বন্যার পানিতে ভাসছে
গ্রীষ্মের খরতাপে জনজীবন অতিষ্ঠ। আবার সিলেট, সুনামগঞ্জ, নেত্রকোনা ও উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন জেলা বন্যার পানিতে ভাসছে। পরিস্থিতির নির্মম পরিণতিতে সংশ্লিষ্টরা উদ্বিগ্ন, দিশেহারা। এদিকে স্বপ্নের পদ্মা সেতুর সুবর্ণ দ্বার উন্মোচন বিপন্ন পরিস্থিতির সোনালি অধ্যায়- স্বর্ণযুগই বলা চলে। তার মধ্যে হাতছানি দিচ্ছে ঈদ-উল-আজহার ধর্মীয় আহ্বান। মাঝখানে চলছে করোনা সংক্রমণের আশঙ্কিত চাপ।
তারপরেও চলমান জীবন থেমে থাকার কোন উপায় কিংবা সুযোগ নেই বলাই যায়। আর কোরবানির ঈদ মানেই শুধু গরু-ছাগল আল্লাহর নামে উৎসর্গ করা তা কিন্তু নয়। বরং ইবাদত বন্দেগির আরও একটি আধ্যাত্মিক মাত্রা যোগ হয়- পবিত্র কাবা শরীফের দর্শনে হজ পালন করাও। এ ছাড়া আছে মদিনায় হযরত মোহাম্মদ (সা.) এর রওজা মোবারক জিয়ারত করা। প্রতি বছর জিলহজ মাসের দশ তারিখে পুণ্যভূমি আরবে অনুষ্ঠিত হয় পবিত্র ঈদ-উল-আজহা।
২০২০ আর ২০২১ সালের এমন সব ভাবগাম্ভীর্যের অনুষ্ঠানমালায় হরেক রকম বিধিনিষেধ আরোপ করাও ছিল স্বাস্থ্যসম্মত উপায়ের নিয়ামক শক্তি। সামাজিক দূরত্ব থেকে আরম্ভ করে ব্যক্তিক বিচ্ছিন্নতায় মানুষের সঙ্গে মানুষের মিলনের যে ব্যবচ্ছেদ টানা হয়, সেখানে সব ধরনের উৎসব আয়োজনও স্তিমিত হয়ে পড়ে। তবে ২০২২ সালের শুভযাত্রা আমাদের অনেক স্বস্তি দিয়ে স্বাধীনতা দিবস, বঙ্গবন্ধুর জন্মবার্ষিকী পালনসহ পহেলা বৈশাখ উদ্যাপন ছাড়াও ঈদ-উল-ফিতরের মতো অনুষ্ঠানমালা নির্বিঘেœ সামলানোও ছিল এক আড়ম্বরপূর্ণ মহোৎসব।
কিন্তু জুন মাস থেকে আবারও ওমিক্রনের নতুন ভ্যারিয়েন্ট যেভাবে চোখ রাঙাচ্ছে, সেটা শেষ অবধি কোরবানির আনন্দযজ্ঞের মধ্যে যেন অস্বস্তির পরিবেশ তৈরি করে দিল। তার ওপর বন্যাকবলিত এলাকার অংশও একেবারে কম নয়। অতি বর্ষণ, ভারি বৃষ্টি এবং অকাল বন্যা সেই জ্যৈষ্ঠ মাস থেকেই সংশ্লিষ্ট অঞ্চলগুলোকে বিপর্যস্ত করে তোলে।
বারবার পরিবেশবাদী ও নিসর্গ বিশেষজ্ঞরা প্রযুক্তির নেতিবাচক প্রক্রিয়ায় প্রকৃতি রুষ্ট হওয়ার বিবর্ণ চিত্রের আশঙ্কা করেই যাচ্ছেন এই শতাব্দীর শুরু থেকেই। প্রকৃতির কোলে লালিত সন্তানরা যদি তাদের বাসযোগ্য বিশ্বকে সহনীয় অবস্থায় ফেরাতে ব্যর্থ হয়, তাহলে তার দাম চুকাতে হবে নিজেদেরকেই। যার নিতান্ত মূল্য পরিশোধ ইতোমধ্যে শুরু হয়ে গেছে।
কোরবানি ঈদের বিরাট আয়োজনের মধ্যে থাকে পশু ক্রয়-বিক্রয়। বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের পশু খামারিরা মৌসুমি এই উৎসবের জন্য সারাবছর তাদের ব্যবসা-বাণিজ্যকে গুছাতে থাকে। জানা যায়, দেশের চাহিদা অনুযায়ী পর্যাপ্ত গরু ছাগল এখন নিজেরাই সরবরাহ করতে সক্ষম। গবাদিপশু আমদানি করার তেমন প্রয়োজন পড়ে না।
