দুর্ঘটনায় একাধিক মৃত্যুর
রাজধানীসহ সারাদেশে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় একাধিক মৃত্যুর খবর আসছে প্রায় প্রতিদিন। এসব দুর্ঘটনায় বেশির ভাগ ক্ষেত্রে আরোহীর মাথায় হেলমেট থাকলেও তাদের জীবন রক্ষা হচ্ছে না। এর মূল কারণ হচ্ছে মানসম্মত হেলমেট না থাকা। আমরা হেলমেট পরছি কিন্তু সেটা নিম্নমানের হেলমেট। জীবন রক্ষা করার জন্য নয়, শুধু পুলিশের মামলা থেকে বাঁচতেই আমরা নামমাত্র হেলমেট ব্যবহার করে সড়কে নামছি।
যা সড়ক দুর্ঘটনায় আমাদের মৃত্যুঝুঁকিতে রাখছে। সড়ক ও পরিবহন বিশেষজ্ঞদের তথ্যানুযায়ী চার চাকার বাহনের তুলনায় মোটরসাইকেলের দুর্ঘটনার ঝুঁকি ৩০ গুণ বেশি। হতাহতের পরিমাণ বাস দুর্ঘটনায় বেশি হলেও দুর্ঘটনার দিক দিয়ে মোটরসাইকেলই এগিয়ে।
সড়ক পরিবহন আইন অনুযায়ী, মোটরসাইকেলে যাত্রী থাকলে চালকসহ দুজনকেই হেলমেট পরতে হবে। এ নিয়ে কড়াকড়ি আরোপের পর মোটরবাইক রাইডারদের অতিরিক্ত হেলমেট বহন করতে দেখা যায়। তবে প্রশ্ন উঠেছে, হেলমেটের মান নিয়ে। দুর্ঘটনা থেকে রক্ষা পেতে জীবন রক্ষার জন্য হেলমেট পরার বাধ্যবাধকতা থাকলেও তা দাঁড়িয়েছে ‘নিয়মরক্ষার’। আরোহীর মাথায় হেলমেট থাকে হাল্কা এবং নি¤œমানের। এ ধরনের হেলমেট ব্যবহারে উদ্দেশ্য সাধন তো হচ্ছেই না বরং ঝুঁকি থেকেই যাচ্ছে।
রোড সেফটি ফাউন্ডেশন বলছে, ঈদে মোটরসাইকেলে বাড়ি যাওয়ার সংখ্যা ব্যাপক হারে বেড়েছে। গত রোজার ঈদে যে যেভাবে পেরেছে বাইক চালিয়ে বাড়ি ফিরেছে। আর বেপরোয়াভাবে বাইক চালানোর কারণে দুর্ঘটনা বেড়েছিল। গত ঈদের আগে এবং পরের ১৫ দিনে সবচেয়ে বেশি ঘটেছে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা। ১৬৪টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় ১৪৫ জন নিহত হন। আহত হন ১১০ জন। মোট দুর্ঘটনার ৪৪ দশমিক শূন্য ৮ শতাংশ ছিল মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা। নিহত ব্যক্তিদের ৩৪ দশমিক ৮৫ শতাংশ ও আহত ব্যক্তিদের ১৩ দশমিক শূন্য ৩ শতাংশই মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার শিকার।
একটা সময় মোটরসাইকেল আরোহীরা হেলমেট ব্যবহার করতেন না। তবে ২০১৮ সালের সড়ক পরিবহন আইনের ‘কারাদ-’ ও ‘জরিমানা’ এড়াতে ২/৩ বছর ধরে পাল্টে গেছে সেই চিত্র। চালক ও আরোহীদের অধিকাংশই এখন হেলমেট পরছেন; কিন্তু হেলমেট পরার হার বাড়লেও কমেনি দুর্ঘটনায় মৃত্যু। নি¤œমানের হেলমেট ব্যবহারে যাত্রীদের সুরক্ষায় কতটুকু ভূমিকা রাখবে জানতে চাওয়া হলে একাধিক বাইক চালক জানান, এ হেলমেটগুলো নেয়ার একটা কারণ, কম দামে পাওয়া যায়। ভাল হেলমেট থাকলে চুরি হওয়ার আশঙ্কা থাকে বেশি। আবার অনেক যাত্রী আছে বড় হেলমেট পরতে চায় না। হাতে নিয়ে বসে থাকেন। এর কারণে অনেকেই মামলা খেয়েছে। আবার অনেকেই বলে বড় হেলমেট পরলে গরম লাগে। তাই হাল্কা হেলমেট ব্যবহারের প্রবণতা বেড়ে গেছে।
কিছুদিন আগেও রাস্তাঘাটে খুব বেশি মোটরসাইকেল দেখা যেত না। কিন্তু সাম্প্রতিককালে সড়কে হু হু করে মোটরসাইকেল বেড়ে গেছে। খোদ রাজধানী ঢাকার সড়কের দিকে তাকালে এমনটিই মনে হবে। তবে শুধু রাজধানী নয়, সারাদেশেই মোটরসাইকেল চালানো বেড়ে গেছে। সেই সঙ্গে দুর্ঘটনাও বাড়ছে। তার বাস্তব রূপ দেখা যায় গত রোজার ঈদে। গত ঈদে ঘরমুখী মানুষ দুই লাখ মোটরসাইকেলে চেপে বসে।
গত রোজার ঈদে মোটরসাইকেলে চেপে যারা ঈদ করতে বাড়ি গেছেন এবং ঈদ উদযাপন শেষ করে কর্মস্থলে ফিরেছেন তাদের মধ্যে অনেকে সড়ক দুর্ঘটনায় হতাহত হন। বিশ্বব্যাংক ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) দুর্ঘটনা গবেষণা কেন্দ্রের (এআরআই) সর্বশেষ গত ২০২১ সালের এক যৌথ গবেষণায় জানা গেছে, দেশের সড়কে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় মোট মৃত্যুর ৮৮ শতাংশই মারা যাচ্ছেন হেলমেট না পরার কারণে। আর হেলমেট পরিহিত অবস্থায় মারা যাচ্ছেন ১২ শতাংশ চালক-আরোহী।
যে হারে মোটরসাইকেল সড়কে নামছে এবং দুর্ঘটনায় মানুষ মারা যাচ্ছে, তাতে সরকারের দায়িত্বশীলদের সড়কে দুর্ঘটনারোধে আরও বেশি গুরুত্ব দেয়া জরুরী। একটি ভাল হেলমেট কমাতে পারে দুর্ঘটনায় হতাহতের আশঙ্কা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, যথাযথভাবে হেলমেট ব্যবহারে দুর্ঘটনা মৃত্যুঝুঁকি ৪০ শতাংশ কমে যায়। আর জখম থেকে সুরক্ষা পাওয়া যায় ৭০ শতাংশ। হেলমেটের মান যাচাইয়ে সরকারী সংস্থাগুলোর উদ্যোগ নিতে হবে। মানহীন অনিরাপদ হেলমেট ব্যবহারকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। বাজারে যাতে নি¤œমানের সস্তা হেলমেট বিক্রি না হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে।
লেখক : এ্যাডভোকেসি অফিসার, কমিউনিকেশন
রোড সেফটি প্রকল্প, ঢাকা আহ্ছানিয়া মিশন