ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ১০ ডিসেম্বর ২০২৩, ২৬ অগ্রাহায়ণ ১৪৩০

রক্তাক্ত মাতৃভাষা-২

মোস্তাফা জব্বার

প্রকাশিত: ২২:২৯, ১ অক্টোবর ২০২৩

রক্তাক্ত মাতৃভাষা-২

.

এর চেয়ে বড় আন্দোলন হয় ১৯৬৫ সালে, যখন হিন্দিকে একমাত্র সরকারি ভাষা করা হয় কিংবা স্বয়ংক্রিয় ভাবে হয়ে যায়, তারও ১৫ বছর আগের ১৯৫০ সালের আইনের কারণে (লক্ষণীয়, হিন্দিকে একমাত্র সরকারি ভাষা বানানোর সিদ্ধান্ত ১৯৪৬ এর পর বিভিন্ন আলোচনায় প্রস্তাবনা করা হয় এবং তা ১৯৫০ সালেই আইন হিসেবে গৃহীত হয় যে, ১৫ বছর পর ৬৫-তে কার্যকর হবে এবং মজার বিষয় হলো আইন কার্যকর না হওয়া পর্যন্ত এটা নিয়ে উচ্চবাচ্য হয়নি। হিন্দিকে একমাত্র সরকারি ভাষা করা রাজনৈতিক দল কংগ্রেসের সিদ্ধান্ত তথা ভারতের প্রধানমন্ত্রী নেহেরুর ইচ্ছা ছিল। জোর করে নৃতাত্ত্বিক এবং সাংস্কৃতিক পরিচয়কে রাষ্ট্রের সঙ্গে মিশিয়ে রাষ্ট্রকে লিঙ্গুইস্টিক কিংবা কালচারাল হোমজেন্যাস বানানোর তাঁর এবং তাঁর সহযোগীদের একরকম সংকীর্ণ সাম্রাজ্যবাদী চিন্তা-চেতনা ছিল এমন চেষ্টা, জোর করে ধর্মের সঙ্গে রাষ্ট্রকে মেশানোর চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। প্রধানমন্ত্রী নেহেরুর ব্রিটিশ ভারতীয় আমলের সহকর্মী পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল জিন্নাহ এবং তাঁর সহযোগীরা একই কাজ করেছিলেন

সেই বছর, ২৬-জানুয়ারি, ১৯৬৫ তে এর বিরুদ্ধে তীব্রভাবে আন্দোলন শুরু হয়, মানুষ রাস্তায় নেমে আসে দলে দলে। প্রায় দুইমাস যাবৎ দাঙ্গা হয় দক্ষিণে, বিশেষ ভাবে মাদ্রাজে। প্রায় ১০০-৫০০ লোকের মৃত্যু হয়। সারা দক্ষিণ ভারত বিশেষভাবে তামিলনাড়ু উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। এর প্রতিবাদে আত্মাহুতির ঘটনাও ঘটে। আন্দোলনের পক্ষাবলম্বনকারী রাজনৈতিক দলগুলো বিজয়ী হয় তাদের ১৯৬৭ বিধানসভা নির্বাচনে। বিজয়ী রাজনৈতিক দলগুলো হতে তাদের রাজ্যকে গণতান্ত্রিকভাবে ভারত ইউনিয়ন ত্যাগ করারও হুমকি দেওয়া হয়।

