ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

বিজয়ের আনন্দ বেদনা

নাজনীন বেগম

প্রকাশিত: ২০:৩৭, ৭ ডিসেম্বর ২০২২

বিজয়ের আনন্দ বেদনা

ঐতিহাসিক ও গৌরবময় বিজয়ের মাস

ঐতিহাসিক ও গৌরবময় বিজয়ের মাস তার সার্বিক আবেদন নিবেদনে পুনরায় বাঙালির লড়াকু জীবনের ইতিবৃত্তে মাতিয়ে দিচ্ছে। শুধু কি মাতানো, নিত্যনতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করাও দিবসটির ঐতিহ্যিক মাহাত্ম্য। মাসটি শুধু আনন্দ কিংবা আলোকের ঝর্ণাধারা নয়, এর পেছনে রয়েছে হরেক দুঃসহ পালাক্রম। বাঙালির অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রামী পথযাত্রা কোনোভাবেই নিঃসংশয় এবং নির্বিঘ্ন ছিল না। কণ্টকাকীর্ণ পথ অতিক্রম করতে কত মূল্যবান জীবনের অকাল প্রয়াণ, শোকে মুহ্যমান গাথা দুঃখের তিমির।

তারপরেও বিজয় নিশানায় লাল সবুজের পতাকা যখন উড়তে থাকে, তেমন উৎসাহ আর উদ্দীপনার দুর্লভ ক্ষণগুলো স্মৃতির মিনারে উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর হয়। কিন্তু দাম দিতে হয়েছে জাতিকে নিঃস্ব রিক্ত করার। কত কাঠখড় পোড়ানো। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর অত্যাচার-নির্যাতন তাও ইতিহাসের রক্তক্ষরণ। তারপরও বিজয়ের রক্তিম সূর্য যখন সারা দেশকে আলোয় ভরিয়ে দিল, সেটাও ঐতিহাসিক অর্জনের সুন্দরতম অধ্যায়।

বিজয়ের মহাউৎসবের মুহূর্তে ফেলে আসা গ্লানিকর পালাক্রম মুছে গেলেও চিরস্থায়ী ক্ষতবিক্ষত সেভাবে ভোলা সম্ভব হয়নি। তাই ডিসেম্বরকে বরণডালা সাজিয়ে যেভাবে আনন্দে বিহ্বল হতে হয়, পাশাপাশি বেদনাবিধূর অসহনীয় দুর্ভোগকে স্মরণ চেতনায় আনাটাও যেন সময়ের দাবি। ৩০ লাখ শহীদানের পবিত্র রক্তের বিনিময়ে যে লোহিত সাগর আমরা পাড়ি দিয়েছি সেটাও লড়াই-সংগ্রামের নির্মম কাহিনী।

আর লাখ লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমহানির নিষ্ঠুর যজ্ঞ, তাও কি আনন্দের বার্তায় শোকে মুহ্যমান হওয়ার মতোই কিনা সেটাও তো প্রশ্নের অপেক্ষায় থাকে না। আর জ্ঞানচর্চার সমৃদ্ধ ভুবন কি মাত্রায় অপশক্তির ঘায়েলে আবর্তিত হয়েছে সেটাও কি কখনো মানা যায় কিংবা গেছে? হারানোর বেদনা শুধু বিধ্বংসের পালাক্রম নয়, বুদ্ধিবৃত্তির জগতকে নৃশংসভাবে থামিয়ে দেওয়ার ঐতিহাসিক দুর্বৃত্তায়ন। জাতিকে মেধাশূন্য করতে ১৪ ডিসেম্বর যে নারকীয় হত্যাকা- চালানো হয়, তাও জ্ঞানী, গুণী, সজ্জন ব্যক্তিবর্গের ওপর সহিংস পাকি কোপানল।

আর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কণ্টকাকীর্ণ জীবনযাত্রা যে মাত্রায় বিভীষিকাময় হয়ে ওঠে সেটাও স্বাধীনতা সংগ্রামের দুঃসহ ইতিবৃত্ত। ২৬ মার্চ স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে আর থাকতে পারলেন না স্বদেশে। পাকিস্তানি সামরিক জান্তার হাতে বন্দি হয়ে চলে গেলেন শত্রুর কারাগারে। সেও স্বাধীনতা যুদ্ধের এক অসহনীয় মুহূর্ত। জানাও যেত না বঙ্গবন্ধু কেমন আছেন। তার নিত্য জীবনের হরেক বিপর্যয় তাকে কতখানি অস্থির আর ব্যথিত করতো সেটাও ছিল সবার ধারণার বাইরে।

