ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

সৃজনশীল পদ্ধতি বাদ সমাধান নয়

ড. মো. শফিকুল ইসলাম

প্রকাশিত: ২০:৪০, ৭ ডিসেম্বর ২০২২

সৃজনশীল পদ্ধতি বাদ সমাধান নয়

প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে আগামী বছর থেকে নতুন কারিকুলাম প্রবর্তন করা হচ্ছে

প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে আগামী বছর থেকে নতুন কারিকুলাম প্রবর্তন করা হচ্ছে। তার মানে নতুন শিক্ষাব্যবস্থা। নতুন কারিকুলাম বাস্তবায়নে শুরুতে প্রথম, দ্বিতীয়, ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে নতুন বই দেওয়া হবে। মাধ্যমিক স্তরে সব শ্রেণিতে বাস্তবায়ন করতে ২০২৫ সাল পর্যন্ত সময় লাগবে। নতুন কারিকুলামে সৃজনশীল প্রশ্ন থাকছে না। সেখানে অন্য রকমের প্রশ্নপত্র হবে। এটা কতটুকু যৌক্তিক।

কোনো সমস্যা হলে তা সমাধানের পথ খুঁজে বের করতে হবে। গাছে পোকা ধরেছে, মানে গাছ কেটে ফেলতে হবে- এ রকম নয়। তাই প্রশ্ন পদ্ধতিতে সমস্যা দেখা দিচ্ছে, মানে এই পদ্ধতি বাদ দেওয়া ভালো কোনো সমাধান হতে পারে না। সৃজনশীল প্রশ্ন পদ্ধতি শিক্ষার্থীদের নতুন কিছু শেখাতে সহায়তা করে। শিক্ষার্থীদের মনে নতুন নতুন চিন্তা জাগ্রত করতে কাজে আসে। কারণ, আমরা যখন প্রাথমিকে পড়তাম, সবই ছিল প্রায় মুখস্থনির্ভর। মুখস্থনির্ভর বিদ্যা দিয়ে শিক্ষার্থীদের চিন্তার জগৎ বিকশিত হয় না।

শিক্ষার্থীদের মনের বিকাশের জন্য সৃজনশীল প্রশ্ন পদ্ধতি সরকারের যুগান্তকারী পদক্ষেপ, যা ছিল প্রশংসনীয়। সম্প্রতি কিছু শিক্ষক বিতর্কিত প্রশ্ন করেছেন। যেমন- লেখক আনিসুল হক ও ক্রিকেট খেলা নিয়ে যে প্রশ্ন ২০২২ সালে পরীক্ষায় এসেছে, তা নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা চলমান। এছাড়াও ২০২২ সালের এইচএসসির বাংলা বিষয়ের সৃজনশীল প্রশ্ন প্রণয়ন নিয়ে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্পের যে কু-লী দেখছি, তাতে সবাই চমকে উঠলেও আমরা বিস্মিত নই।

কারণ, কিছু লোক সমাজের অনেক উচ্চ স্থানে বা বড় পজিশনে বসে সাম্প্রদায়িকতার বীজ বপন করে চলেছে। বঙ্গবন্ধুর অসাম্প্রদায়িক দেশে কোনো প্রকারের সাম্প্রদায়িকতা কাম্য নয়। যারা সমাজে সাম্প্রদায়িকতার বীজ বপন করে এবং কাজের মাধ্যমে সাম্প্রদায়িকতার উস্কানি দেয়, তাদের বিচারের আওতায় আনতে হবে। কোনো প্রকারের কম্প্রোমাইজ করা যাবে না। তাই যেসব শিক্ষক এই ধরনের সাম্প্রদায়িক বা বিতর্কিত প্রশ্ন করেছেন, তদন্ত করে তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। যাতে ভবিষ্যতে কেউ যেন এ ধরনের সাহস না পায়।
সৃজনশীল প্রশ্ন পদ্ধতি নিয়ে যে সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে, তা উত্তরণের জন্য কিছু উদ্যোগ নিতে হবে। যেমন- সৃজনশীল প্রশ্ন প্রণয়নের জন্য কিছু প্রশ্নকর্তা নিয়োগ দিতে হবে, যাদের অভিজ্ঞতা আছে। প্রশ্নকর্তাদের জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। প্রতি প্রশ্নের প্রশ্নকর্তা নিয়োগের জন্য কমপক্ষে দুজন করে নিয়োগ দিতে হবে।  প্রশ্ন মডারেশনের জন্য একটি বোর্ড থাকতে হবে। তারা প্রয়োজনে প্রশ্ন সংশোধন করতে পারবে।

