
মেট্রোরেল যেন ঢাকাবাসীদের স্বস্তির বাহন
রাজধানীর যানজটের বাস্তবতা এমন পর্যায়ে চলে গেছে যে, যাত্রার সময়টি নিশ্চিত করে বলা যায়, কিন্তু পৌঁছানোর সময় নয়। এই ভয়াবহ যানজট সহনীয় পর্যায়ে আনতে ফ্লাইওভার, লেন, রাস্তা প্রশস্তকরণ মিলিয়ে কত রকম ব্যবস্থা যে নেয়া হয়েছে, সে হিসেব মেলানো কঠিন। কিন্তু যানজটের দুর্ভোগ পিছু ছাড়ছে না। এই পরিস্থিতিতে যখন রাজধানীবাসীদের নাকাল হওয়ার দশা, তখন যেন স্বস্তির শীতল হাওয়া বইয়ে দিচ্ছে স্বপ্নের মেট্রোরেল।
বাংলাদেশ সরকারের মেগা প্রকল্পগুলোর মাঝে মেট্রোরেল অন্যতম একটি প্রকল্প। যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সার্বক্ষণিক নিজস্ব তদারকিতে বাস্তবায়নের পথে অগ্রসর হচ্ছে। করোনা সঙ্কট কাটিয়ে পুরোদমে বাস্তবায়ন হচ্ছে প্রকল্পগুলো। স্বপ্নের পদ্মা সেতুর সুফল ইতোমধ্যে ভোগ করছে দেশবাসী। প্রধানমন্ত্রী ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার যে প্রতিশ্রুতি দেশবাসীকে দিয়েছেন, তা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে তিনি অটুট।
মেট্রোরেল মূলত একটি স্পীড ট্রানজিট বা দ্রুতগামী যোগাযোগ ব্যবস্থা। যা বিশ্বের অনেক প্রধান শহরেরই বহুল ব্যবহৃত পাবলিক ট্রান্স পোটেশন সিস্টেম হিসেবে। বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় নির্মাণাধীন শহরভিত্তিক রেলব্যবস্থা হচ্ছে ঢাকা মেট্রো, যা আনুষ্ঠানিকভাবে ম্যাস র্যাপিড ট্রানজিট বা সংক্ষেপে এমআরটি নামে পরিচিত। ২০১৩ সালে সরকার ঢাকা মহানগরীর ক্রমবর্ধমান যানবাহন সমস্যা ও পথের দুঃসহ যানজট কমিয়ে আনার লক্ষ্যে কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনা প্রণয়ন করে। সেই কৌশল অনুযায়ী প্রথমবারের মতো ঢাকায় মেট্রোরেল স্থাপনের পরিকল্পনা করা হয়।
বাসে উত্তরা থেকে মতিঝিল রোডে যাতায়াতে ৩ থেকে ৪ ঘণ্টার বেশি সময় লেগে যায়। সেখানে মেট্রোরেলের মাধ্যমে ৪০ মিনিটেই পৌঁছানো সম্ভব হবে। ২০১৬ সালে প্রণীত সংশোধিত কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনা অনুযায়ী, মেট্রোরেলের লাইনের সংখ্যা ৩টি থেকে বাড়িয়ে ৫টি করা হয়। প্রথম পর্যায়ে নির্মাণের জন্য উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত ২০.১ কিলোমিটার দীর্ঘ এমআরটি ৬টি লাইনকে নির্বাচন করা হয়। ২০১৬ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২৬ জুন উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের মাধ্যমে এমআরটি লাইন-৬ এর নির্মাণ কাজ শুরু হয়।
