ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১০ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৬ অগ্রাহায়ণ ১৪৩১

জীবন গঠনে পরিবারের ভূমিকা

মো. জাহিদ হাসান

প্রকাশিত: ১৮:০৩, ৯ নভেম্বর ২০২৪

জীবন গঠনে পরিবারের ভূমিকা

মানুষের জীবনে সম্পর্কের একটি প্রকৃষ্ট বন্ধন হলো পরিবার। জন্মের পর একটি শিশুর বেড়ে ওঠা শুরু হয় পরিবারে। এরপর মৃত্যু পর্যন্ত বিভিন্ন পরিবেশে মানুষের শারীরিক মানসিক বিকাশ ঘটতে থাকে। তবে জীবনের সকল পর্যায়েই মানুষের উপর পরিবারের প্রভাব থাকে। পরিবারের কারণে আমাদের জীবন সুন্দর হতে পারে। আবার পরিবারের কারণেই আমাদের জীবনে ঘটতে পারে নানা বিপত্তি। এটা নির্ভর করে পরিবারের যাবতীয় কার্যাবলীর উপর। পরিবারের সদস্যদের মধ্যে একে অন্যের প্রতি কিছু দায়িত্ব এবং অধিকার বর্তিত থাকে। যেমন- পরিবারের কর্তা বা বড় সদস্যদের উপর উপার্জনের দায়িত্ব থাকে। পরিবারের কর্তা বা উপার্জনকারী পরিবারের সদস্যদের মৌলিক চাহিদা মেটাতে দায়িত্ববান হয়ে থাকে। এছাড়া পরিবারের অন্য সদস্যরাও পরিবারের উন্নয়নে নানা কাজ করে থাকে। পরিবারের দায়িত্ববান সদস্যরা মৌলিক চাহিদা মেটাতে ব্যর্থ হলে বা তাদের স্বাভাবিক কার্যক্রমে বিঘœ ঘটলে পুরো পরিবারের উপরেই বিপর্যয় নেমে আসে। তবে যেকোন সংকট মোকাবিলার জন্য পরিবারের সব সদস্যই সাধ্য অনুযায়ী চেষ্টা করে।  পরিবারের একজন সদস্যের সমস্যায় বাকিরা এগিয়ে আসে। অন্যদিকে নিয়ম, শৃঙ্খলা সুশিক্ষার অভাবে আজকাল অনেক পরিবারের সদস্যদের মধ্যে দ্বদ্ব-সংঘাত সম্পর্কচ্ছেদের ঘটনা ঘটে। একারণে যৌথ পরিবার ভেঙে এখন এত বেশি একক পরিবার গড়ে উঠছে। তাই সুন্দর জীবন গঠনের জন্য আগে সুন্দর পরিবার গঠন করা জরুরী।

