ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

রেস্তোরাঁ খাতকে শিল্প ঘোষণা

নিরঞ্জন রায়

প্রকাশিত: ২০:৩৩, ৬ ডিসেম্বর ২০২২

রেস্তোরাঁ খাতকে শিল্প ঘোষণা

নিরঞ্জন রায়

সরকার সম্প্রতি দেশের রেস্তোরাঁ খাতকে শিল্প হিসেবে ঘোষণা করেছে। এ বিষয়ে একটি প্রজ্ঞাপনও জারি হয়েছে। এটি একটি প্রশংসনীয় উদ্যোগ, যা অনেক আগেই নেওয়া উচিত ছিল। দেরিতে হলেও সরকার এই খাতকে গুরুত্ব দিয়ে শিল্প ঘোষণা করে একটি প্রশংসনীয় উদ্যোগ নিয়েছে। আমাদের দেশে রেস্তোরাঁ এক বৃহত্তম ব্যবসা ক্ষেত্র, যার বিস্তৃতি ছড়িয়ে আছে দেশের সর্বত্র এবং প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত। এই খাতে নিয়োজিত আছেন অসংখ্য মানুষ।

বিরাট একটি জনগোষ্ঠী রেস্তোরাঁ ব্যবসাকে আত্মকর্মসংস্থানের সুযোগ হিসেবে বেছে নিয়ে ব্যবসা পরিচালনা করে আসছেন। এই খাতে ভালো অঙ্কের পুঁজিও বিনিয়োগ করেছেন। এই খাতে পর্যাপ্ত কর্মসংস্থানেরও সুযোগ হয়েছে। সব মিলিয়ে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে রেস্তোরাঁ খাত ভালো একটি স্থান দখল করে আছে, যা দেশের অর্থনীতিতেও ভালো অবদান রেখে চলেছে।
এতদিন পর্যন্ত এত বড় ব্যবসায়িক খাত হওয়া এবং অর্থনীতিতে ভালো অবদান রাখা সত্ত্বেও রেস্তোরাঁ ব্যবসার তেমন কোনো স্বীকৃতি ছিল না। গতানুগতিকভাবে সেবা খাত হিসেবে উল্লেখ করে এই খাতের প্রকৃত অবস্থাকে অস্বীকারই করা হয়েছে। সঠিক ব্যবসায়িক স্বীকৃতি না থাকায়, বিশেষ করে সরকার নির্ধারিত কোন্ খাতে এই রেস্তোরাঁ ব্যবসাকে ফেলা হবে, তা নিশ্চিত না থাকায় দেশে রেস্তোরাঁ ব্যবসা সুশৃঙ্খলভাবে গড়ে উঠতে পারেনি।

অনেক ক্ষেত্রে বরং এই খাতে বিরাজ করে বিশৃঙ্খল অবস্থা। স্বীকৃতির অভাবেই এই খাতে যারা ব্যবসা করেন, তাদের অনেকেই প্রতিনিয়ত প্রতিকূল অবস্থার সম্মুখীন হয়ে থাকেন। রেস্তোরাঁ খাতকে শিল্প হিসেবে ঘোষণা করায় এই খাতের যে সব দুর্বলতা এবং সীমাবদ্ধতা আছে, তা অনেকটাই দূর হবে বলে আশা করা যায়।
তবে দেশের রেস্তোরাঁ খাতকে শিল্প হিসেবে ঘোষণা করলেই হবে না, সেইসঙ্গে এই খাতে একটি সুশৃঙ্খল অবস্থা নিশ্চিত করে এখানে একটি মানসম্পন্ন ব্যবসায়িক অবস্থা গড়ে তোলার জন্য অনেক কাজ করতে হবে। আমাদের দেশে রেস্তোরাঁ ব্যবসা গড়ে উঠেছে এলোমেলো এবং বিশৃঙ্খলভাবে। আবার এই খাতের ব্যবসার তেমন কোনো মানদ-ও নেই। প্রত্যন্ত গ্রামের রাস্তার পাশের চায়ের দোকান থেকে শুরু করে রাজধানী শহরের অত্যাধুনিক হোটেলও রেস্তোরাঁ ব্যবসার আওতায় পড়ে।

