ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

ডিজিটাল যুগের পথে-৬

মোস্তাফা জব্বার

প্রকাশিত: ২১:৪১, ৭ আগস্ট ২০২২

ডিজিটাল যুগের পথে-৬

মোস্তাফা জব্বার

ডিজিটাল শিক্ষা : বর্তমান সরকার শিক্ষাক্ষেত্রে অভাবনীয় সফলতা অর্জন করেছেসেই বিষয়ে এমনকি সরকারের নিন্দুকেরাও প্রশ্ন তোলেন না৫ম শ্রেণী পর্যন্ত কনটেন্ট ডিজিটাল করে ৬৫০টি সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তা প্রয়োগ করা হচ্ছেপ্রাথমিক ও নিম্ন মাধ্যমিক স্তরের পাবলিক পরীক্ষার প্রচলন করা ছাড়াও মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক প্রদানের সরকারী সিদ্ধান্ত পুরো দেশের মানুষের প্রশংসা পেয়েছেএকই সঙ্গে একটি ডিজিটাল শিক্ষাব্যবস্থা প্রচলনে সরকারের আন্তরিকতা সকল মহলে প্রশংসিত হয়েছেসরকার তথ্যপ্রযুক্তি শিক্ষা ও শিক্ষায় তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার বিষয়ে একটি নীতিমালা ও কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করেছে এবং তার বাস্তবায়নের জন্য ব্যাপক কর্মকান্ড গ্রহণ করেছেসরকারের হাতে শিক্ষার ডিজিটাল যাত্রার সবচেয়ে বড় যে প্রকল্পটি এখন রয়েছে সেটি হলো : ২০ হাজার ৫০০ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ল্যাপটপ ও প্রজেক্টর প্রদান করে স্মার্ট ক্লাসরুম গড়ে তোলা৩ হাজার ৫৬ কোটি টাকার প্রকল্পটি এখন বাস্তবায়নাধীন রয়েছে

এরই মাঝে সরকার এই ধারণার প্রাথমিক প্রয়োগের কাজটি শুরু করেছেদেশের সর্বত্র শিক্ষক প্রশিক্ষণ কেন্দ্রগুলোতে ইন্টারএ্যাকটিভ ও ডিজিটাল শিক্ষা কনটেন্টস তৈরির প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছেশিক্ষকরা ডিজিটাল কনটেন্টস  তৈরি করছেন এবং  সেই সব তথ্য সকলের জন্য উন্মুক্ত করা হয়েছেকিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ডিজিটাল শিক্ষার বাস্তব প্রয়োগ করা হয়েছেঅনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ডিজিটাল ক্লাসরুম চালু হয়েছে এবং পর্যায়ক্রমে সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সকল ক্লাসরুম ডিজিটাল করার পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে

বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও সরকারী বেসরকারী গ্রন্থাগারের ব্যবস্থাপনা ডিজিটাল করার পাশাপাশি ডিজিটাল লাইব্রেরি ও ই-তথ্য ভান্ডার গড়ে তোলা হচ্ছে যা শিক্ষার্থীদের জ্ঞান অর্জনের সহায়ক হয়েছে

সচেতনতা বৃদ্ধি : এ বিষয়ে সকলেই একমত যে, ডিজিটাল বাংলাদেশ ঘোষণাটি নিজেই একটি বড় ধরনের অর্জন ও বড় রকমের সচেতনতা কর্মসূচীএর ফলে দেশ-বিদেশে বাংলাদেশ তার ভাবমূর্তিকে উজ্জ¦ল করেছেআমরা লক্ষ্য করেছি, এই সময়ে ডিজিটাল বাংলাদেশ বিষয়ে ব্যাপক সচেতনতামূলক কাজ হয়েছেবাংলাদেশ কম্পিউটার সমিতি, বেসিস ও অন্যান্য সংস্থার পাশাপাশি সরকার ডিজিটাল উদ্ভাবনী মেলাকে জেলা পর্যায় পর্যন্ত ছড়িয়ে দিয়েছেএই সময়ের একটি বড় ঘটনা ছিল ২০০৯ সালে বাংলাদেশ কম্পিউটার সমিতি কর্তৃক ডিজিটাল বাংলাদেশ সামিটের আয়োজন করা এবং ২০১১ সালে ই-এশিয়ার মতো বিশাল একটি সম্মেলনের আয়োজন করাডিজিটাল বাংলাদেশ ঘোষণার জন্য এসোসিও নামক একটি প্রতিষ্ঠান প্রধানমন্ত্রীকে বিশেষ পুরস্কারও প্রদান করে