পরিবারের একটি প্রধান উদ্দেশ্য হলো সন্তান উৎপাদন লালন-পালন করা। একটি শিশুর শারীরিক মানসিক বিকাশের প্রাথমিক স্তর হলো পরিবার। শারীরিক সুস্থতার জন্য শিশুর পুষ্টি চাহিদা মেটানো পরিবারের অন্যতম দায়িত্ব। এরপর মানসিক বিকাশে পরিবারের নৈতিক শিক্ষা শিশুর জীবনে অতীব জরুরী। এছাড়া পরিবার থেকেই একটি শিশু ভদ্রতা, শিষ্টাচার শৃঙ্খলার চর্চা করার সুযোগ পায়। এছাড়া শিশুর জীবনে পরিবারের বড়দের স্নেহ শাসন উভয়েরই প্রভাব থাকা প্রয়োজনীয়। কিন্তু শাসনের নামে শিশুর প্রতি সহিংস আচরণ মোটেও কাম্য নয়। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) ইউনিসেফের ২০১৯ সালের একটি যৌথ জরীপের তথ্যমতে, বাংলাদেশে -১৪ বছর বয়সী শিশুদের ৮৮. শতাংশই তাদের লালনপালনকারীদের দ্বারা সহিংস আচরণের শিকার। একটি শিশুকে পরিবার এসবের কোনটি প্রদানে ব্যর্থ হলে শিশুর জীবন গঠনে বিঘœ ঘটে এবং শিশুর জন্য দুর্দশাগ্রস্থ ভবিষ্যৎ অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়ে। আজকাল শহরের অনেক পরিবারে পিতা-মাতা উভয়ই চাকরিজীবী হওয়ায় সন্তানকে প্রয়োজনীয় সময় দিতে পারেনা। ফলে সঠিক পরিবেশ না পাওয়ায় এরকম পরিবারের সন্তানদের মানসিক বিকাশ ঠিকভাবে হয় না। পিতামাতার তত্বাবধান না থাকায় এরকম পরিবারের সন্তানদের মাদকে জড়ানোর সম্ভাবনা বেশি থাকে। এছাড়া বর্তমানে কিশোর অপরাধ ভয়ানক একটি সামাজিক সমস্যা। কিশোর অপরাধের জন্য সবচেয়ে বেশি দায়ী পারিবারিক অসচেতনতা।  এটাতো বললাম শিশুর জীবনে পরিবারের প্রাথমিক মিকার কথা। কিন্তু জীবন গঠনের পরবর্তী পর্যায়গুলোতেও পরিবার প্রত্যক্ষ পরোক্ষভাবে মিকা রাখে।

শিক্ষা জীবনে এসে সবাইকে পরিবারের বাইরের পরিবেশে আসতে হয়। এসময় একটা শিশু তার সহপাঠী বন্ধুদের সাথে মিশে নতুন অভিজ্ঞতা আচরণ লব্ধ হয়। পরিবার থেকে সুশিক্ষা পেলে এসময় শিশুর উপর ইতিবাচক প্রভাব পড়ে, অন্যথায় নেতিবাচক প্রভাব পড়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। পরিবার থেকে নীতি-নৈতিকতার শিক্ষা পেয়ে থাকলে বেশিরভাগ শিশু জীবনের পরবর্তী পর্যায়ে গিয়ে সৎ নৈতিক গুণসম্পন্ন হয়ে ওঠে। আর যে শিশু পরিবারে উচ্ছৃঙ্খল পরিবেশে অযতেœ লালিত হয় সে পরবর্তীতে অমানবিক হয়ে ওঠে এবং তার মধ্যে নানা সামাজিক অপরাধে জড়িত হওয়ার প্রবণতা থাকে। শিশু পরিবারের বাইরের পরিবেশে যাওয়ার পরও অভিভাবকদের কর্তব্য হলো সন্তানের সার্বক্ষণিক খেয়াল রাখা। কেননা পরিবার থেকে সুশিক্ষা পেলেও খারাপ পরিবেশের প্রভাবে ধীরে ধীরে শিশু অসাধু কাজে জড়াতে পারে। মাদকের প্রকোপ বৃদ্ধির কারণে এখন এটি খুব দ্রæ ঘটে। ডিএনসি' ২০২০ সালের মাদকের একটি বয়সভিত্তিক জরীপে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে .৫৭ শতাংশ মাদকসেবিদের বয়স ১৫ বছরের নিচে এবং ১৭.২৬ শতাংশ মাদকসেবিদের বয়স ১৬-২০ বছরের মধ্যে।

জীবনের নানা উত্থান-পতনের পর  বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে গিয়ে সবারই নিজ জীবনের ভালো-মন্দ বা গ্রহণীয়-বর্জনীয় বিষয় সম্পর্কে ধারণা হয়। মানসিকভাবে সবাই শক্তিশালী হয়ে ওঠে। কিন্তু ক্যারিয়ার গঠনের এই শেষ পর্যায়ে এসে মানসিক চাপটাও থাকে অনেক। তাই হতাশায় জর্জরিত হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে আত্মহত্যার ঘটনা বেশি ঘটে থাকে। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষার্থী ভয়ানকভাবে মাদকে জড়িত। সংবাদপত্রের তথ্যমতে, এক জরীপে বলা হয়েছে যে দেশের ৮০ শতাংশ শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে হতাশার নানা উপসর্গে ভোগেন। এসময় বেশিরভাগ শিক্ষার্থী পরিবার থেকে প্রথমবারের মতো দূরে গিয়ে বাস করে। এজন্য সম্পর্ক তৈরির ব্যর্থতা, ক্যারিয়ার নিয়ে হতাশা ইত্যাদি নানা কারণে মানুষ এসময় ভেঙে পড়ে। তাই এসময় পারিবারিক সমর্থন আরও বেশি জোড়দার করা দরকার।