এ রকম একটি ব্যবসায়িক খাতকে শিল্প হিসেবে ঘোষণা করে সেখানে একটি ব্যবসায়িক মানদ- প্রতিষ্ঠা করা মোটে সহজ কাজ নয়। তবে আন্তরিকতা এবং প্রচেষ্টা থাকলে এই কাজ কঠিন হলেও অসম্ভব নয়। এই খাতকে শিল্প হিসেবে ঘোষণা করে প্রজ্ঞাপন জারি করায় এই কাজটা যে সহজ হবে, তাতে সন্দেহ নেই। তবে শুধু প্রজ্ঞাপন জারির মাধ্যমে এই কাজ করতে চাইলে তেমন কিছু হবে বলে মনে হয় না। প্রজ্ঞাপনকে ভিত্তি করে এ বিষয়ে একটি বিধি বা প্রবিধি প্রণয়ন করতে হবে, যেখানে বিস্তারিত উল্লেখ থাকতে হবে।

দেশের প্রত্যেকটি রেস্তোরাঁ ব্যবসাকে এই রেস্তোরাঁ বিধির আওতায় থাকতে হবে। এটা করার উদ্দেশ্যে প্রত্যেক রেস্তোরাঁ ব্যবসা তার ধরন যে মানেরই হোক না কেন, তাদের এই বিধির আওতায় আনার জন্য সমন্বয় করে নিতে হবে। যেমন-মালিকানার ভিত্তি, মূলধন বিনিয়োগের পরিমাণ, ব্যবসার পরিমাণ, নিয়োজিত কর্মসংস্থানের ভিত্তিতে সমগ্র রেস্তোরাঁ ব্যবসাকে কয়েকটি শ্রেণিতে ভাগ করা যেতে পারে। প্রত্যেক শ্রেণির অন্তর্গত হোটেল-রেস্তোরাঁ কি ধরনের স্বীকৃতি এবং সুযোগ-সুবিধা পেতে পারে তা সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ থাকবে এ সংক্রান্ত বিধি বিধানে।
প্রয়োজনে রেস্তোরাঁ ব্যবসা নিবন্ধন সংস্থাও প্রতিষ্ঠা করা যেতে পারে। প্রতিটা রেস্তোরাঁকে এই সংস্থা থেকে নিবন্ধন নিয়েই ব্যবসা পরিচালনা করতে হবে। তবে এই কাজ করতে গিয়ে যেন নতুন করে আমলাতান্ত্রিক জটিলতার সৃষ্টি না হয়। এই কারণে যেন এই খাতের প্রবৃদ্ধি থেমে না যায়, সেদিকেও বিশেষ খেয়াল রাখতে হবে। সবচেয়ে ভালো হয় ভার্চুয়াল নিবন্ধন সংস্থা প্রতিষ্ঠা করে অনলাইন নিবন্ধন বা নবায়ন ব্যবস্থা চলু করতে পারলে।

বর্তমান ডিজিটাল বাংলাদেশে এই অনলাইন নিবন্ধন চালু করা খুব সহজ কাজ হবে বলেই আমাদের বিশ্বাস। বিগত কয়েক দশকে আমাদের দেশের রেস্তোরাঁ ব্যবসার ব্যাপক প্রসার ও বিস্তৃতি ঘটেছে। এই খাতে এখন বিশাল অঙ্কের বিনিয়োগও হয়েছে। আগামীতেও যে হবে সেই সম্ভাবনাও দেখা দিয়েছে। রাজধানী ঢাকাসহ অনেক বড় বড় শহরে খুবই উন্নত মানের হোটেল-রেস্তোরাঁ গড়ে উঠেছে। উন্নত বিশ্বের আদলে অনেক চেইন রেস্তোরাঁও গড়ে উঠেছে।

