অজয় দাশগুপ্ত
প্রশান্ত মহাসাগরের পারে বসবাস আমাদের। প্যাসিফিক ওসানের নাম প্রশান্ত দিয়েছিলেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। যিনি কখনও এদেশে আসেননি। একইভাবে বাংলাদেশীদের পদভারে মুখরিত এদেশেও আসেননি তিনি। তাতে কি? এ দুই বাঙালী শ্রেষ্ঠই আমাদের বাঁচিয়ে রেখেছেন। আজ সিডনি মেলবোর্নসহ বড় বড় শহরে বাংলাদেশীদের মুখর জীবন দেখলে মনে হয় না আমরা নবীন জাতি। কিংবা আমাদের বয়স মাত্র ৫০ বছর।
সদর্পে উঠে আসা এই জাতির ভিত্তিভূমি তৈরি করে দিয়েছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তাঁর জীবন ও সংগ্রামের দিকে ফিরে তাকালেই বোঝা যায়, বাঙালীকে একটি স্বাধীন দেশ, এক নতুন পরিচয় দেয়ার জন্য কতটা ত্যাগ স্বীকার করেছিলেন তিনি।
আমাদের বেশির ভাগ মানুষই এই ঋণ স্বীকার করেন। তারা কোন্ দল করেন বা রাজনীতি আদৌ করেন কি না তা বড় বিষয় না। বড় কথা সবাই মিলেই বঙ্গবন্ধুর প্রতি শ্রদ্ধাবনত থাকতে চায়। কিন্তু এই সবাইর ভেতর একটা ছোট ফাঁক আছে। একদল বাংলাদেশী নামে পরিচিত পাকিপ্রেমীরা এখনও দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভোগে। তারা ভুলে যায় রাজনীতির উর্ধে উঠে এই মানুষটিকে শ্রদ্ধা জানানোই আমাদের কর্তব্য।
এদেশের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক শুরু থেকেই নিবিড়। অস্ট্রেলিয়া প্রথম শ্বেতাঙ্গ দেশ যারা আমাদের স্বীকৃতি দিয়েছিল। এদেশের প্রথম রাষ্ট্রদূত যিনি আমাদের দেশে গিয়েছিলেন, তিনি বাংলা জানতেন। বাংলা জানার কারণে তার যোগাযোগ ছিল নিখুঁত। এদেশের মান্যবর নেতা গফ হুইটলাম প্রথম তেমন এক অতিথি, যিনি বাংলাদেশ সফর করে পশ্চিমা বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন।
আমি পিটারকে চিনি কর্মসূত্রে। খাঁটি অজি পিটার যখন জেনেছিল আমি বাংলাদেশী, এক অপার্থিব আনন্দে তার চোখ-মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল সেদিন। জানা যায়, তার বড় ভাই ছিলেন জর্জ হ্যারিসনের দলে।
বাংলাদেশ কনসার্টের সঙ্গে সম্পৃক্ত পরিবারের সন্তান পিটার আমাকে পাইয়ে দিয়েছিল একটি ক্যাসেট। জানিয়েছিল সিডনির বেলমেইন এলাকার কোন দোকানে এই ছবিগুলো সযত্নে জমা আছে। পিটার বঙ্গবন্ধু হত্যার দিনটিকেও মনে রেখেছেন। সেই আমাকে জানিয়েছিলেন পরদিন অস্ট্রেলিয়ান মিডিয়া খবরের কাগজগুলো হতভম্ব আর বিষণ্ণ খবরে জানিয়েছিল, এমন নেতাকেও কি কেউ হত্যা করতে পারে? তাও নিজের দেশের সেনা বাহিনীর কিছু লোক, এটা ভাবা মুশকিল।