কর্মক্ষেত্রে গিয়ে একজন মানুষ পরিবারের হাল ধরে। যে পরিবার থেকে এতকাল নানা সমর্থন পেয়েছে, কর্মক্ষেত্রে গিয়ে একজন মানুষ সেই পরিবারের দায়িত্ব নিয়ে থাকে। এসময় একজন মানুষ প্রাথমিকভাবে বৃদ্ধ পিতা-মাতার দেখাশোনা সন্তান লালন-পালনের দায়িত্ব গ্রহণ করে। জীবনের এই চরম পর্যায়ে এসেও পরিবার একজন মানুষকে সর্বাত্মক সমর্থন দেয়। সংসারের নানা সংকটে অথবা উন্নয়নে পারিবারিক সম্পত্তি অনেক বড় একটা হাতিয়ার হিসেবে কাজ করে। এজন্যই বলা যায় যে পরিবার আমাদের জীবনে আমৃত্যু মিকা পালন করে। বিবাহের মাধ্যমে পরিবার গঠিত হয়। তাই একটি সুন্দর পরিবার গঠনে বিবাহের বিবাহের প্রতি সতর্ক হওয়া দরকার। বিবাহের উপর নির্ভর করে পারিবারিক শৃঙ্খলা। এজন্য নবদম্পতিদের মধ্যে বয়সের পরিণতি, মানসিক মিল, উপার্জন ক্ষমতা, শিক্ষাগত যোগ্যতা এবং অন্যান্য বিষয়ে যথার্থতা সম্বন্ধে খেয়াল রাখা জরুরী।

মানুষ সামাজিক জীব। আর সমাজ গঠনের মূলে রয়েছে পরিবার। ব্যক্তি জীবন, সমাজ পরিবার একটি আরেকটির সাথে আঙ্গাআঙ্গিভাবে জড়িত। তাই সামাজিক উন্নয়নের জন্য পারিবারিক উন্নয়ন যেমন জরুরী, তেমনি সুশৃঙ্খল পরিবার গঠনের জন্য কিছু সামজিক সমস্যা দূরীকরণও জরুরী। যেমনশিক্ষার উন্নয়ন, বাল্যবিবাহ রোধ, দারিদ্র্য বিমোচন করা, শিশুশ্রম বন্ধ করা, সরকারি চিকিৎসার প্রসার ঘটানো এবং জনসচেতনতা তৈরি করা। পরিবারের উপর যেমন এসব সামাজি সমস্যার প্রভাব রয়েছে, তেমনি এসব সামাজিক সমস্যা তৈরিতেও পরিবারের প্রভাব রয়েছে, অর্থাৎ বিভিন্ন সামাজিক সমস্যার কারণে সুশৃঙ্খল পরিবার গঠন সম্ভব হয় না, আবার পারিবারিক বিশৃঙ্খলতার কারণে সামাজিক সমস্যাগুলো তৈরি হয়।

জীবন গঠনে পরিবারের মিকা সম্পর্কে সচেতনতা তৈরির সাথে সাথে সুন্দর সুশৃঙ্খল পরিবার গঠনের জন্য কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। তাহলে দেশের প্রতিটি মানুষ সুনাগরিক হিসেবে গড়ে উঠবে, প্রতিটি জীবন হবে সুন্দর এবং সমাজ হবে শৃঙ্খলিত উন্নত।

 

শিক্ষার্থী, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া

×