বাংলাদেশের মতো একটি দেশে মেট্রোরেল নির্মাণ একটি যুগান্তরকারী পদক্ষেপ। ২০১২ সালের ১৮ ডিসেম্বর বাংলাদেশ সরকারের অন্যতম অগ্রাধিকার ঢাকা ম্যাস স্পীড ট্রানজিট ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট তথা মেট্রোরেল প্রকল্প জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) অনুমোদন লাভ করে। প্রথম পর্যায়ে নির্মাণের জন্য এমআরটি-৬ নামক ২০.১০ কিলোমিটার দীর্ঘ পথকে ঠিক করা হয়।
এই প্রকল্পের মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ২১ হাজার ৯৮৫ কোটি ৫৯ লাখ টাকা। প্রকল্পের সহায়তা হিসেবে জাইকা দেবে ১৬ হাজার ৫৯৪ কোটি ৪৮ লাখ টাকা। প্রকল্প পরিকল্পনা অনুযায়ী উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত মেট্রোরেল চালু হলে দুদিক থেকে ঘণ্টায় ৬০ হাজার যাত্রী পরিবহন করা সম্ভব হবে। এমআরটি-৬ চূড়ান্ত রুট এ্যালাইনমেন্ট হলো উত্তরা তৃতীয় ধাপ পল্লবী-রোকেয়া সরণির পশ্চিম পাশ দিয়ে চন্দ্রিমা উদ্যান, সংসদ ভবন, খামারবাড়ি হয়ে ফার্মগেট, সোনারগাঁও হোটেল, শাহবাগ, টিএসসি দোয়েল চত্বর, তোপখানা রোড থেকে কমলাপুর পর্যন্ত।
এ রুটের ১৬টি স্টেশন হচ্ছে উত্তর উত্তরা, উত্তরা সেন্টার, উত্তরা দক্ষিণ, পল্লবী, মিরপুর-১১, মিরপুর-১০, কাজীপাড়া, শেওড়াপাড়া, আগারগাঁও, বিজয় সরণি, ফার্মগেট, কারওয়ান বাজার, শাহবাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, সচিবালয়, মতিঝিল ও কমলাপুর। ট্রেনে চলাচলের জন্য প্রয়োজন হচ্ছে ১৩.৪৭ মেগাওয়াট বিদ্যুত, যা নেয়া হবে জাতীয় গ্রিড থেকে। এর জন্য উত্তরা, পল্লবী, তালতলা, সোনারগাঁও ও বাংলা একাডেমি এলাকায় ৫টি বিদ্যুত উপকেন্দ্র থাকবে।
২০১৯ সালে ১৫ অক্টোবর এমআরটি-১ এবং এমআরটি-৫ নামক লাইন দুটি নির্মাণ প্রকল্প অনুমোদন দেয়া হয়। এমআরটি-১ প্রকল্পের আওতায় বিমানবন্দর থেকে কমলাপুর ও নতুনবাজার থেকে পূর্বাচল পর্যন্ত মোট ৩১.২৪ কিলোমিটার পথে মেট্রোরেল নির্মিত হবে। এই প্রকল্পের মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ৫২ হাজার ৫৬১ কোটি টাকা। এর মধ্যে জাপান সরকার দেবে ৩৯ হাজার ৪৫০ কোটি টাকা, বাকি ১৩ হাজার ১১১ কোটি টাকা দেবে বাংলাদেশ সরকার।
এমআরটি-১ প্রকল্পে বিমানবন্দর থেকে কমলাপুর পর্যন্ত ১৬ দশমিক ২১ কিলোমিটার হবে পাতাল পথ এবং কুড়িল থেকে পূর্বাচল পর্যন্ত ১১ দশমিক ৩৬ কিলোমিটার হবে উড়াল পথে। নতুন বাজার থেকে কুড়িল পর্যন্ত ৩ দশমিক ৬৫ কিলোমিটার আন্ডারগ্রাউন্ড ট্রানজিশন লাইনসহ ৩১ দশমিক ২৮ কিলোমিটার রেললাইন নির্মাণ করা হবে।