নয় মাসের অতৃপ্ত অস্থিরতা আর নানামাত্রিক দাবানলে দগ্ধ হতে হতে বাঙালীর মরণপণ অভিযাত্রা যেন ইতিহাসের রক্তিম অধ্যায়ের অনন্য দলিল। আর ৭ মার্চের সেই অবিস্মরণীয় ভাষণ, যা বঙ্গবন্ধুর তাৎক্ষণিক উপলব্ধিই শুধু নয়, স্বাজাত্যবোধ, অনমনীয় দেশপ্রেম আর জনগণের প্রতি সচেতন দায়বদ্ধতায় অনর্গল বলে দিলেন। সেটা যেন শুধু বক্তৃতা নয় কাব্যিক মনন শৌর্যের অভাবনীয় সম্ভারও বটে।

শত্রু ও সামরিক বাহিনী পরিবেষ্টিত এক দুর্গম শৃঙ্খলিত পরিবেশে অন্তরের অন্তঃস্তল থেকে জনগণের জন্য উৎসারিত হলো, তা আজ ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যের অন্যতম দলিল। স্বাধীনতা, বিজয় শব্দদ্বয়ের সঙ্গে অবিচ্ছিন্ন হয়ে আছে ৭ মার্চের বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক আহ্বান। কোনো কিছুই ভুলে যাওয়ার মতো নয়। ঘটনার পালাক্রম এমন ঐতিহাসিক এবং ঐতিহ্যিক যা ঠা-া মাথায় কোনো বিজ্ঞ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বই শুধু নন, তার চেয়ে বেশি আকর্ষণীয় নেতৃত্বেরও অভাবনীয় স্ফুরণ। সময় তা প্রমাণ করতেও দেরি করেনি।

গত বছর আমরা স্বাধীনতার ৫০তম বর্ষপূর্তি পালন করেছি নানামাত্রিক বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানে। এবার আর এক দশকে পা দেওয়ার শুভ মুহূর্তে আমরা। সেটা শুধু নতুন বাংলাদেশ গড়ার চাইতেও আধুনিক প্রযুক্তির বিশ্বমানের অনন্য বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পিতার অভেদ্য লক্ষ্য পথেই এগিয়ে চলেছেন শক্তিমত্তা, দুঃসাহস আর অভাবনীয় দেশাত্মবোধের অকৃত্রিম প্রেরণায়।

বঙ্গবন্ধুর মতোই তার প্রথম সন্তান পিতার ঋজু মস্তক, সত্য ও ন্যায়নিষ্ঠার পূজারি, দুর্দমনীয় সাহস ও মনোবলে যেন তিনিই পিতার সুযোগ্য উত্তরাধিকার। একটি বিশৃঙ্খল ও পথভ্রষ্ট জাতিকে যে মাত্রায় নতুন পথের সন্ধান দিলেন সেটা বঙ্গবন্ধুর কন্যা হওয়ার কারণেই বলা যেতে পারে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট পুনরায় স্বাধীনতার লাল সূর্য ঘন মেঘের আড়ালে অস্তমিত হওয়ার উপক্রম। কারণ, নতুন ঘাতক শ্রেণি শাসনভার কাঁধে নিয়ে যা করেছিল তা মূলত ঐতিহাসিক দুঃশাসন।

তারই ধারাবাহিকতায় ২১ বছরের অসহনীয় দুর্বৃত্তায়ন। স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তির পুনরুত্থানে সারাদেশ কেঁপে ওঠে। লাল সবুজের পতাকা লুণ্ঠিত হতেও সময় লাগে না। ১৯৮১ সালে সপরিবারে পিতার মৃত্যুর শোকের পাথর বুকে নিয়ে প্রধানমন্ত্রী দেশের মাটিতে পা রাখেন। সেটাও ছিল শত্রু পরিবেষ্টিত অশুভ শক্তির কঠিন বেষ্টনী।

