ড. মোঃ শফিকুল ইসলাম
করোনাভাইরাস বিশ্ব অর্থনীতিতে যে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে, তা কাটিয়ে উঠতে সকল রাষ্ট্র হিমশিম খাচ্ছে। তারপর শুরু হয়েছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। যা বিশ্বকে অবাক করে নতুন সঙ্কটে ফেলে দিয়েছে। যা থেকে রেহাই পায়নি উন্নত দেশগুলো। আমাদের দেশেও এর নেতিবাচক প্রভাব রয়েছে। যার জন্য জ্বালানির দাম বৃদ্ধি এবং সরবরাহে ঘাটতি সৃষ্টি হয়েছে। ডলারের বিপরীতে আমাদের টাকার মান কমে গিয়েছে। মূল্যস্ফীতি বেড়েছে অনেক গুণ, যা গত নয় বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ।
খাদ্য মূল্যস্ফীতি মানুষকে কঠিন বিপদে ফেলে দিয়েছে। গরিব মানুষ খুবই নাজেহাল অবস্থায় তাদের জীবন অতিবাহিত করছে। শুধু গরিব নয় মধ্যবিত্তরাও সঙ্কটে রয়েছে। পারে না বলতে কিন্তু সহ্য করতে হচ্ছে। বাজারে গেলেও চোখে চিন্তার ভাঁজ দেখা যায়। কারণ সীমিত আয় দিয়ে সংসার চালানো কঠিন হয়ে পড়ছে। বিশ্বব্যাপী জ্বালানি ও নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের উর্ধগতিতে দরিদ্র দেশগুলোতে গত তিন মাসে ৭ কোটি ১০ লাখ মানুষ দরিদ্র হয়ে পড়েছে।
যদিও প্রত্যেক দেশের সরকার গত দুই বছর অর্থনীতির চাকা সচল রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছে। তারপরও অনেক মানুষের উপার্জন ক্ষমতা কমে গিয়েছে। যেভাবে দ্রব্যমূল্যের দাম বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা মানুষের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে চলে গিয়েছে। শ্রমের বিনিময়ে যে পরিমাণ আয় বেড়েছে, তার চেয়ে খরচ বেড়েছে বেশি। তাই মানুষ বিপদে পড়ছে। গণমাধ্যমে দেখলাম যে একজন মানুষ মাসে পঞ্চাশ হাজার টাকা আয় করেও তার পক্ষে মাসের ব্যয় বহন করা কঠিন হয়ে পড়ছে। সাধারণ এবং গরিব মানুষের অস্বস্তির জীবন পণ্যমূল্যে বেড়েছে।
নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য বৃদ্ধিসহ সকল জিনিসের দাম বেড়ে যাওয়ায় তাদের জীবনে নেমে আসছে অন্ধকার সময়। এছাড়াও পানি ও গ্যাসের দাম বৃদ্ধি পাচ্ছে। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি ও জ্বালানি সঙ্কট সাধারণ মানুষের জীবনে এক কালো মেঘ হিসেবে হানা দিয়েছে। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি অনেকদিন ধরে চলছে। কিন্তু বর্তমানে জ্বালানি সঙ্কট জীবনে মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা। জ্বালানি সঙ্কট নিয়ে সরকার যে পদ্ধতি নিয়েছে, তা অনেক ক্ষেত্রে কার্যকর। এই অবস্থাই জ্বালানি সাশ্রয় ছাড়া আর কোন উপায় নেই।