শেষ পর্যন্ত ১৯৬৭ সালে হিন্দির সঙ্গে ইংরেজিকেও ব্যবহারিক সরকারি ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। ভারতে বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরিদের ভাষা আন্দোলনও রক্তক্ষয়ী অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে গিয়েছে। ১৯৬০ সালের মার্চ অসমের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বিমলাপ্রসাদ চালিহা বিধানসভায় অসমিয়াকে অসম রাজ্যের সরকারি ভাষা ঘোষণা করা হবে বলে জানালে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে এবং বাংলাকে সরকারি ভাষা করার জোর দাবি উত্থাপন করা হয়। ১৯৬০ সালের ২১ ২২ এপ্রিল কংগ্রেস কমিটির গুরুত্বপূর্ণ সভায় সাকল্যে ৩১ শতাংশ মানুষের ভাষা অসমিয়া ভাষাকে রাজ্যের একমাত্র রাজ্যভাষারূপে স্বীকৃতিদানের লক্ষ্যে একটি প্রস্তাব ৫০: ১০ ভোটে পাস হয়ে যায় এবং অচিরেই প্রস্তাবটি কার্যকর করার জন্য কংগ্রেসি মন্ত্রিসভাকে নির্দেশ দেওয়া হয়। জুলাই শিলচরে ডাকা হয়নিখিল অসম বাংলা অন্যান্য অনসমিয়া ভাষা সম্মেলন প্রতিনিধিদের মধ্যে ছিলেন লুসাই-খাসিয়া-গারো, মণিপুরি, বাঙালি সবাই। সর্বসম্মতিক্রমে প্রস্তাব গৃহীত হয়, ‘ভাষার প্রশ্নে স্থিতাবস্থা বজায় থাকবে।ভাষার প্রশ্নে হস্তক্ষেপ করতে কেন্দ্রের কাছে আবেদন জানানো হয়। ১০ অক্টোবর রাজ্যভাষা বিল পাস হয় বিধানসভায়। নতুন আইনে পুরো অসমে সরকারি ভাষা হলো অসমিয়া। পুরো কাছাড় প্রতিবাদে সোচ্চার হয়ে উঠল, ‘ রাজ্যভাষা বিল আমরা মানি না, মানব না। বাংলাকে সরকারি ভাষা করতে হবে।

১৯৬১ সালের ১৫ জানুয়ারি শীলভদ্র যাজীকে সভাপতি করে করিমগঞ্জে সম্মেলন ডাকা হলো। শিলচর সম্মেলনে ভাষার প্রশ্নে পুরো কাছাড় এক মন এক প্রাণ হয়ে শপথ নিল, ‘জান দেব, তবু জবান দেব না। মাতৃভাষার মর্যাদা যেকোনো মূল্যে রক্ষা করবই। ফেব্রুয়ারি করিমগঞ্জ রমণীমোহন ইনস্টিটিউটে কাছাড় জেলা সম্মেলনে বাংলাকে অসমের অন্যতম রাজ্যভাষারূপে মানার সিদ্ধান্ত হয়। সেই সঙ্গে অসম সরকারের কাছে চিঠি পাঠিয়ে ১৩ এপ্রিলের মধ্যে শেষ জবাব চাওয়া হয়। ১৩ এপ্রিলের মেয়াদ শেষ হলেও কোনো জবাব না পেয়ে অসহযোগ সত্যাগ্রহ আন্দোলনের নতুন তারিখ ঘোষণা করা হয় ১৯ মে।

সংগ্রাম পরিষদের পূর্বসিদ্ধান্ত মতো ১৯৬১ সালের ১৮ মে রাত ১২টার পর থেকে তরুণ-তরুণীসহ বিভিন্ন বয়সের প্রায় ১০ হাজার মানুষ শিলচর রেলস্টেশনে অহিংস অবস্থান ধর্মঘট করার জন্য সমবেত হতে থাকে।

১৯ মে ভোর ৪টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত হরতাল ডাকা হয় বরাক উপত্যকায়। সকাল থেকে দলে দলে লোক জড়ো হয় তারাপুর রেলস্টেশনে। সবাই রেললাইনের ওপর বসে পড়ে সমস্বরে ধ্বনি তুলল, ‘জান দেব, জবান দেব না। মাতৃভাষা জিন্দাবাদ।

শুরু হয় তুমুল আন্দোলন। উত্তেজিত জনতাকে প্রতিরোধে সরকারি বাহিনী ট্রেন চালাতে ব্যর্থ হয়। ১৯ মে বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আন্দোলনে অংশগ্রহণকারীর সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। পুলিশ তাদের অনেককেই গাড়িতে তুলে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যায়। পুলিশ কয়েক দফায় লাঠিপেটা করে, কাঁদানে গ্যাস ছোড়ে এবং তাদের সাহায্যে এগিয়ে আসেন অনেক রেলকর্মচারী। বেলা আড়াইটার দিকে রেলস্টেশনে কর্তব্যরত বিএসএফের সদস্যরা হঠাৎ গেরিলার ভঙ্গিতে গুলিবর্ষণ শুরু করলে গুলিবিদ্ধ হয়ে তৎক্ষণাৎ শহীদ হন নয়জন। তাঁরা হলেন সুনীল সরকার, সুকোমল পুরকায়স্থ, কুমুদ দাস, ন্ডীচরণ সূত্রধর, তরণী দেবনাথ, হীতেশ বিশ্বাস, শচীন্দ্র পাল, কমলা ভট্টাচার্য, কানাই নিয়োগী।