প্রশ্ন কর্তাদের জন্য আর্থিক প্রণোদনা বৃদ্ধি করতে হবে। প্রশ্ন কর্তাদের জন্য যে পরিমাণ সম্মানী দেওয়া হয়, তা অপ্রতুল। সৃজনশীল প্রশ্নে কোনো বিতর্কিত বিষয় থাকতে পারবে না। সে এই বিষয়ে সকল প্রশ্নকর্তাকে কঠোর নির্দেশ দিতে হবে। সৃজনশীল প্রশ্ন করতে প্রয়োজন হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সার্বিক দায়িত্ব দিতে পারে কর্তৃপক্ষ। সৃজনশীল প্রশ্ন আসলেই সৃজনশীল হতে হবে। এর জন্য প্রয়োজন উচ্চশিক্ষা, দেশী-বিদেশী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়াশোনার অভিজ্ঞতা। সৃজনশীল প্রশ্ন করতে প্রশ্নকর্তাকে যথেষ্ট সময় দিতে হবে।
সৃজনশীল প্রশ্ন নতুন প্রজন্মকে উন্নত গবেষণাভিত্তিক সমাজ ও শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তুলতে কার্যকরি ভূমিকা রাখবে বলে বিশ্বাস করি। সৃজনশীল প্রশ্ন করতে শিক্ষকরা যে উদ্দীপক বা বিষয়কে বিবেচনা করে থাকেন, সেখানে অধিকতর সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। সৃজনশীল তত্ত্বীয়/বর্ণনামূলকের প্রতিটি প্রশ্নে উদ্দীপকের সঙ্গে সাধারণত চারটি অংশ থাকে। যেমন- (ক) জ্ঞানমূলক (খ) অনুধাবনমূলক (গ) প্রয়োগমূলক এবং (ঘ) উচ্চতর দক্ষতামূলক। অর্থাৎ, প্রথম অংশটি বই থেকে মুখস্থ করে বা জ্ঞান অর্জন করে লিখতে পারবে শিক্ষার্থীরা। কিন্তু বাকি অংশ অবশ্যই শিক্ষার্থীকে বিশ্লেষণ করে প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে। তাই প্রশ্নকর্তাকে এসব বিবেচনায় নিয়ে প্রশ্ন করতে হবে। এখানে কোনো ব্যত্যয় হবে না।
সৃজনশীল প্রশ্ন এমনভাবে করতে হবে যেখানে শিক্ষার্থীদের মনে সত্যিকার অর্থে সৃজনশীলতা এবং উদ্ভাবন শক্তি বৃদ্ধি পায়। তাহলে দেশ পাবে এক অনুসন্ধানী বা গবেষণামূলক শিক্ষিত জাতি। সৃজনশীল প্রশ্ন পদ্ধতি কোনোভাবেই বাদ দেওয়া বা বন্ধ করা সঠিক সিদ্ধান্ত হবে না। প্রয়োজন হলে সৃজনশীল প্রশ্ন করার জন্য নতুন পলিসি নিতে পারে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।

সৃজনশীল প্রশ্ন বিশেষ ধরনের প্রশ্ন, একটি উদ্ভাবন চ্যালেঞ্জ। এটি এমনভাবে তৈরি করা প্রশ্ন, যা একদল লোকের কাছ থেকে সৃজনশীল ধারণা চাওয়ার জন্য ডিজাইন করা হয়েছে। উদ্ভাবন চ্যালেঞ্জগুলো সাধারণত ‘কোনো উপায়ে আমরা...?’ দিয়ে শুরু হয়। বা ‘আমরা কিভাবে পারি...?’ বা ‘নতুন কি... হতে পারে...?’
উদাহরণস্বরূপ, ‘কিভাবে আমরা আমাদের বিদ্যুৎ খরচ কমাতে পারি?’ বা ‘কিভাবে আমরা আমাদের পণ্যগুলোকে ক্রেতাদের কাছে আরও আকর্ষণীয় করে তুলতে পারি?’ বা ‘বাংলাদেশে আমরা কোনো নতুন ব্যবসার সুযোগ কাজে লাগাতে পারি?’ এসব প্রশ্ন কখনও মুখস্থ করে উত্তর দেওয়া সম্ভব নয়। তাই এসব প্রশ্ন ছাত্র-ছাত্রীদের মনে নতুন কিছু ভাবতে সাহায্য করে। যা সমাজে নতুন নতুন ধারণা সৃষ্টিতে ব্যাপক ভূমিকা রাখে।

সমস্যা সমাধানের পরিবর্তে, শিক্ষক সমস্যা-অনুসন্ধানের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের বিশ্বকে দেখতে সাহায্য করতে পারেন। সমস্যা-অনুসন্ধান সমস্যা আবিষ্কারের সমতুল্য। শিক্ষকরা সামগ্রিকভাবে একটি উল্লেখযোগ্য সমস্যা প্রক্রিয়ার অংশ হিসাবে সমস্যা-অনুসন্ধান ব্যবহার করতে পারেন। যার মধ্যে সমস্যার ধরন, আকৃতি এবং সমস্যা-সমাধান অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে।

সমস্যা-সন্ধানের জন্য একটি বুদ্ধিবৃত্তিক এবং কল্পনাপ্রসূত দৃষ্টি প্রয়োজন। এই কৌশল ব্যবহার করে শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের গভীরভাবে চিন্তা, সমালোচনামূলক প্রশ্ন জিজ্ঞাসা এবং সমস্যা সমাধানের জন্য সৃজনশীল উপায় প্রয়োগ করার সুযোগ সৃষ্টি করে দিতে পারেন।
শুধু সৃজনশীল প্রশ্ন করলেই চলবে না, বরং শিক্ষার্থীদের সৃজনশীল দক্ষতা অর্জন করতে গড়ে তুলতে হবে।

এর জন্য প্রয়োজন হলে ‘ডিজাইন থিংকিং প্রোসেস’ চালু করা যেতে পারে। যার মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা চ্যালেঞ্জগুলো চিহ্নিতকরণ, তথ্য সংগ্রহ, সম্ভাব্য সমাধান, ধারণাগুলো পরিমার্জিত করা এবং সমাধানগুলো পরীক্ষা করতে পারে। দেশের ও জনকল্যাণের স্বার্থে সৃজনশীল প্রশ্ন পদ্ধতি চালু রাখা একান্ত জরুরি। তবে সুজনশীল প্রশ্ন নিয়ে সমালোচনা, বিতর্ক এবং আপত্তিকর বিষয়টি সরকারের উচ্চমহল থেকে গুরুত্বের সঙ্গে দেখা আবশ্যক অবশ্যই।

লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ
[email protected]

×