ডিজিটাল জীবনধারা : দেশের সংসদ, সরকার ও জীবনযাপনের সকল ব্যবস্থা ডিজিটাল হওয়ার ফলে দেশের মানুষ একটি ডিজিটাল জীবনধারায় বসবাস করছেদেশের ব্যবসা-বাণিজ্য, সামাজিকতা, রাজনীতি, জীবনযাপনসহ সামগ্রিক জীবনধারা ডিজিটাল পদ্ধতির হচ্ছে।  বাংলাদেশের মানুষ এরই মাঝে একটি ডিজিটাল যুগের বাসিন্দা হওয়ার স্বাদ নিতে শুরু করেছেডিজিটাল জীবনধারা হচ্ছে একটি জাতি-গোষ্ঠীর সার্বিক জীবনধারাকে ডিজিটাল রূপান্তরের মাঝে নিয়ে যাওয়াডিজিটাল বাংলাদেশের কথা বলার মানেই হচ্ছে সেই জীবনধারা গড়ে তোলাআমরা লক্ষ্য করেছি যে, আমাদের দেশের মানুষের হাতে ডিজিটাল ডিভাইস বেশ দ্রুত গতিতে পৌঁছাচ্ছেদেশের অর্ধেক জনগোষ্ঠীর হাতে মোবাইল ফোন আছেআছে ইন্টারনেট এবং আরও ডিজিটাল প্রযুক্তিএখন মানুষ যে পরিমাণ কাগজে যোগাযোগ করে তার চাইতে অনেক বেশি যোগাযোগ করে ইন্টারনেটেই-মেইল এমনকি প্রত্যন্ত গ্রামের মানুষের কাছেও নতুন কিছু নয়তারা দেশের ভেতরে ও বাইরে টেক্সট, ছবি, অডিও-ভিডিও আদান-প্রদান করেফেসবুক, ইউটিউব বা টিকটকের মতো সামাজিক যোগাযোগ নেটওয়ার্ক বাংলাদেশে ব্যাপকভাবে জনপ্রিয়আমরা এরই মাঝে ডিজিটাল-কমার্স, মোবাইল কমার্স ও মোবাইল ব্যাংকিং-এর যুগে প্রবেশ করেছিঅনলাইনে লেখাপড়া করা, বিনোদন পাওয়া, টিভি দেখা বা খবর পড়া বাংলাদেশের মানুষের দৈনন্দিন বিষয়ে পরিণত হয়েছে

আগামীর কর্ম পরিকল্পনা : সার্বিকভাবে তেরো বছর মেয়াদী একটি মহাযজ্ঞের সূচনা হিসেবে ২০০৯ থেকে এখন পর্যন্ত সরকার যেসব পদক্ষেপ নিয়েছে তাকে কেবল প্রকৃষ্ট বললেই যথেষ্ট বলা হবে না বরং এই সময়ের মাঝে একটি সভ্যতার রূপান্তরের জন্য প্রাথমিক ভিত রচনায় পাওয়া গেছে অভাবনীয় সফলতাকিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এই সফলতা কি ধরে রাখা যাবে? প্রথমত, এটা মূল্যায়ন করা প্রয়োজন যে, ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে তোলার জন্য আগামী দিনের পরিকল্পনাগুলো কি সঠিক রয়েছেপ্রথমত, সরকারের পরিকল্পনার কথাই বলতে হয়

বিগত দিনে মোটামুটিভাবে সকলে মিলেই প্রাথমিক কাজগুলো এমনকি আলাদা আলাদাভাবেই করা সম্ভব হয়েছেকিন্তু আগামীতে সরকারী কাজের সমন্বয়টি আরও পরিকল্পিত হতে হবেডিজিটাল বাংলাদেশ কর্মসূচী, এর ধারণা, কাজের গতি, পরিকল্পনা ও নীতিমালাসমূহ রাজনৈতিক আলোচনার বিষয় হিসেবে তৃণমূল পর্যায়ে ছড়িয়ে দিতে হবেডিজিটাল বাংলাদেশ বিষয়ক অগ্রগতির বিপরীতে একটি শঙ্কার কথা আমরা প্রায়ই শুনিআমরা যদি বাংলাদেশের স্বাধীনতার সময়কাল থেকে এখন পর্যন্ত কেবলমাত্র তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি খাতের উন্নয়ন ও বিকাশের বিষয়টি পর্যালোচনা করি তবে দেখব যে, আওয়ামী লীগের সময়কালে যে ধরনের কার্যক্রম গ্রহণ করা হয় সেটি পরবর্তী সরকার (কাকতালীয়ভাবে বিএনপি) ক্ষমতায় আসার পরই বন্ধ করে দেয়আমরা ২০০১ সালের খালেদার সরকারের কর্মকান্ড পর্যালোচনা করলে এই বিষয়টি খুবই স্পষ্টভাবে শনাক্ত করতে পারবআওয়ামী লীগ সেই সময়ে আইসিটির উন্নয়নে যেসব পদক্ষেপ নিয়েছিল তার সবই বন্ধ করে দেয়া হয়