পরদিন স্টেশনের পুকুর থেকে সত্যেন্দ্রকুমার দেবের বুলেটে বিক্ষত দেহ উদ্ধার করা হয়। রাতে হাসপাতালে মারা যান বীরেন্দ্র সূত্রধর। মোট ভাষা শহীদের সংখ্যা দাঁড়ায় ১১। ১৯ মে পুরো দিনটি ছিল উত্তাল ঘটনাবহুল। প্রশাসন কারফিউ জারি করে। গ্রেপ্তার করা হয় প্রায় সাড়ে ছয় হাজার মানুষকে। কিন্তু তাতেও ক্ষান্ত হননি আন্দোলনকারীরা। তাঁদের রক্ত আর আত্মত্যাগের বিনিময়ে অবশেষে ওই অঞ্চলের সরকারি ভাষা হিসেবে বাংলাকে প্রশাসনিক স্বীকৃতি দিতে কর্তৃপক্ষ বাধ্য হয়। ১১ জন ভাষাশহীদের রক্তের বিনিময়ে অবশেষে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী লালবাহাদুর শাস্ত্রী প্রদত্ত সূত্রের ওপর ভিত্তি করে গৃহীত সংশোধনী আইনে কাছাড় জেলায় বাংলা ভাষা ব্যবহারের অধিকার স্বীকার করে নেওয়া হয়। এভাবেই অসম রাজ্যে ভাষা আন্দোলন চূড়ান্ত পরিণতি লাভ করে এবং বাংলা ভাষা বিধানসভায় সরকারি ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি পায়।

এরপরও বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষা করতে গিয়ে ১৯৭২ সালের ১৭ আগস্ট বাচ্চু চক্রবর্তী নামের একজন মৃত্যুবরণ করেন। অক্টোবর মারা যান মোজাম্মেল হক। অক্টোবর রহস্যজনকভাবে নিরুদ্দিষ্ট হন অনিল বরা। ১৯৮৫ সালের ২৪ জুন কৃষ্ণ কান্ত বিশ্বাস ১৯ মের গুলির ক্ষতজনিত কারণে মৃত্যুবরণ করেন। ১৯৮৬ সালে ২১ জুন দুজন মারা যান, তাঁদের নাম দিব্যেন্দ দাস, জগন্ময় দেব। তাঁদের এই আত্মত্যাগ বিশ্বে তেমন প্রচার পায়নি, এমনকি পশ্চিম বাংলা বা বাংলাদেশের মানুষের কাছেও নয়, যা খুবই দুঃখজনক।

উল্লেখ্য, ভারতে আইনগতভাবেরাষ্ট্র ভাষাকিংবাজাতীয় ভাষাপরিভাষাটি ব্যবহার করা হয় না। বর্তমানে ভারতে ২২টি ভাষাকে সরকারিভাবে তালিকাভুক্ত ভাষা এবং ৪টি ভাষাকে ঐতিহ্যবাহী/ধ্রুপদী ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। ইংরেজিকে বিশেষ মর্যাদা দেওয়া হয়েছে ব্যবহারিক কারণে। কেন্দ্রীয়ভাবে অফিস আদালতে হিন্দি এবং ইংরেজি ব্যবহৃ হয়। প্রতিটি রাজ্যেও নিজস্ব ভাষা ব্যবহার করা হয় নিজেদের আভ্যন্তরিক দাপ্তরিক কাজের জন্য। যদিও ভারতে মোট ভাষার সংখ্যা ১০০-এরও ওপর। তবুও অন্তত ২২টি ভাষা ভারতের প্রাদেশিক ভাষার স্বীকৃতি হলেও পেয়েছে। আপাতত ভারতের মাতৃভাষার জনগোষ্ঠী এতেই শান্ত মনে হলেও মাঝে মধ্যেই ভারতে ক্ষুদ্র জাতিসত্তার আন্দোলন বা আঞ্চলিকতার লড়াই মাথা উঁচু করে দাঁড়ায়। ভারতের পূর্বাঞ্চল বন্তু একটি বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের কেন্দ্র। বাংলাদেশের শেখ হাসিনা সরকারের সহায়তায় ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার এসব বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনকে আয়ত্তে রাখতে পারলেও এই অঞ্চল বিভিন্ন মাতৃভাষাকে কেন্দ্র করে ভাষার লড়াই গড়ে উঠতেই পারে। ডিজিটাল যন্ত্রে ইংরেজি ছাড়াও অন্যান্য ভাষা সহজে ব্যবহার সুবিধা পাওয়া যাওয়ার ফলে মাতৃভাষা সুরক্ষার আন্দোলন ভবিষ্যতে জোরদার হতেই পারে। বাংলাদেশ সরকার বাংলাদেশের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ভাষায় শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করে একটি অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। অন্যান্য বহুভাষিক দেশ এই পদ্ধতিটি অনুসরণ করতে পারে।

