ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

’৭১-এর গণহত্যাকে যেন ভুলে না যাই

মমতাজ লতিফ

প্রকাশিত: ২০:৫০, ৮ ডিসেম্বর ২০২২

’৭১-এর গণহত্যাকে যেন ভুলে না যাই

বাঙালির জাতির স্বাধীনতার জন্য এত বিশাল গণহত্যার শিকার

বাঙালির জাতির স্বাধীনতার জন্য এত বিশাল গণহত্যার শিকার অন্য কোনো জাতিকে হতে হয়েছে বলে জানি না। বাঙালি জাতির মতো আর কোনো জাতিকে তার খ্যাতনামা শীর্ষস্থানীয় বুদ্ধিজীবীদের স্বাধীনতার বেদিমূলে উৎসর্গ করতে হয়েছিল বলেও জানি না। বাঙালি জাতির মতো এত অল্প সময়ে তার শ্রেষ্ঠ সন্তান ত্রিশ লাখ মুক্তিযোদ্ধার প্রাণ এবং প্রায় তিন লাখ বীর নারীকে তাদের সম্ভ্রম বিসর্জন দিতে হয়েছিল কিনা জানা নেই তাও।

দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের চার বছরে হিটলারের জাতিগত বিদ্বেষের বলি কয়েক লাখ ইহুদিকে নাৎসিদের পরিকল্পিত গ্যাসচেম্বারে প্রাণ দিতে হয়েছিল! বাংলাদেশ, সাবেক পূর্ব পাকিস্তান, ভারত উপমহাদেশের স্বাধীনতার সময় ১৯৪৭ সালে পাকিস্তানের অংশ হয়ে প্রথম স্বাধীনতা লাভ করে প্রধানত মুসলমানদের সর্বক্ষেত্রে উন্নয়নের লক্ষ্যে সে সময়ের বাঙালি রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সমর্থনে। কেন ’৪৭-এর স্বাধীনতা বাঙালি জাতিকে নতুন এক নির্দয় উপনিবেশীয় শাসকের পদতলে নিক্ষেপ করেছিল সে প্রকট বৈষম্যের বিস্তারিত তথ্য এখন সব পাঠকের জানা।

বাঙালি রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ পাকিস্তানি সামরিক-বেসামরিক আমলা শাসকদের গণতন্ত্র দূরে থাক, সব রকমের আইন-কানুন অগ্রাহ্য করে এক স্বৈরশাসনের অধীনস্থ হয়ে রাষ্ট্রের প্রতিটি ক্ষেত্রে বৈষম্যের শিকার হতে দেখে নিশ্চিত হয়েছিল- ‘ইয়ে আজাদী ঝুটা হায়!’ কোনো জাতিকে নিশ্চিহ্ন করতে স্বৈরশাসক প্রথম হামলা চালায় ঐ জাতির ভাষা ও সংস্কৃতির ওপর। ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতি হচ্ছে একটি জাতির হৃৎপি-। এটির স্পন্দমান, বহমান অস্তিত্ব জাতিকে নদীর স্রোতধারার মতই সর্বক্ষেত্রে উর্বরতা প্রদান করে তার সমৃদ্ধি ঘটায়।