বঙ্গবন্ধু হত্যার পর যে মানুষটি বিমর্ষ থাকতেন, তাঁর হত্যাকা-ে উল্লসিত এক কর্মচারীকে বাটা কোম্পানি থেকে বহিষ্কার করা বাটার সিইও ছিলেন ডাচ অস্ট্রেলিয়ান ওডারল্যান্ড। একমাত্র বিদেশী বীর প্রতীক ওডারল্যান্ড এই হত্যাকা-ের পর বাংলাদেশ ছেড়ে এসে আর যাননি। এমনকি সংবধর্না নিতেও যাননি তিনি। মাত্র একবার টেলিফোনে কথা বলার সৌভাগ্য হয়েছিল। বহু চেষ্টার পর সে যোগাযোগে তাঁর পত্নী আমাকে স্পষ্ট জানিয়েছিলেন, বঙ্গবন্ধু হত্যাকা- আর চার জাতীয় নেতার হত্যার পর তিনি আমাদের ওপর বেজায় ক্ষুব্ধ। কথাই বলতে চান না কারও সঙ্গে। তারপরও তাঁকে শ্রদ্ধা জানানোর সুযোগ পেয়েছিলাম আমি।
বঙ্গবন্ধুর হত্যাকা- যে কত বিদেশীর মনে এমন প্রভাব ফেলেছে, আমরা তার খবর রাখিনি। আমাদের দেশে হয় স্তাবকতার উল্লাস, নয় তো নিন্দা, এর বাইরে কিছু থাকে না। পঁচাত্তরের পর থেকে ক্রমাগত বঙ্গবন্ধু বিরোধিতা আর মিথ্যাচারে তিনি হয়ত ঢাকা পড়ে যাননি, কিন্তু ঝাপসা হতে শুরু করেছিলেন। এখন চলছে বঙ্গবন্ধু স্রোত। কিন্তু যে কাজগুলো হলে আমাদের নেতা সারা দুনিয়ায় তাঁর আসল পরিচয় নিয়ে উদ্ভাসিত হবেন, যা যা করলে তিনি আজীবন সে জায়গায় থাকবেন তার নমুনা এখনও দেখি না।
অথচ সেই কবে তিনি তাঁর ভাষণে জাতিসংঘে ঘোষণা করেছিলেন: বঙ্গবন্ধু জাতিসংঘে বক্তৃতা শেষ করেন ‘মানুষের অজেয় শক্তির প্রতি বিশ্বাস এবং মানুষের অসম্ভবকে জয় করার ক্ষমতার’ ওপর প্রত্যয় ব্যক্ত করে। তিনি বলেন, ‘আমরা দুঃখ ভোগ করিতে পারি, কিন্তু মরিব না। টিকিয়া থাকার চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করিতে জনগণের দৃঢ়তাই চরম শক্তি...জনগণের ঐক্যবদ্ধ ও সমন্বিত প্রয়াসের মাধ্যমেই আমরা আগাইয়া যাইব।’
তখন বাংলাদেশকে তেমন করে কেউ চিনত না, জানত না। তার পরিচয় টিকবে কি টিকবে না এ নিয়ে চলছিল তর্ক। আমেরিকা চীনসহ শক্তিধর দেশগুলোর অনেকেই গুজব আর তলাবিহীন ঝুড়ি বলে আত্মতৃপ্তিতে মগ্ন। তখন শুধু মানুষের ভালবাসা আর নিজের শক্তির ওপর ভর করে এই মানুষটি আমাদের পরিচয় করাতেন বিশ্বের সঙ্গে। যে কারণে তাঁর মর্মান্তিক হত্যাকা-ের পর সুদূর প্রশান্ত পারেও শোকের ছায়া নেমেছিল।
আর্কাইভ থেকে যখন তখনকার পত্রিকাগুলো খুলে দেখেছি, অবাক হয়েছি যে দেশের কোন কোন শহরে একজন বাঙালীও বাস করত না, সেদেশের মিডিয়া ঘৃণা ভরে প্রত্যাখ্যান করেছিল হত্যাকা-। স্তব্ধ হয়ে বলেছিল: এও সম্ভব? এমন বাঙালী আমাদের ভূখ-ে ও ইতিহাসে আর জন্মায়নি। দেশে-বিদেশে সব তর্ক সব রাজনীতির ওপরে তাঁর অবস্থান। তিনিই বাঙালীর পিতা, আমাদের বন্ধু, আমাদের বঙ্গবন্ধু।