মেট্রোরেলের ১২টি স্টেশন হবে মাটির নিচে এবং ৭টি থাকবে উড়াল সেতুর ওপর। এমআরটি-৫ নির্মাণ প্রকল্পে হেমায়েতপুর থেকে ভাটারা পর্যন্ত ২০ কিলোমিটার লাইন নির্মাণ করা হবে। এই প্রকল্পের ৪১২ হাজার ২৩৮ কোটি টাকার মধ্যে ২৯ হাজার ১১৭ কোটি টাকা দেবে জাপান এবং বাকি ১২ হাজার ১২১ কোটি টাকা দেবে বাংলাদেশ সরকার। প্রকল্পের ২০ কিলোমিটারের মধ্যে ১৩ কিলোমিটার হবে পাতাল পথে আর বাকি সাড়ে ৬ কিলোমিটার হবে উড়াল পথে।
ঠিক তেমনি ঢাকা মেট্রোরেল দেশের মানুষের বিশেষ করে ঢাকা শহরের মানুষের জীবনকে অনেক বেশি সহজ ও অর্থবহ করে তুলবে। মানুষ কাজের সময় অনেক বেশি পাবে। তাতে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিতে মানুষের কর্মঘণ্টা যোগ হবে। উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে। আর্থিকভাবে দেশের মানুষ অনেক বেশি উপকৃত হবে। অন্যদিকে শহরের যানজট অনেক কমে আসবে। মানুষ অল্প সময়ে নিজ কর্মস্থলে পৌঁছে কাজে যোগদান করতে পারবে। খরচও কম হবে। আর্থিকভাবে সাধারণ মানুষ অনেক বেশি উপকৃত হবে। উন্নত হবে মানুষের জীবনমান।
মানুষের কর্মস্পৃহা বৃদ্ধি পাবে। মানুষের মনের আনন্দ বেড়ে যাবে। তাতে বৃদ্ধি পাবে কর্মশক্তি। মানুষ একটি সুন্দর জীবনের কল্পনা করতে অনেক বেশি উৎসাহী হবে। দেশের সুনাম বিশ্বে ছড়িয়ে পড়বে। দেশ যে মধ্য আয়ের দেশে পদার্পণ করেছে, তার বার্তা পৃথিবীতে বেশি বেশি করে ছড়িয়ে পড়বে। উন্নত দেশের সুফল আমরা অনুভব করতে পারব। আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতের পশ্চিমবঙ্গে মেট্রোরেল চালু হয়েছে ১৯৮৪ সাল থেকে। তা আরও বৃদ্ধি পেয়ে নানা দিকের মানুষের সুযোগ সৃষ্টি করে দিয়েছে ইতোমধ্যে।
পৃথিবীর অনেক দেশে মেট্রোরেলই প্রধান ও একমাত্র চলাচলের সহজ বাহন। যেমন- সিঙ্গাপুর, হংকংয়ে মেট্রোরেল দেখার মতো। উপভোগ করার মতো। কম খরচে, অল্প সময়ে যে কোন স্থানে যাতায়াত করা খুবই সহজ। অর্থনেতিক কর্মকা-ে মেট্রোরেল খুব বেশি কার্যকরী ভূমিকা রেখে আসছে। একদিন আমাদের দেশেও মেট্রোরেল সবার প্রিয় যানবাহনে পরিণত হবে। ঢাকা মেট্রোরেল ২০২১ সালে চালু হওয়ার মূল পরিকল্পনায় ছিল। কিন্তু তা সম্ভব হয়নি। সময় বেড়ে যাচ্ছে।
তাতে ব্যয়ও বেড়ে যাবে কিছু। যদি বেশি কম সময়ে নির্মাণ কাজ শেষ করা যেত, তত বেশি ব্যয় কমে আসত। জাপানের আর্থিক ও কারিগরি সহযোগিতায় মেট্রোরেল নির্মাণ হচ্ছে। পদ্মা সেতু যেমন চীনের সার্বিক সহযোগিতায় হয়েছে, তেমনি জাপানের সহযোগিতায় মেট্রোরেল হচ্ছে। ঢাকা মেট্রোরেল প্রকল্প আমাদের দেশের মেগা প্রকল্পের মধ্যে অন্যতম।