বাঙালি দেখেছে, ’৪৭-এর স্বাধীনতার পর মাত্র পাঁচ বছরের মধ্যে জাতির ছাত্র-যুব সমাজকে, বঙ্গবন্ধুসহ তরুণ রাজনীতিকদের ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’-এই অমৃত স্লোগান তুলে আন্দোলনে নামতে হয়েছিল। নিজ মাতৃভাষার সুরক্ষা এবং ভাষার ভিত্তিতে বিকশিত রবীন্দ্র-সাহিত্য থেকে শুরু করে সব সাহিত্য-লোকসাহিত্য, সংগীত, চারু-কারুকলার সর্বক্ষেত্রকে পাকিস্তানি স্বৈরশাসকের অন্যায়, নীতিহীন শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করার লড়াই শুরু করতে হয়। ভাষার লড়াই থেকে বাঙালি স্বাধিকার ও স্বাধীনতার লড়াইয়ের দিকে যাত্রা শুরু করে ১৯৭১-এ। বলা চলে ১৯৬৬- এর ছয় দফা আন্দোলন থেকে স্বাধিকার আন্দোলন দ্রুত স্বাধীনতার আন্দোলনে রূপ লাভ করে। অসাধারণ রাজনৈতিক দূরদৃষ্টিসম্পন্ন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে এবং তাঁর সৎ, সাহসী, অত্যন্ত বিশ্বাসভাজন, নেতৃত্বের প্রতি আস্থাবান এবং সুচিন্তিত নির্দেশের বাস্তবায়নকারী ছিল তাঁর সুযোগ্য সহকর্মীবৃন্দ। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য তাজউদ্দীন আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, মনসুর আলী, কামারুজ্জামান, মোহাম্মদ আলী, জহুর আহমদ চৌধুরী, আবদুল মান্নান, আবদুর রহিম, ইউসুফ আলীসহ আরও অনেকে।

মধ্যম সারির যুব-ছাত্রনেতা শেখ ফজলুল হক মণি, আবদুর রব, আব্দুর রাজ্জাক, মাহমুদুর রহমান মান্না, আবদুল কুদ্দুস মাখন, আব্দুল জলিল, তোফায়েল আহমেদ, আমির হোসেন আমু, আব্দুল মান্নান, হান্নান, মতিয়া চৌধুরী, রাশেদ খান মেননসহ কয়েকশ’ নেতারও বড় ভূমিকা ছিল। তারা ছয় দফা, এগারো দফা বাস্তবায়নে এবং শহরে শহরে জাতিকে স্বাধীনতার দাবিতে ঐক্যবদ্ধ করতে অক্লান্ত পরিশ্রম করে মিছিল ও সমাবেশ অনুষ্ঠান করেছে।

এই সব মিছিলে ঢাকা, চট্টগ্রামে প্রায় প্রতিদিন পাকিস্তানি পুলিশ গুলি চালিয়ে নিরীহ শ্রমিক-তরুণদের হত্যা করেছে। সাধারণ তরুণরা এইসব মিছিলে নিজেদের তাগিদে, স্বাধীনতার মন্ত্রে উজ্জীবিত হয়ে যোগ দিয়ে প্রাণ উৎসর্গ করেছেন। বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ডাক, মুক্তির ডাক জনগণের কাছে স্বাধীনতার এক দাবিতে পরিণত হয়েছিল। এ কারণেই সর্বস্তরের মানুষ, আমলা থেকে সব রকম পেশাজীবী, ব্যবসায়ী-ব্যারিস্টার থেকে কারখানার কারিগর, শ্রমিক কৃষক, ছাত্রÑসবাই ’৭১-এর জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর অসহযোগ আন্দোলনকে অদৃষ্টপূর্ব ঐক্যের সঙ্গে সফলভাবে পরিচালিত করেছিল।

এ ঘটনাও ঐতিহাসিক এবং বিশ্ব ইতিহাসে অবশ্যই বিরল। এ সময় সাবেক পূর্ব পাকিস্তানের সব শহরে, গ্রামে ওড়ানো হয়েছিল ‘জয় বাংলা’র অর্থাৎ স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা। ঢাকার সব সরকারি কেন্দ্রীয় ভবন, অন্য কোথাও পাকিস্তানের পতাকা সে সময় ওড়ানো হয়নি। এক কথায় বলা চলে, অসহযোগ আন্দোলনের সময় পাকিস্তানের মৃত্যু হয়েছিল এবং স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম হয়েছিল প্রতীকী অর্থে।
চট্টগ্রাম বন্দরে আসা পাকিস্তানি সেনা ও অস্ত্র বোঝাই ‘সোয়াত’ জাহাজ থেকে অস্ত্র নামাতে নিয়ে আসা বাঙালী শ্রমিক দল অস্ত্র নামাতে অস্বীকৃতি প্রকাশ করেন। সেখানে জাহাজ থেকে গুলি ছুড়ে মাঝে মাঝেই শ্রমিক হত্যা করা হয়েছে। বিহারি অধ্যুষিত আগ্রাবাদে খুনিরা বাঙালি রেলওয়ে বন্দর কর্মকর্তা, নারী-পুরুষদের হত্যা করছিল। এরই মধ্যে এলো ২৫ মার্চ। ‘অপারেশন জ্যাকপট’।