বেলুচ, পাঞ্জাবি উর্দু: ব্রিটিশ উপনিবেশ ভারতকে দুভাগে ভাগ করে দুটি সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র গড়ে তোলার মধ্য দিয়ে পাকিস্তান ভারত দুটি রাষ্ট্রেই ভাষার সংকটের পাশাপাশি জাতিসত্তার সংকটও তৈরি  করে দিয়ে যায়। ষাট সত্তর দশকে বাঙালিদের স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় পাকিস্তানের বেলুচিস্তান, সিন্ধু, পেশোয়ার ইত্যাদি অঞ্চলেও ভাষাভিত্তিক স্বাধীনতা আন্দোলন দানা বাঁধতে থাকে। দুর্ভাগ্য তাদের যে যথাযথ নেতৃত্বের অভাবে বেলুচিস্তানের ভাষা আন্দোলন বা স্বাধীনতা আন্দোলন কোনোটাই সুসংগঠিত হতে পারেনি। তাদের ভাষার দাবির পাশাপাশি স্বাধীনতার দাবি অনেক জোরালো। তাদের প্রতি আফগানিস্তানের সমর্থন রয়েছে।

পাকিস্তান দাবি করে বেলুচদেরকে ভারত সহায়তা করে থাকে। বেলুচরা ওমান, আরব আমিরাত, সুইডেন নরওয়ে থেকে সমর্থন পায় বলেও দাবি করা হয়। বেলুচ আন্দোলনের ইতিহাসকে ১৯২০ সালে সূচনা বলে  মনে করা হয়। ১৯৩৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে কালাত জাতীয় পার্টি গঠন করে বালুচরা সংগঠিত হতে চেষ্টা করে। অন্যদিকে করাচিতে বসবাসরত বালুচ বুদ্ধিজীবীরা গঠন করে বালুচ লীগ। পাকিস্তানে পাঞ্জাবি ভাষার জন্যও আন্দোলন চলছে। পাকিস্তানের পাঞ্জাবিরা তাদের মাতৃভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে চায়। এমনকি উর্দুভাষীরাও উর্দুর একাধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে চায়। বহুভাষিক বহুজাতিক বিভিন্ন সংস্কৃতির দেশ পাকিস্তান কেবল বাঙালিদের বিদায় করে ভাষা-সংস্কৃতি নিয়ে সুখে নেই। ফলে, যেভাবে তারা ধর্মের নামে পাকিস্তান সৃষ্টি করেছিল, একইভাবে ধর্ম, সাম্প্রদায়িকতা মৌলবাদকে ভিত্তি করেই পাকিস্তানকে সামনে নিতে চেষ্টা করছে।  অসাম্প্রদায়িক, বহুভাষিক, সাংস্কৃতিক ধর্মীয় বৈচিত্র্য বজায় রেখে একটি রাষ্ট্র টিকিয়ে রাখা যে কঠিনতম, সেটি পাকিস্তান প্রবলভাবে টের পাচ্ছে। ভারতেও তেমন চ্যালেঞ্জ আছে। তবে ভালো ব্যবস্থাপনার দিক থেকে ভারতের অবস্থা উল্লেখ্য।

ঢাকা, ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৩

লেখক : তথ্যপ্রযুক্তিবিদকলামিস্ট, দেশের প্রথম ডিজিটাল নিউজ সার্ভিস আবাস-এর চেয়ারম্যান- সাংবাদিক, বিজয় কীবোর্ড সফটওয়্যার-এর জনক

সঁংঃধভধলধননধৎ@মসধরষ.পড়স িি.িনরলড়ুবশঁংযব.হবঃ

িি.িনরলড়ুফরমরঃধষ.পড়স