কিন্তু এবারের পরিস্থিতি ভিন্ন। সিলেটের বিস্তীর্ণ অঞ্চল সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজারে গৃহপালিত গবাদিপশুর যে অন্তহীন দুর্ভোগ তা সামলানো কতখানি সম্ভব বলা মুশকিল। পশু খামারিদের কি পরিমাণ লোকসান গুনতে হবে তা ভেবে কূল পাওয়া যাচ্ছে না। সত্যিই এক অবিশ্বাস্য মহাসঙ্কট। দেশী গরুর চাহিদা সব সময় বেশিই থাকে।
ব্যবসা-বাণিজ্যের রমরমা অবস্থার বিপরীতে যেভাবে অসহনীয় বিপত্তি মাথাচাড়া দিচ্ছে, তাতে কোরবানির ঈদ যেন তার অবস্থানকে বিভিন্নভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলছে। তারপরও কোরবানি হবে না এমনটা বলার সুযোগ নেই। কিন্তু এবারে পশুর হাটে লাভ-লোকসানের পাল্লা কিভাবে নির্ধারিত হবে সেটাও আন্দাজ করা মুশকিল। বন্যায় মানুষের সুস্থ থাকাটাই যেন বড় চ্যালেঞ্জ।
পানিবাহিত রোগ-ব্যাধি ইতোমধ্যে আক্রান্ত এলাকায় প্রভাব বিস্তার করেই যাচ্ছে। জ্বর, সর্দি, ডায়েরিয়া, ঠাণ্ডা লাগা ইতোমধ্যে শুরু হয়ে গেছে। বাংলাদেশের সব স্থান বন্যাকবলিত নয়। তবে বন্যার প্রভাব অন্যান্য মুক্ত জায়গায় পড়ার ঝুঁকি থাকে প্রবলভাবে। ফলে, এবার ক্রেতাসাধারণের বিপত্তিতে পড়ার শঙ্কাই থাকছে বেশি। কারণ, ব্যবসায়ীরা যে কোনভাবে তাদের লভ্যাংশ উত্তোলন করতে পেছনের দিকে তাকায় না। সিন্ডিকেটের চক্রব্যূহ ভেদ করে বাজার ব্যবস্থাপনার স্বাচ্ছন্দ্য গতি কোনভাবেই দৃশ্যমান হয় না।
ইতোমধ্যে পেঁয়াজ, তেল, চালের দাম বেড়ে যাওয়ার চিত্র চরম অস্বস্তিকর। ভোক্তা শ্রেণীকেই সব কিছুর দাম দিতে হয়। টিসিবির পণ্য কিংবা ফ্যামিলি কার্ড সব হতদরিদ্রের মাঝে পৌঁছায় না পর্যন্ত।
সুতরাং দুর্ভোগের কবলে পড়ে অসহায় সিংহভাগ মানুষ- যারা দিনে এনে দিন খায় তাদের অবর্ণনীয় দুর্দশা আসলে সেভাবে কারোর টনক নড়ে না। মুনাফা আদায়ের চরম আসক্তিতে সাধারণ জনগণের দুর্ভোগ যেন ব্যবসায়ীদের নজরে আসে না। বিভিন্ন জায়গায় বন্যার কারণে পণ্য সরবরাহের যে অশনিসঙ্কেত শুরু হয়েছে সেটা সামলানোও অত্যন্ত কঠিন।
গণমানুষের অসহনীয় দুরবস্থা শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে থামবে বলা মুশকিল। আরও এক উপদ্রব জনগণকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। শিকড়ের টানে গ্রামে যাওয়ার অন্তহীন আকাক্সক্ষা। ইতোমধ্যে বাস-ট্রেনের অগ্রিম টিকেট বিক্রি শুরু হয়ে গেছে। তবে সুস্থ স্বাভাবিক পরিবেশের অনুপস্থিতি ভিন্ন মাত্রার সঙ্কট যা প্রতিবছরই গ্রামে যাওয়া মানুষদের অস্থির করে তোলে।
চাহিদা অনুযায়ী পর্যাপ্ত টিকেটের অবর্ণনীয় ঘাটতি। নতুন রেল সংযোগ করা থেকে বাড়তি বগি সম্পৃক্তও করতে হয় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে। বাসের সংখ্যা বাড়ানোর দৃশ্যও উঠে আসে। কিন্তু তা জনগণের তুলনায় এতই অপ্রতুল তাতে ঘাটতির পাল্লা ক্রমশ বাড়তেই থাকে। গণমাধ্যমে যা উঠে আসছে- তা হতচকিত হওয়ার মতো। যারা টিকেট হাতের কাছে পাচ্ছে তাদের যাত্রা ভোগান্তি কোন্ পর্যায়ে পৌঁছাবে ধারণা করা যাচ্ছে না।