ঢাকার সেনানিবাস থেকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ট্যাংক যোগে রাজপথে নেমে এলে বাংলাদেশে এক বৃহৎ নির্মম তুলনাহীন গণহত্যার সূচনা হয়। পাকিস্তানি সেনাদল দ্রুত সব জেলার সেনানিবাস থেকে বের হয়ে সাধারণ নিরীহ গ্রামবাসী, প্রতিরোধ করা স্থানীয় তরুণ, পুলিশ, সাধারণ মানুষকে হত্যা করতে শুরু করে। চট্টগ্রামে  তখনকার বিডিআরের  সেনা কর্মকর্তা মেজর রফিক অনুসারী সেনা-পুলিশদের নিয়ে প্রতিরোধ যুদ্ধ শুরু করেন। জয়দেবপুরে মেজর শফিউল্লাহ পাঞ্জাবিদের প্রতিরোধ শুরু করেন। কুমিল্লা সেনানিবাসেও পাঞ্জাবি-বাঙালি সেনাদের মধ্যে মুখোমুখি লড়াই শুরু হয়। রংপুরের সৈয়দপুরে বিহারি গু-া খুনিদের হাতে নিহত হয় বিপুল বাঙালি রেল কর্মকর্তা, তাদের পরিবারের সদস্য, সাধারণ বাঙালি এবং বিপুল মাড়োয়ারি সম্প্রদায়- যারা সৈয়দপুরে, রংপুরে নানা পণ্যের ব্যবসায় নিয়োজিত ছিল। এ সময়, ’৭১-এর মার্চ থেকে বাঙালির প্রকৃত স্বাধীনতার লড়াই শুরু হয় সশস্ত্র প্রতিরোধ যুদ্ধের মাধ্যমে।

পরে ভারত সরকারের সহায়তায় বাঙালি সেনা-পুলিশ ও তরুণ ছাত্র-যুবক, শ্রমিক-কৃষক সন্তানেরা নিয়মিত সশ্রস্ত্র লড়াইয়ের প্রস্তুতি গ্রহণের লক্ষ্যে যাত্রা করে ভারতের পথে। এই যাত্রাপথে আমাদের বহু তরুণ প্রাণ হারিয়েছেন সেসময়ের জামায়াত-ছাত্র সংঘের উদ্যোগে পাকিস্তানের সমর্থক দালাল গোষ্ঠীÑ শান্তি কমিটি, রাজাকার, আলবদর-আলশাম্স নামক দেশবিরোধী খুনি বাহিনীর হাতে। দুঃখজনক হলেও সত্যÑবাঙালি শুধু দেশপ্রেমিক, স্বদেশের মুক্তি-স্বাধীনতাপন্থি ছিল না।