তবে সরকারকে এ বিষয়ে আরও কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। আমাদের সবাইকে সচেতন হবে জ্বালানি ব্যবহারে। জ্বালানি সঙ্কট বাংলাদেশের শুধু নয়, এটা হলো বিশ্ব সঙ্কট। জ্বালানি সঙ্কট মোকাবেলায় নতুন গ্যাসক্ষেত্রের সন্ধান করে তা উত্তোলন করতে হবে। আমরা গ্যাস উত্তোলনে কেন পিছিয়ে আছি বা নতুন গ্যাসক্ষেত্র অনুসন্ধান কেন করতে পারছি না-এ বিষয়ে খতিয়ে দেখার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে সর্বোচ্চ পরিমাণ গ্যাস উৎপাদন করা নিশ্চিত করতে হবে।
আমাদের আমদানিনির্ভরতা কমাতে হবে। বিদেশী ফল ও অন্যান্য অপ্রয়োজনীয় জিনিস আমদানি করা বন্ধ করতে হবে। দেশীয় ফল খাওয়ার বিষয়ে জনগণকে উৎসাহিত করতে হবে। এতে আমাদের বৈদেশিক মুদার রিজার্ভের ওপর চাপ কমবে। এছাড়া বিদেশ থেকে বিলাসী পণ্য আমদানি বন্ধ করতে হবে। প্রতি লিটার সয়াবিন তেল বিক্রি হচ্ছে ২০০ বা তার বেশি দামে। সরকার কর্তৃক নির্ধারিত দরে এখনও সয়াবিন তেল ক্রয় করা যাচ্ছে না। চাল কিনতাম ২০ কেজি ১৩৫০। এখন সেই চাল কিনতে হচ্ছে ১৯৫০ বা ২০০০ টাকায়। তাহলে মানুষ কি খাবে। আমাদের চালের উৎপাদন বাড়িয়ে চালের সরবরাহ বৃদ্ধি করতে পারলে এই সমস্যা থেকে রেহাই পাওয়া যেতে পারে।
বিশ্ববাজারে দাম কমলেও আমাদের দেশে বাজারে পূর্বের দামে জিনিসপত্র বিক্রি করে ব্যবসায়ীরা। কিন্তু অন্যান্য দ্রব্যের বাড়তি দাম বহনে পিষ্ট হচ্ছে প্রান্তিক, শ্রমজীবী ও সীমিত আয়ের মানুষ। সরকার ভোজ্যতেল আমদানি ও বাজার নিয়ন্ত্রণে রাখতে শুল্ক কমিয়ে আনতে পারে। ফলে তেলের দাম কমতে পারে বাজারে।
মোটা চাল ২০২১ সালে বিক্রি হতো কেজি প্রতি ৪৫ টাকা, এখন অনেক বেশি দামে ওই চাল কিনতে হচ্ছে। মানুষ কি খাবে এবং কি করবে। বাজারে গেলে মানুষ এখন অসহায় হয়ে যায়। গরিব মানুষ খুবই মানবেতর জীবনযাপন করছে।
মূল্যস্ফীতি ও জ্বালানি সঙ্কট অর্থনীতির জন্য এক অশনিসংকেত। এই মূল্যস্ফীতিকে নিয়ন্ত্রণ না করতে পারলে ভবিষ্যতে আরও বড় বিপদ হতে পারে। সেজন্য বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংককে সঠিকভাবে অর্থ বাজার মনিটরিং করতে হবে। মূল্যস্ফীতিতে সীমিত আয়ের মানুষের ওপর বেশি নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। তাই নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস চাল, ডাল, তেল, চিনি, আটা ও লবণের দাম যাতে সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতার নাগালে থাকে, সেই ব্যবস্থা সরকারকে নিতে হবে।
মূল্যস্ফীতি সাড়ে ৭ শতাংশ যা গত ৯ বছরে সর্বোচ্চ। যা সাধারণ মানুষকে চাপে ফেলছে। তাই মূল্যস্ফীতিতে সামলে কিভাবে সাধারণ মানুষকে স্বস্তি দেয়া যেতে পারে সেই বিষয়ে কর্তৃপক্ষকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করতে হবে। সরকারকে দেশের হতদরিদ্র মানুষের সুবিধার কথা বিবেচনা করে বিভিন্ন উৎপাদনমুখী খাতে ভর্তুকি আরও বাড়াতে হবে। এতে সাধারণ মানুষের কল্যাণ বয়ে আনবে।