বৃহত্তর সিলেটের বিস্তীর্ণ এলাকা, নেত্রকোনা ছাড়াও উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন জেলা যেভাবে বন্যায় প্লাবিত হয়েছে, সেখানে গ্রামে পৌঁছানো কতখানি সাধ্যের মধ্যে থাকবে তা অনুমান করা সত্যিই কঠিন। স্বপ্নের পদ্মা সেতুর শুভ উদ্বোধনে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল অবারিত যাত্রা পথের ভোগান্তি হয়ত সেভাবে পাবে না। তবে অসহনীয় যানজটের আশঙ্কা করা হচ্ছে এখন থেকেই।
টোল আদায়ের স্থানগুলো প্রযুক্তি বিশ্বে যত বেশি উন্মুক্ত ও সম্প্রসারিত হবে, সে মাত্রায় কমে আসবে যাত্রা-দুর্ভোগ। সেটা যানজট হোক কিংবা অন্যান্য দুর্ভোগই হোক। সুষম ব্যবস্থাপনায় অনেক জটিল কার্যক্রম সহনীয়ভাবে চালাতে হলে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের তীক্ষè নজরদারি এবং কঠোর তদারকি করাও একান্ত আবশ্যক।
বাংলাদেশ উন্নয়নের অবধারিত কর্মপ্রকল্পে সামনের দিকে ক্রমান্বয়ে এগিয়েই চলেছে। পাশাপাশি হরেক রকম বিপর্যয়ও মাথা চাড়া দিয়ে উঠতে সময় লাগছে না। অবকাঠামোর বহুমাত্রিক দৃষ্টিনন্দন অভিযোজনে দেশ উন্নত বিশ্বের কাতারে চলে যাচ্ছে। তার বিপরীত প্রতিক্রিয়ায় দুর্যোগের ঘনঘটা নিত্যনৈমিত্তিক বিষয় হয়ে সাধারণ মানুষকে বিড়ম্বনায়ও ফেলে দিচ্ছে।
অসহনীয় দুর্বিপাক থেকে বেরিয়ে আসতে না পারলে সমৃদ্ধির সুফল ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যেতে পারে। দায়টা শুধু সরকারের নয়। আপামর মানুষেরও। প্রত্যেক নাগরিককে নিজ নিজ জায়গা থেকে তার কর্তব্য সম্পাদন করাও এক প্রকার বিবেচকের কাজ। সংঘবদ্ধ প্রচেষ্টায় যে উন্নয়ন ধারাকে ত্বরান্বিত করা হয়- তার নেতিবাচক প্রভাব বিস্তারকেও সম্মিলিতভাবে প্রতিহত করাও পরিস্থিতির অপরিহার্য দাবি। সবাইকে এক সঙ্গে সমন্বিত উপায়ে হরেক রকম বাধা-বিঘ্নকে অতিক্রম করতে যা যা প্রয়োজন এই মুহূর্তে সেটাই করা একান্ত জরুরী।
বন্যাপ্লাবিত এলাকায় সরেজমিন তদারকি করে ত্রাণ সরবরাহ করাই শুধু নয়, অসংখ্যা গৃহহীন মানুষের পুনর্বাসনও আবশ্যক। নতুন করে করোনা সংক্রমণও ভাবিয়ে তোলার মতো। মনে হচ্ছে আমরা আবারও এক চরম ক্রান্তিকাল অতিক্রম করতে যাচ্ছি। তবে বিপরীত পরিস্থিতি সামলানোর দায়ও সংশ্লিষ্ট জনগোষ্ঠীর। সমুদ্র ও নদীত বাংলাদেশ পানির সঙ্গে ক্রমাগত লড়াই করে তাদের প্রতিদিনের জীবনযাত্রা পাড়ি দেয়- কখনও সহনীয় আবার অন্যভাবে অস্থিরতার দুঃসময়কে সামলানোর মধ্য দিয়ে।
এভাবে বিশ্বের সর্ববৃহৎ বদ্বীপ বাংলাদেশ আবহমান কাল থেকে প্রকৃতির সঙ্গে লড়াই করেছে, জয়ী হয়েছে, অনেক ঘাত-প্রতিঘাতের বিপন্ন সময় পার করেও নতুন বাংলাদেশ গড়ার অঙ্গীকারে উদ্দীপ্ত অহঙ্কারে এগিয়েও গেছে।
লেখক : সাংবাদিক