সেখান থেকে শুধু দলকে স্থিত অবস্থায় এনে নবযাত্রা করিয়ে দেওয়া ছাড়াও, অসংহত দেশটিকে নতুন মাত্রা দেওয়ার ঐতিহাসিক দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিতে পেছনের দিকে একবারও তাকালেন না। পাথবসম শোককে তেজোদীপ্ত মনোবলে শক্তিময়তা অর্জন, সেটা যে কিভাবে সম্ভব হলো তাও দেশবাসী অবাক বিস্ময়ে শুধু উপলব্ধিই করে গেলো।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলার আকাশের এক জ্বলন্ত ধ্রুবতারা। হাজারো সংকট, দুঃসময়, কঠিন পথ পাড়ি দিয়ে একুশ শতকের দ্বিতীয় দশকে দেশকে যে পর্যায়ে দাঁড় করালেন তা কি শুধুই লড়াকু অভিগমন? এক তেজোদ্দীপ্ত উজ্জ্বল জ্যোতিষ্কের আপন আলোয় পথ দেখে নিয়ে সামনে এগোনোর অবিস্মরণীয় সংগ্রামী যাত্রা। মূল্যবান জীবন কখনো নিরাপদ ও নির্বিঘœ ছিল না। অদম্য শৌর্য আর অভাবনীয় মনোজাগতিক আলোকের ঝর্ণাধারায় কণ্টকাকীর্ণ, দুর্গম পথকে যেভাবে দুমড়ে. মুচড়ে মাড়িয়ে গেলেন, তেমন অফুরান মেধা বঙ্গবন্ধু ছাড়া আর কারও কি আছে?
প্রধানমন্ত্রীর যত অর্জন তার বর্ণনা তো শেষ হওয়ার নয়। ২ ডিসেম্বর চট্টগ্রামের পার্বত্য অঞ্চলের অধিবাসীদের সাথে চুক্তি । গত ২ ডিসেম্বর যার ২৫ বছর পুর্তির মহা উৎসব ছিল। ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় আসার পর পরই ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর এমন ঐতিহাসিক ও অসাধারণ চুক্তি করা অত সহজসাধ্য ছিল না।

স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু নিজেই ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর সাথে এতদিন যে অত্যাচার অবিচার হয়েছিল তারই একটি সুষ্ঠু সমাধানে পরিকল্পিত নীতি গ্রহণ করার প্রাক্কালেই তাকে খুনি জল্লাদরা নির্মমভাবে পৃথিবীর বুক থেকে সরিয়ে দেয়। পিতার অসমাপ্ত অনেক কাজের দায়ভার কাঁধে নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে সব ঐতিহাসিক উদ্যোগ গ্রহণ করেন, তার মধ্যে পার্বত্য শান্তি চুক্তি এক অবিস্মরণীয় দলিল।

চট্টগ্রামের রাঙামাটি, বান্দরবান এবং খাগড়াছড়ি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী জাতিসত্তার পরিচয়ে নিজেদের মতো টিকে থাকার প্রচেষ্টা বরাবরই অব্যাহত ছিল। চট্টগ্রাম ছাড়াও ময়মনসিংহের গারো এবং উত্তরবঙ্গে সাঁওতাল জাতিসত্তা বাংলাদেশে তাদের অবস্থানে নিজের মতো করেই বেঁচে আছে। নিজস্ব সংস্কৃতির বেড়াজালে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা এসব নৃগোষ্ঠীর ধর্ম, যাপিত জীবন, আহার, সবই সমতল ভূমির মানুষের চাইতে আলাদাই শুধু নয়, ভিন্ন বৈশিষ্ট্যে আপন বৃত্তের সাথে অবিচ্ছিন্ন থাকাও কাক্সিক্ষত পথ।