তবে আমাদের মারাত্মক সমস্যা ভোজ্যতেল ও চালের মূল্যবৃদ্ধি। সরকার তেলের দাম নির্ধারণ করে দিয়েছে। কিন্তু সেই অনুসারে বাজারে বিক্রি হচ্ছে না কেন, সেই বিষয়ে সরকারকে বাজারে তদারকি বাড়াতে হবে, যাতে সাধারণ মানুষ আর ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। এই তেল বা চাল সমস্যা থেকে উত্তরণের জন্য অন্যদেশের ওপর নির্ভরতা কমাতে হবে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ অভ্যন্তরীণ বাজারে কঠোর তদারকির মাধ্যমে দেশে উৎপাদিত পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি ঠেকানো সম্ভব।
পাশাপাশি মূল্যস্ফীতির চাপে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের জন্য সামাজিক সুরক্ষায় বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। যা সাধারণ মানুষের জন্য কল্যাণ বয়ে আনবে। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম যেহারে বৃদ্ধি পাচ্ছে, সেই অনুসারে মানুষের আয় বা মজুরি বাড়েনি। তাই ভোগান্তি বেশি হচ্ছে সাধারণ বা নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য। এই ভোগান্তি কমাতে না পারলে সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি হবে। তাই সরকারকে এ বিষয়ে বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে।
টিসিবির মাধ্যমে পণ্য বিক্রি বাড়াতে হবে। কারণ অতীতে শুধু দরিদ্র মানুষদের টিসিবির ট্রাক থেকে পণ্য কিনতে দেখা যেত, এখন মধ্যবিত্তরাও যোগ দিয়েছে সেই কাতারে। ভোর থেকে সাধারণ মানুষ টিসিবির ট্রাকের অপেক্ষায় থাকে। ট্রাক আসতেই হুড়োহুড়ি লেগে যায়। ফ্যামিলি কার্ডের মাধ্যমে দিলে এর সুরাহা হতে পারে।
অনেকেই মনে করছেন, মহামারী ও যুদ্ধের বিশৃঙ্খলার সুযোগ নিয়ে চাহিদা ও সরবরাহের মধ্যে বিঘ্ন ঘটিয়ে বিশ্ববাজারে খাদ্য পণ্যের দাম বৃদ্ধি করা হচ্ছে। তাই বিশ্ব নেতাদের এ বিষয়ে সজাগ থেকে গরিব ও দরিদ্র মানুষকে অর্থনৈতিক বিপদ থেক উদ্ধার করতে হবে। তাহলে বিশ্বে শান্তি বিরাজ করবে। ব্যাপক মূল্যস্ফীতি, বৈদেশিক মুদার রিজার্ভে সঙ্কট এবং জ্বালানি সঙ্কটে শ্রীলঙ্কাকে সঙ্কটে ফেলছে। তাই সরকারকে সতর্ক থাকতে হবে। যদিও আমাদের অর্থনীতি শ্রীলঙ্কার চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী। তারপরও কোন অবহেলা করা যাবে না।
বাজারে দ্রব্যমূল্যের দাম বৃদ্ধি করতে যেসব সিন্ডিকেট রয়েছে তাদেরকে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে বিচারের আওতায় আনতে হবে। আমরা যারা চাকরিজীবী তারাই সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছি আর গরিব মানুষ যে কিভাবে চলছে, তা বলার প্রয়োজন রাখে না। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ না করতে পারলে গরিবের মুখে হাসি ফোটানো কঠিন হয়ে পড়বে। যেভাবেই হোক সরকারকে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করে এবং জ্বালানি সঙ্কট মোকাবেলায় কার্যকর উদ্যোগের মাধ্যমে গরিবের মুখে হাসি ফোটাতে হবে- এটাই জনগণের প্রত্যাশা।
লেখক : সাবেক সভাপতি,
শিক্ষক সমিতি, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়,
ময়মনসিংহ