বিশ্ববিদ্যালয়ে জ্ঞানচর্চা সৃজন কর্মকাণ্ডকে অগ্রাধিকার
জ্ঞানচর্চা, জ্ঞান সৃজন, জ্ঞান বিস্তরণ এবং জনকল্যাণে সৃজনকৃত জ্ঞান প্রয়োগই বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম লক্ষ্য। এই বিষয়টি সামনে রেখে শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা মুক্তবুদ্ধির চর্চা করবে, সমাজ কিংবা রাষ্ট্রের নানা অসংগতি, অনিয়ম ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে বুদ্ধিভিত্তিক প্রতিরোধ গড়ে তুলবে, এটাই স্বাভাবিক।
উপরন্তু জ্ঞান-বিজ্ঞানের নবতর দিক নিয়ে গবেষণার মাধ্যমে জ্ঞান সৃজন করবে, পুরনো বিষয় নিয়ে নতুনভাবে চিন্তা করবে, প্রচলিত ধারণাগুলোকে প্রশ্ন করবে ও নতুন উত্তর অন্বেষণ করবে। অতঃপর সৃজনকৃত জ্ঞান ও পরিবর্তিত ধারণা শিক্ষার্থীদের মাঝে বিস্তরণ এবং জনকল্যাণে উক্ত গবেষণালব্ধ ফলকে কাজে লাগিয়ে আর্থ-সামাজিক উন্নয়নসহ গণতন্ত্র, মানবাধিকার, ন্যায় বিচার ও সাম্য প্রতিষ্ঠার প্রয়াস অব্যাহত রেখে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করবে।
শিক্ষার্থীকেন্দ্রিক শিক্ষাদান পদ্ধতি, নিরবচ্ছিন্ন মূল্যায়ন প্রক্রিয়া, কৌশলগত গবেষণা পরিকল্পনা প্রণয়ন এবং এর যথাযথ বাস্তবায়ন, একাডেমিক মাস্টার প্ল্যান তৈরি, ক্লাসের আকার, যোগ্যতাসম্পন্ন শিক্ষক নিয়োগ, মানসম্পন্ন ল্যাব স্থাপন, অনুকূল শিক্ষার পরিবেশ, অবকাঠামোগত উন্নয়ন প্রক্রিয়া ইত্যাদি শিক্ষার মান উন্নয়নের জন্য অপরিহার্য। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা, ২০৩০ সামনে রেখে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে গবেষণাকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে।
চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় তরুণ প্রজন্মকে গড়ে তুলতে মানসম্মত শিক্ষা, প্রযুক্তি ও গবেষণার ওপর অন্তর্বর্তী সরকার সর্বাধিক জোর দিচ্ছে। উল্লেখ্য, বিগত এক দশকে ইউজিসি দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গবেষণা খাতে বরাদ্দকৃত অর্থের পরিমাণ ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি করেছে, যা সারণি-১-এ উপস্থাপন করা হলো :
সারণি-১: ইউজিসি কর্তৃক গবেষণা খাতে বরাদ্দ-
অর্থবছর গবেষণা খাতে বরাদ্দ (কোটি টাকায়)
২০১৩-২০১৪ ১২.৪১
২০১৪-২০১৫ ১৫.০৬
২০১৫-২০১৬ ১৯.৪০
২০১৬-২০১৭ ৩২.৫৮
২০১৭-২০১৮ ৫৯.৪০
২০১৮-২০১৯ ৭২.৭০
২০১৯-২০২০ ৭৬.৩৯
২০২০-২০২১ ৮২.১৫
২০২১-২০২২ ১১৮.৭৪
২০২২-২০২৩ ১৫০.০০
২০২৩-২০২৪ ১৭৪.০০
২০২৪-২০২৫ ২১০.২০
উৎস : বার্ষিক প্রতিবেদন, ইউজিসি
গবেষণা খাতে শুধু বরাদ্দ বৃদ্ধি করলেই হবে না বরং উক্ত বরাদ্দকৃত অর্থ যথাযথভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে কিনা তার স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিতকল্পে ইউজিসির নির্দেশনা ও নিয়মিত মনিটরিং অতীব জরুরি। অন্যথায় বরাদ্দকৃত অর্থ গবেষণার নামে চর্বিত চর্বণ কাজে ব্যবহার হওয়ার সম্ভাবনা থেকেই যায়। ফলে উক্ত গবেষণা দেশ ও জনকল্যাণে কোনো কাজে আসবে না।