নিজস্ব পরিম-লে প্রকৃতির সুরম্য ছায়াতলের বাসিন্দারা শান্তিপ্রিয়, আদিম প্রথাসিদ্ধ এক শক্তিশালী জাতিসত্তা অবিরাম প্রকৃতির সঙ্গে লড়াই করে তাদের বাঁচতে হয়। জিয়াউর রহমানের শাসনামলে সেই পার্বত্য অঞ্চলের কিছু পতিত জায়গায় সমতল ভূমির বাঙালিদের প্রবেশের সুযোগ দিয়ে ইতিহাস বিরুদ্ধ যে কাজ করা হয়েছিল তাতেই বিক্ষুব্ধ ও যুদ্ধভাবাপন্ন হয়ে ওঠে শান্তিপ্রিয় নৃগোষ্ঠী।

১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় এসে মাত্র ১ বছরের মধ্যে তেমন সাংঘর্ষিক অভিযাত্রার যবনিকাপাত ঘটান বঙ্গবন্ধু তনয়া শেখ হাসিনা। ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর সেই চুক্তি সম্পাদনই নয়, বরং নতুন করে তাদের চলার পথকে নির্বিঘœ করে দেওয়াও ছিল তৎকালীন সরকারের অভাবনীয় কর্মযোগ। আভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বকলহ বিবাদ থাকলেও শান্তিপুর্ণ পরিবেশে পাহাড়ি-বাঙালির সহনীয় অবস্থান বর্তমান সময়ের  সফল কাম কর্মযজ্ঞের অনন্য নিদর্শন।
সারা বাংলাদেশে অবকাঠামো ও যাতায়াত ব্যবস্থা আধুনিকীকরণে যে ঐতিহাসিক কর্মযজ্ঞ প্রধানমন্ত্রীর হাত দিয়ে অভাবনীয় অর্জনের সিঁড়ি স্পর্শ করলো, তার দাম তো কোন অংশেই কম নয়। সারসংক্ষেপে যা উঠে আসবে তাতেই এক নজরে দেশের উন্নয়ন কর্মযজ্ঞ তার অভীষ্ট যাত্রাপথকে তুলে ধরতে যথেষ্ট। কয়েক বছরে যত অর্জন প্রধানমন্ত্রীর হাত দিয়ে জনগণের দ্বারে পৌঁছে যায়, তার হিসাবও নির্ণয় করা কঠিন।

সবার আগে এক ঐতিহাসিক কর্মযোগে সারা বাংলা যেভাবে উদ্ভাসিত হয়ে উঠলো তেমন অমূল্য সম্পদ আমাদেরকে সত্যিই চমকৃতও করে। ২০২২ সালের ২৫ জুন। বাংলাদেশের ইতিহাসে এক পরম মাহেন্দ্রক্ষণ। বিতর্কে জড়ানো ‘পদ্মা সেতুর’ ঐতিহাসিক মাইলফলক ছুঁয়ে যাওয়া। অর্থ কেলেঙ্কারি থেকে শুরু করে মামলা মকদ্দমা  কত কিছু যে সামলাতে হয়েছে বিদেশের বিচারিক আদালতে তাও এক দুর্গম যাত্রাপথ।

সেখান থেকে নির্বিঘ্নে বের হয়ে আসাও দেশের জন্য অহঙ্কার ও গৌরবের বিষয়। পদ্মা সেতুর শুভ উদ্বোধন শেষ লক্ষ্যমাত্রা নয়, বরং তার মধ্যে সারাদেশের অর্থনীতির যে নতুন পথ তৈরি হলো তাও আধুনিক ও প্রযুক্তির বাংলাদেশের আলোকিত সোপান। চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর ভিতর দিয়ে বঙ্গবন্ধু ট্যানেলের এক প্রান্ত উদ্বোধন করা সময়ের বিচারে অনন্য অর্জন।

আর এক সঙ্গে একশ’ সেতু উদ্বোধন বাংলাদেশকে অবকাঠামো উন্নয়নে এক সুবৃহৎ মাইলফলক। সেখানে রয়েছে পার্বত্য চট্টগ্রামের ৪৫টি সেতু। বহুমাত্রিক কর্মপরিকল্পনার লক্ষ্য নির্ধারণা, এগিয়ে নেওয়া ও বাস্তবায়ন অত সহজ ব্যাপার নয়। অনেক কর্ম প্রকল্প এখন পরিণতির দিকে। সেটা বাস্তবায়িত হতেও বেশি সময় লাগবে না।

লেখক : সাংবাদিক

×