপামিন রিলিজ হয় এবং ক্ষণস্থায়ী সময়ের জন্য ভালো লাগা কাজ করে, ফলে তারা আরও বেশি মানসিক শান্তির খোঁজে পর্ণো আসক্তিতে পতিত হয়। পর্ণোগ্রাফির মাত্রাতিরিক্ত প্রয়োগের ফলে পরবর্তীতে যেকোনো কাজে দীর্ঘ সময়ে মনযোগহীনতা, মেজাজ খিটখিটে, রুক্ষ আচরণ, রাতে পর্যাপ্ত ঘুম না হওয়া, স্মৃতিশক্তিলোপসহ নানা সমস্যা দেখা দেয়। পর্নো আসক্ত বাক্তির সর্বাধিক ক্ষতি হয় শারিরীকভাবে। যেসব পুরুষ অল্প বয়সে পর্নোগ্রাফিতে আসক্ত হয়ে পড়ে তাদের মধ্যে পুরুষতান্ত্রিক আধিপত্যও গড়ে উঠতে দেখা যায়। এছাড়াও দীর্ঘদিন ধরে পর্ণো আসক্ত ব্যক্তি পরবর্তীতে বাস্তবিক দাম্পত্য জীবনে অসুখী হয়ে থাকে। যেহেতু এটি একটি আসক্তি অধিক ক্ষেত্রে বিবাহের পরেও পর্ণো আসক্তি থেকে অনেকে বেরিয়ে আসতে পারে না।  ফলশ্রুতিতে দাম্পত্য জীবনে কলহ, বিবাদ, বিবাহ বিচ্ছেদসহ নানা সমস্যা দেখা দেয়। সামাজিক ক্ষেত্রে পর্ণো আসক্ত ব্যাক্তি নিজ ধর্মীয় দিক দিয়ে বিচ্ছিন্ন আত্মামর্যাদাহীন হয়ে পড়ে।

পর্ণোগ্রাফির ভয়াবহ পরিণতি হচ্ছে সমাজে অশ্লীলতা, ধর্ষণ, নারী পাচার বেড়ে যাওয়া। এটি একটি মহামারীর মতো যা ক্রমাগত সমাজকে করালগ্রাসে আছন্ন করছে। ভয়ঙ্কর ব্যাপার হলো অনেকে জানেই না তারা পর্ণোআসক্তিতে ভুগছেন। দীর্ঘদিন ধরে পর্ণো মুভির সাথে যুক্ত থাকার কারণে এটি তাদের কাছে স্বাভাবিক দৈনন্দিন জীবনের অংশে পরিণত হয়েছে। পর্ণো আসক্তি দূর করার কোনো স্থায়ী সমাধান নেই। তবে সবচেয়ে কার্যকরী উপায় সচেতনতা বৃদ্ধি। পর্ণো আসক্ত ব্যক্তি নিজের এটির ভয়াবহতা অবগত হতে হবে। বিজ্ঞদের সর্বাধিক গ্রহণযোগ্য মত হলো, পর্ণো আসক্ত ব্যক্তির নিজ ধর্ম যথাযথভাবে পালন করা। কিশোর-কিশোরীদের স্মার্টফোন কম্পিউটার ব্যবহারে সতর্ক হতে হবে। পরিবারের অভিভাবককে  কম্পিউটার অথবা স্মার্টফোন সন্তানের নিজ শয়ন কক্ষে না দিয়ে ঘরের এমন স্থানে রাখতে হবে যেখান থেকে পরিবারের অন্য সদস্যরাও সহজে পর্যবেক্ষণ করতে পারবে। যেহেতু এটি হীনমন্যতা হতাশার কারণে বেশি সংগঠিত হয়, তাই শারীরিক ব্যায়াম, খেলাধুলা আনন্দদায়ক বই পড়ে নিজেকে সর্বদা প্রফুল্ল রাখতে হবে। একঘেয়েমি জীবন আত্মবিশ্বাসের অভাব- এই দুটো মিলিয়ে ব্যক্তি আক্রান্ত হয় বিষণœতায়। এজন্য বাসা বাড়ি বা শয়নকক্ষে একা অবস্থান কমিয়ে সৎ চরিত্রবান বন্ধু সহপাঠীদের সাথে মিশতে হবে। কোনো ব্যাক্তি পর্ণো আসক্ত হলে বিশ্বস্ত আস্থাভাজন কারও নিকট গিয়ে থেকে উত্তরণের পরামর্শ নিলেও সমাধান পেতে পারেন।

শিক্ষার্থী, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া

×