অর্থনীতি : এবার আমি ২০০৫-০৬ অর্থবছর থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে কয়েকটি সূচকের তুলনামূলক চিত্র তুলে ধরছি

২০০৫-০৬ বছরে মাথাপিছু আয় ছিল ৫৪৩ মার্কিন ডলারবর্তমানে যা ২??৪ ডলার হয়েছেঐ সময়ে দারিদ্র্যের হার ছিল ৪১.৫ শতাংশবর্তমানে তা কমে ২০.৫ শতাংশে দাঁড়িয়েছেজিডিপির আকার ৪ লাখ ৮২ হাজার ৩৩৭ কোটি থেকে ২৮ লাখ কোটি টাকা হয়েছেবৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পরিমাণ ছিল মাত্র ০.৭৪৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার অর্থা এক বিলিয়ন ডলারের কমবর্তমানে তা ৪৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে উন্নীত হয়েছে

মানুষের গড় আয়ু ২০০৫-০৬ বছরের ৫৯ বছরবর্তমানে বেড়ে ৭২.৫ ভাগে উন্নীত হয়েছেঐ সময় সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বরাদ্দ ছিল ৩৭৩ কোটি টাকাএই খাতে চলতি অর্থবছরে ১ লাখ ৭ হাজার ৬১৪  কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়বিদ্যুত উপাদন সক্ষমতা ৪,৯০০ মেগাওয়াট থেকে ২৪ হাজার ৪২১ মেগাওয়াটে বৃদ্ধি পেয়েছেবিদ্যুত সুবিধাভোগী জনসংখ্যা ৪৭ থেকে ৯৯ শতাংশে উন্নীত হয়েছে

এক যুগ আগের বাংলাদেশ আর আজকের বাংলাদেশ এক নয়বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাব অনুযায়ী গত ২০২০-২১ অর্থবছরে বাংলাদেশের অর্থনীতির আকার দাঁড়িয়েছে ৩৪ লাখ ৮৪ হাজার ৩৩ কোটি টাকা২০০৮-০৯ বছরে রফতানি আয়ের পরিমাণ ছিল ১৫.৫৭ বিলিয়ন ডলার২০২১-২২ অর্থবছর বাংলাদেশের পণ্য ও সেবা রফতানি ৫০ বিলিয়ন ডলারের মাইলফলক স্পর্শ করবে বলে আশা করছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও রফতানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি)বাংলাদেশ বিশ্বে ধান উপাদনে ৩য় এবং মাছ-মাংস, ডিম, শাকসবজি উপাদনেও স্বয়ং-সম্পূর্ণঅভ্যন্তরীণ মুক্ত জলাশয়ে মাছ উপাদন বৃদ্ধির হারে বাংলাদেশ দ্বিতীয় স্থানে এবং ইলিশ উপাদনকারী ১১ দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান প্রথম

২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট অর্জন, ২০৩১ সালের মধ্যে উচ্চমধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হওয়া এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশে পরিণত হওয়ার ক্ষেত্রে আমাদের জন্য এটি একটি বিশেষ ধাপ

ইতোমধ্যে আমরা অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা গ্র্রহণ করেছিটেকসই উত্তরণের লক্ষ্যে বিভিন্ন কৌশল এতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছেপদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, কর্ণফুলী নদীর তলদেশে টানেল, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুত প্রকল্প, মহেশখালী-মাতারবাড়ি সমন্বিত উন্নয়ন প্রকল্পসহ বেশকিছু মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছেএগুলোর কতগুলো আগামী বছরের শুরুতে চালু হবেএছাড়াও সারাদেশে একশত বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল, দুই ডজনের বেশি হাইটেক পার্ক এবং আইটি ভিলেজ নির্মাণের কাজ এগিয়ে চলছেআমরা গত ১২ ডিসেম্বর ২১ ফাইভ-জি নেটওয়ার্ক যুগে প্রবেশ করেছিএ প্রযুক্তির বাস্তবায়নের ধারাবাহিকতায় কর্মসংস্থান তৈরিসহ আমাদের অর্থনীতিতে আরও গতি সঞ্চার হবে।  (সমাপ্ত)

ঢাকা, ৬ আগস্ট ২০২২

লেখক :  তথ্যপ্রযুক্তিবিদকলামিস্ট, দেশের প্রথম ডিজিটাল নিউজ সার্ভিস আবাস-এর চেয়ারম্যান- সাংবাদিক, বিজয় কীবোর্ড ও সফটওয়্যার এবং বিজয় ডিজিটাল শিক্ষা সফটওয়্যারের উদ্ভাবক, ডিজিটাল প্রযুক্তির অনেক ট্রেডমার্ক, প্যাটেন্ট ও কপিরাইটের স্বত্বাধিকারী

[email protected]
www.bijoyekushe.net.bd

×