শুরুতে দুই মাসের মধ্যেই স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের সমর্থকদের একদিকে পাকিস্তানি সেনাদের হামলা-আক্রমণ, অপরদিকে স্থানীয় বাঙালি পাকিস্তানপন্থি শান্তি বাহিনী রাজাকার-দালালদের ষড়যন্ত্র ও হামলার মোকাবিলাও করতে হয়েছে! মাত্র নয় মাসের সশস্ত্র যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তযুদ্ধপন্থি রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের বিশেষত আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী এবং আওয়ামী লীগের সমর্থক সংখ্যালঘু গোষ্ঠীকে সর্বোচ্চ মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার হতে হয়েছিল। হাজার হাজার পরিবারকে হত্যা-খুন, গুম, ধর্ষণ, সম্পদ লুট ও বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ, ধর্মান্তরকরণ, জবরদস্তি মুসলমানিকরণ, গরুর মাংস খাওয়ানো এবং দেশত্যাগে বাধ্য করার মতো নির্মম, মানবতার বিরুদ্ধে ভয়ংকর অপরাধের শিকার হতে হয়েছিল।

মাত্র নয় মাসে এসব অপরাধের শিকার হয়েছিল লাখ লাখ নিরীহ নারী-পুরুষ-শিশু। বলা বাহুল্য, উক্ত মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধগুলো নয় মাস যাবৎ পরিচালিত হয়ে এর সর্বোচ্চ নির্মমতা প্রকাশ পায় ১৬ ডিসেম্বরের বিজয় অর্জনের কয়েকদিন আগে। আলবদর খুনিদের দ্বারা বুদ্ধিজীবীদের চিহ্নিত তালিকা ধরে বাড়ি থেকে চোখ বেঁধে তুলে নিয়ে গিয়ে হত্যা করা হয়। পুরো ’৭১-জুড়ে বাঙালি জাতি এক বিশাল গণহত্যার শিকার হয়ে লাখ লাখ নারী-পুরুষ-শিশু-যুবকরা হত্যার শিকার হয়।

অবশেষে ভারত সরকার, সোভিয়েট ইউনিয়ন ও ভারতের মিত্র বাহিনীর সহায়তায় আমাদের মুক্তিযোদ্ধা সেনারা ১৬ ডিসেম্বর যে বিজয় অর্জন করেছিল তাকে এক শোকাবহ দিবসে পরিণত করতে আলবদরের খুনিরা বাঙালির সর্বোচ্চ মেধাবী স্ব স্ব ক্ষেত্রে খ্যাতনামা বুদ্ধিজীবী-আইনজীবী, চিকিৎসক, শিক্ষক, প্রকৌশলী, প্রশাসক, সমাজসেবক, ব্যবসায়ী, শিক্ষাবিদ, পুলিশ কর্মকর্তা, সেনা কর্মকর্তাসহ কয়েক হাজার মানুষের  নির্মম হত্যাযজ্ঞ পরিচালনা করে। এই ধরনের শীর্ষ বুদ্ধিজীবীদের চিহ্নিত তালিকা করে হত্যার দৃষ্টান্তও বিরল বিশ্ব ইতিহাসে।

বিস্ময়ের এই যে, এই গণহত্যার অনুসরণ করে ’৭৫ সালের ১৫ আগস্টে সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা, তাঁর স্বজনদের হত্যা, ৩ নভেম্বর ঢাকা জেলে বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক সহচর, মুক্তিযুদ্ধের সফল পরিচালক তাজউদ্দীন, সৈয়দ নজরুল, মনসুর আলী, কামারুজ্জামানকে হত্যা এবং এর পরপর ২০টি ক্যুয়ের নামে প্রায় চার হাজার সেনা সদস্য ও বিমান বাহিনীর সদস্যদের প্রহসনের বিচারে ফাঁসি দেওয়া, অনেকের লাশ গুম করা, বিটিভির শীর্ষ চার কর্মকর্তা হত্যা, ৭ নভেম্বর খালেদ মোশাররফ, কর্নেল নাজমুল হুদা, কর্নেল হায়দারসহ কয়েকশ’ সেনা হত্যা, পরে কর্নেল তাহেরকে হত্যা করা হয়।