সরকারের সবচেয়ে বেশি দৃশ্যবান প্রকল্প ঢাকা মেট্রোরেল প্রকল্প। অন্যটি হচ্ছে পদ্মা সেতু। তাও নিজস্ব অর্থায়নে নির্মাণ। যে পদ্মা সেতুতে অর্থনৈতিক ঋণ বিশ্বব্যাংকের দেয়ার কথা থাকলেও পরবর্তীতে সরকার নিজস্ব অর্থায়নে নির্মাণ কাজ শুরু করে। সরকার এই ক্ষেত্রে বড় চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেছিল এবং সফলও হয়েছে। এ সফলতার ফল আমরা সবাই ভোগ করছি।
ঠিক তেমনি ঢাকা মেট্রোরেল প্রকল্প ঢাকা শহরের মানুষের অনেক দিনের কষ্ট লাঘব করে জীবনমানের উন্নয়নে ভূমিকা রাখবে। দ্রুত সময়ের মধ্যে, মজবুত ও টেকসই নির্মাণ হোক ঢাকা মেট্রোরেল প্রকল্প। এই জাতীয় প্রকল্প দীর্ঘমেয়াদী। যুগ যুগ ধরে এই প্রকল্প থেকে মানুষ যাতে উপকৃত হতে পারে, সেরূপ মজবুত ও টেকসই করে নির্মাণ করা সময়ের দাবি।
দুর্নীতিমুক্ত সমাজ গড়তে সরকার বদ্ধপরিকর। দুর্নীতিমুক্ত কর্মকা- সবার কাম্য। যত বেশি দুর্নীতিমুক্ত কাজ হবে, তত বেশি উন্নয়ন সঠিক হবে। ব্যয় হ্রাস পাবে। দেশের অর্থনীতিতে অনেক বেশি ভূমিকা রাখবে। প্রকল্পের ব্যয় বৃদ্ধি পায় সময় বেশি লাগার কারণে। সময় বেশি লাগার ফলে দুর্নীতিও বেড়ে যায়। চাই দক্ষ, সৎ ও দেশপ্রেমিক কর্মীবাহিনী।
যে কোন মেগা প্রকল্পের ব্যয় যা কমিয়ে আনতে পারে। মেট্রোরেল ও লাইনের নক্সা অনুযায়ী এটি সর্বোচ্চ ১১০ কিলোমিটার গতিতে চলতে পারবে। তবে যাত্রী নিয়ে কত গতিতে চলবে, স্টেশনে কতক্ষণ থামানো হবে এবং ভাড়া কত হবে, এসব বিষয় এখনও চূড়ান্ত হয়নি। মেট্রোরেলের নক্সা প্রণয়ন ও তৈরির দায়িত্বে রয়েছে জাপানের কাওয়াসাকি-মিৎসুবিশি কনসোর্টিয়াম।
তাদের অধীনেই সব ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হবে। যখন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান আনুষ্ঠানিভাবে বাংলাদেশকে ট্রেনগুলো হস্তান্তর করবে, তখন বাংলাদেশের নিয়োগ দেয়া চালক ট্রেন চালাবেন। ইতোমধ্যে সরকার চালক নিয়োগ দিয়েছে। তাদের প্রশিক্ষণও চলছে। বিদেশেও প্রশিক্ষণ দেয়া হবে। সব ঠিক থাকলে মেট্রোরেল উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত চালু হবে চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে। প্রাথমিকভাবে ভাড়াও নির্ধারণ করা হয়েছে। তবে কমলাপুর পর্যন্ত এই প্রকল্পের মেয়াদ ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত। মেয়াদের পূর্বে মেট্রোরেল চালু হবে বলে আমরা আশা রাখি।
লেখক : ট্রেজারার, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়