এসব হোটেল-রেস্তোরাঁর সেবার মান উন্নত বিশ্বের রেস্তোরাঁর চেয়ে কম নয়। শুধু বড় শহরই নয়, অনেক মফস্বল শহরেও গড়ে উঠেছে নামকরা হোটেল, রেস্তোরাঁ এবং মিষ্টির দোকান। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বিশেষ করে টুরিস্ট স্পটে গড়ে উঠেছে অনেক মানসম্পন্ন রিসোর্ট, যা অগ্রসরমান এবং সম্ভাবনাময় একটি খাত হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এই খাতও নিশ্চয়ই রেস্তোরাঁ প্রজ্ঞাপনের আওতায় পড়বে। ফলে, এই খাতের পরিধি যথেষ্ট বৃদ্ধি পাবে।   
মানসম্পন্ন হোটেল ও রেস্তোরাঁ ব্যবসা পরিচালনার জন্য একদিকে যেমন ভালো অঙ্কের পুঁজি বিনিয়োগ করতে হয়, অন্যদিকে নিয়োগ করতে হয় শিক্ষিত, দক্ষ এবং পেশাদার লোকবল। এই কাজগুলো খুব সহজে করতে হলে সবার আগে প্রয়োজন এই খাতের স্বীকৃতি এবং সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা। এখন পর্যন্ত এই খাতে মূলধনের জোগান আসে মালিকের প্রদত্ত মূলধন থেকে, যা অপ্রতুল। অনেক প্রতিষ্ঠানের জন্য একমাত্র ব্যাংক ঋণ বিকল্প অর্থের সুবিধা থাকলেও তা মোটেও পর্যাপ্ত নয়।

তাছাড়াও ব্যাংক ঋণের উচ্চ সুদের হারের কারণে যে সকল প্রতিষ্ঠান ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে তাদের ব্যবসার প্রসার ঘটিয়েছেন, তারা প্রতিনিয়ত সমস্যার মধ্যে থাকেন। প্রতিযোগিতামূলক বাজারে ব্যাংক ঋণ সুদসহ পরিশোধ করতে গিয়ে প্রতিষ্ঠানগুলো সবসময়ই আর্থিক চাপে থাকে। ফলে, সেভাবে ব্যবসা পরিচালনা করতে পারেন না। দেশের এই বিশাল খাতকে যথাযথ স্বীকৃতি দিয়ে একটি শৃঙ্খলার মধ্যে নিয়ে আসা যায়, তাহলে এই খাত দেশের পুঁজিবাজার, বিশেষ করে সম্ভাবনাময় বন্ড মার্কেট গড়ে ওঠার ক্ষেত্রে ভালো ভূমিকা রাখতে পারে।

এই খাতের সঠিক বিকাশ ত্বরান্বিত করে এখানে মানসম্পন্ন সেবা নিশ্চিত করতে হলে, এই খাতকে যথাযথ স্বীকৃতি প্রদান করে এখানে একটি সুশৃঙ্খল ব্যবসায়িক পরিবেশ সৃষ্টি করার বিকল্প নেই। এই প্রচেষ্টার শুরুটা হয়েছে দেশের রেস্তোরাঁ ব্যবসাকে শিল্প হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারির মাধ্যমে। এখন এই প্রজ্ঞাপনকে কেন্দ্র করে বাকি কাজগুলো করতে হবে। তাহলেই দেশের এই বৃহৎ সেবা খাতকে একটি মানসম্পন্ন জায়গায় নিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে। এমনটা করতে পারলে উপকৃত হবে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য, পুঁজিবাজার, এই খাতে নিয়োজিত লাখ লাখ মানুষ এবং সর্বোপরি দেশের অর্থনীতি।

লেখক : সার্টিফাইড অ্যান্টি-মানিলন্ডারিং স্পেশালিস্ট ও ব্যাংকার
টরন্টো, কানাডা
[email protected]

×