এটা সত্য যে, বর্তমানে বাংলাদেশের অর্থনীতির চাকাকে সচল রাখার ক্ষেত্রে তিনটি পিলারই শরীরের ঘাম ফেলে কাজ করে যাচ্ছে। একটি হচ্ছে গার্মেন্টস কর্মী, যাদের অধিকাংশই নারী; দ্বিতীয়টি হচ্ছে, কৃষক, যাদের আমরা অবহেলার চোখে দেখি; আর তৃতীয়টি হচ্ছে প্রবাসী শ্রমিক, যারা বিদেশবিভূঁইয়ে নিঃসঙ্গ জীবনে দেশের জন্য রেমিটেন্স অর্জন করে যাচ্ছেন।
অথচ আমাদের মতো অধিকাংশ শিক্ষিত জনগোষ্ঠী যারা মস্তিষ্ক দিয়ে কাজ করি, তারা এখনো অর্থনীতির চতুর্থ পিলার হয়ে উঠতে পারিনি। যেদিন আমরা আমাদের মেধাকে কাজে লাগিয়ে গবেষণার মাধ্যমে নতুন জ্ঞান সৃজন ও বিস্তরণের মাধ্যমে পণ্য, সেবা, প্রযুক্তি ক্ষেত্রে নতুনত্ব উদ্ভাবন করে তা দেশ ও মানবতার কল্যাণে কাজে লাগাতে পারব সেদিনই দেশের প্রতি আমাদের দায়বদ্ধতা শোধ হবে।
বর্তমান বিরাজমান শিক্ষা ব্যবস্থা এবং এর কার্যক্রমকে এমনভাবে ঢেলে সাজাতে হবে যেন শিক্ষার্থীরা প্রতিদিন কি শিখছে, কেমন করে শিখছে, উপস্থাপনার দক্ষতা নিরূপণসহ সূক্ষ্ম চিন্তার দক্ষতা, সমস্যা চিহ্নিতকরণ ও সমাধানের দক্ষতা, সিদ্ধান্ত গ্রহণের দক্ষতা, যৌথ প্রচেষ্টার দক্ষতা ও দলগতভাবে কাজ করার সক্ষমতা অর্জন করতে পারে।
এতে শিক্ষার্থীদের পরবর্তীতে কর্মজগতে প্রবেশের ক্ষেত্রে কোনো সমস্যার সম্মুখীন হতে হবে না। উপরন্তু, স্ট্রাটেজিক প্ল্যান ফর হায়ার এডুকেশন এবং ন্যাশনাল স্ট্রাটেজিক প্ল্যান ফর হায়ার এডুকেশন কলেজের সুপারিশগুলো যথাযথভাবে বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষার গুণগতমান অনেকাংশে বৃদ্ধি পাবে।
শিক্ষার মান উন্নয়ন, জ্ঞান সৃজন ও বিস্তরণ এবং জনকল্যাণে গবেষণা ও উদ্ভাবন অপরিহার্য। শিল্প উদ্যোক্তা, এলামনাই, সরকার ও শিক্ষাসংশ্লিষ্ট সবাইকে তা উপলব্ধি করতে হবে। স্বাধীনতার ৫৩ বছরে দেশের উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থার সংখ্যাগত উন্নয়ন আশাপ্রদ হলেও মানের উন্নয়ন সেভাবে হয়নি। তাই শিক্ষার মান উন্নয়নের জন্য শিক্ষা ও গবেষণার অনুকূল পরিবেশ ও সংস্কৃতি গড়ে তুলতে হবে, যা প্রকারান্তরে উচ্চশিক্ষার আন্তর্জাতিক মান বজায় রাখতে সহায়ক হবে।
শিক্ষাই শক্তি, শিক্ষাই আলো, শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড ও উন্নতি, সমৃদ্ধির একমাত্র সোপান। পৃথিবীর কোন দেশ কত বেশি উন্নত, তা সে দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার দিকে তাকালেই বোঝা যায়। বিশ্ববিদ্যালয়সহ প্রতিটি শিক্ষাঙ্গনে জ্ঞান চর্চা, জ্ঞান সৃষ্টি ও জ্ঞান বিস্তরণের কর্মকা-কে অগ্রাধিকার দেওয়ার নিমিত্তে ইউনেস্কোর সুপারিশ অনুযায়ী শিক্ষা খাতে বাজেট বরাদ্দকে অগ্রাধিকার দিতে হবে।
শিক্ষাব্যবস্থার সংস্কারের মাধ্যমে আগামীতে আমাদের সেই পথই অনুসরণ করা উচিত যে পথে সমাজে অবহেলিত ও পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে শিক্ষায় অন্তর্ভুক্তিকরণের মাধ্যমে একটি বিজ্ঞানমনস্ক, যুগোপযোগী, কর্মসংস্থানমুখী, বৈষম্যহীন, সমতাভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তুলতে সক্ষম হতে পারি।
লেখক : বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, অধ্যাপক, সাবেক সদস্য, বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) ও সাবেক উপাচার্য
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়