আশ্চর্য এই যে, এরা সবাই ছিল বাঙালি মুক্তিযোদ্ধা! এরপরও বহু হত্যা হয়েছে। ২০০১ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত প্রায় বিশ হাজার আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী হত্যার শিকার হন। তাদের পাশে হিন্দু সম্প্রদায়ও ’৭১-এর মতো হত্যা ধর্ষণ, লুট, অগ্নিসংযোগসহ গৃহত্যাগে বাধ্য হয়। ২০০৪-এর ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলাটি আরেকটি গণহত্যা, যেটি পরিকল্পিত হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের নেতৃস্থানীয় নেতাদের হত্যার লক্ষ্যে! এরও পরে ২০১৪-১৫ সালের বিএনপি-জামায়াতের দ্বারা খালেদা নির্দেশিত আগুন-সন্ত্রাসে দুইশ’র বেশি নারী-পুরুষ-তরুণ-তরুণী-শিশু হত্যাও ঐ গণহত্যার অনুসরণেই সংঘটিত হয়!

এমন কি ২০১৬-এর ১ জুলাইয়ের গুলশান ক্যাফেতে বাংলাদেশের বিদেশী উন্নয়ন সহযোগীদের জঙ্গী দ্বারা হত্যাও গণহত্যার শামিল। নানাভাবে দেখা যাচ্ছে, ঐ পাকিস্তানি গণহত্যাকারীদের সমর্থক গোষ্ঠী জামায়াত-বিএনপি মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী দলের নেতাকর্মী বুদ্ধিজীবী, গণজাগরণ মঞ্চের প্রগতিশীল বিজ্ঞান মনস্ক তরুণদের একে একে হত্যা করেছে। এরা সেই পুরনো পাকিস্তানপন্থি জামায়াত-বিএনপি এবং তাদের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে, প্রশিক্ষণে জন্ম নেওয়া জঙ্গী গোষ্ঠী। এদের সবার একটিই পরিচয়। তারা হলো পুরনো সেই শকুন, যারা আমাদের প্রিয় মাতৃভূমিকে ’৭১-এর মতো   এখনো ধ্বংস করতে চায়। এরাই এখনো আমাদের প্রিয় পতাকাকে ছিন্ন করে দেশের উন্নয়নের সব পথকে বন্ধ করে দিয়ে বাংলাদেশকে পাকিস্তানের মতো ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত করতে চায়।
পুরনো দেশবিরোধী পাকিস্তানপ্রেমী জামায়াত, তাদের পরে একই আদর্শের বিএনপি হয়েছে খুনি জিয়ার হাত ধরে। জিয়া শুধু বঙ্গবন্ধুর খুনিদের মুক্তি দেয়নি, জিয়া বঙ্গবন্ধু সরকার দ্বারা গ্রেপ্তার হওয়া ৩৬০০০ যুদ্ধাপরাধীকে মুক্তি দিয়েছে! যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য গঠিত ৭৬টি ট্রাইব্যুনাল বন্ধ করে দিয়েছে। দেশবিরোধী জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতি করার অধিকার ফিরিয়ে দিয়েছে! ধর্মভিত্তিক রাজনীতি ও ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি, যা বঙ্গবন্ধু মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সুরক্ষার জন্য সংবিধানে নীতি হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন, সে দুটো সুরক্ষা নীতিও জিয়া উৎপাটন করে প্রকৃত পাকিস্তানপ্রেমীর পরিচয় দিয়েছে! সেই একই পথ অনুসরণ করে খালেদা, তারেক-নিজামী-মুজাহিদ সরকার বারে বারে পাকিস্তানী সেনাদেরকৃত গণহত্যার পথ অনুসরণ করে মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে চিরবৈরীর ভূমিকা পালন করেছে!
জাতির জানা প্রয়োজন- ১) জিয়াউর রহমান ডিসেম্বর ১৯৭৫-এ বঙ্গবন্ধুর ‘দালাল আইন (বিশেষ ট্রাইব্যুনাল) আদর্শ’ বাতিল করে অধ্যাদেশ জারি করে এবং সে সময়ে গ্রেপ্তারকৃত = হাজার যদ্ধাপরাধীকে মুক্তি দেয়। ২) জিয়ার প্রধান মন্ত্রিত্ব ও মন্ত্রিত্ব পেয়েছে পাকিস্তানপন্থি দালাল শাহ আজিজ এবং পাকিস্তানপন্থি রাজাকার সদস্য ৩) জিয়ার প্রধান যুদ্ধাপরাধীপন্থি পদক্ষেপ হলো- বঙ্গবন্ধু কর্তৃক প্রণীত সংবিধান থেকে ধর্মভিত্তিক রাজনীতির ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার এবং জামায়াতের ধর্মভিত্তিক রাজনীতি চর্চার সুযোগ করে দেওয়া ৪) সংবিধান থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা কর্তন!
উল্লেখ্য, বঙ্গবন্ধু যারা প্রত্যক্ষভাবে খুন, হত্যা, ধর্ষণ, লুট ও অগ্নিসংযোগের মতো মানবতাবিরোধী অপরাধ সংগঠন করেনি তাদেরকে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করে মুক্তি দিয়েছিলেন। সে হিসাবে ৩৬০০০ যদ্ধাপরাধী থেকে ২৬০০০ ক্ষমা লাভ করে। কয়েক হাজার য্দ্ধুাপরাধীর বিচার কাজ চলমান ছিল। যেটি জিয়া বঙ্গবন্ধু হত্যার পর বন্ধ করে দিয়ে তাদেরকে মুক্তি দেয়! অথচ পাকিস্তান ও যদ্ধাপরাধীরা জেনেভা কনভেনশনের সব নীতি ভঙ্গ করেছিল।
১৯৭১-এর বাংলাদেশ সম্পর্কে জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশন ১৯৭৩ সালের মার্চ মাসে জেনেভায় অনুষ্ঠিত ২৯তম অধিবেশনে যে নীতিমালা ও প্রস্তাব গ্রহণ করেছিল তাতে ছিল- ‘যে হাজার হাজার বাঙালি নির্যাতন- যন্ত্রণা ভোগ করেছে, নির্যাতনে প্রাণ হারিয়েছে, তাদের লক্ষ লক্ষ বিধবা ও এতিম সন্তান এবং যারা বেঁচে গেছে তাদের এটা আশা করার অধিকার রয়েছে যে, যারা এসব ঘৃণ্য অপরাধের জন্য দায়ী, তারা যেন বিচার থেকে রেহাই না পায় এবং অপরাধীদের বিচার করার অধিকার এবং কর্তব্য বাংলাদেশের রয়েছে।

অর্থাৎ এ কর্তব্য বাংলাদেশের সরকারের ও জনগণের রয়েছে’। এই অধিবেশনে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের সংজ্ঞা দেওয়া হয় এবং এর সঙ্গে সঙ্গতি রেখে জাতিসংঘের অর্থনৈতিক ও সামাজিক কাউন্সিল ১৯৭৪ সালে সব রাষ্ট্রের প্রতি আহ্বান জানায়- তারা যেন আন্তর্জাতিক আইন ও তাদের নিজেদের দেশের আইন অনুযায়ী এই ধরনের অপরাধের অপরাধীদের গ্রেপ্তার করে উন্মুক্ত বিচারালয়ে শনাক্ত করে ন্যায়বিচার করার প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখে। এই প্রস্তাব বঙ্গবন্ধু সরকারের আন্তরিক প্রচেষ্টার ফল।
জনগণকে এদের-যুদ্ধাপরাধী ও তাদের মিত্রদের প্রকৃত স্বরূপ চিনতে হবে এবং মুক্তিযুদ্ধের পক্ষশক্তি ও চেতনাকে সুরক্ষা দিতে মুক্তিযুদ্ধের জন্মশত্রুদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে যথাযোগ্য ভূমিকা পালন করতে হবে অবশ্যই।
লেখক : শিক্ষাবিদ

×