ঢাকা, বাংলাদেশ   সোমবার ০২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৮ অগ্রাহায়ণ ১৪৩১

কারসাজিতে বাড়ে দাম

গুটিকয়েক কোম্পানির হাতে এলপিজির নিয়ন্ত্রণ

স্বপ্না চক্রবর্তী

প্রকাশিত: ২২:৩৫, ৪ নভেম্বর ২০২৪

গুটিকয়েক কোম্পানির  হাতে এলপিজির  নিয়ন্ত্রণ

.

দীর্ঘদিন বন্ধ রয়েছে আবাসিক প্রাকৃতিক ভবনগুলোতে গ্যাসের সংযোগফলে বাধ্য হয়ে ভোক্তাদের ঝুঁকিতে হয়েছে তরলীকৃত প্রেট্রোলিয়াম গ্যাসের (এলপিজি) দিকেআর এর ফলে গুটিকয়েক বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েন ভোক্তারাবাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) নিয়মিত দাম নির্ধারণ করে দিলেও তার তোয়াক্কা না করে নিজেদের ইচ্ছামতো দামে বিক্রি করে চলেছে

জানা যায়, গ্যাস সংকটের কথা উল্লেখ করে ২০০৯ সালে তকালীন সরকার আবাসিক গ্যাস সংযোগ বন্ধ করে দেয়পরে ২০১৩ সালের শেষের দিকে আবাসিকে গ্যাস সংযোগ চালু করা হলেও ২০১৪ সালের পর জ্বালানি বিভাগ গ্যাস বিতরণ কোম্পানিগুলোকে আবাসিকের নতুন আবেদন নিতে নিষেধ করেএরপর ২০১৯ সালে লিখিতভাবে আবাসিক সংযোগ স্থগিত রাখার আদেশ জারি করা হয়বর্তমানে সারাদেশে বেক্সিমকোর পাশাপাশি বসুন্ধরা, ওমেরা, মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজ (ফ্রেশ), এস আলম গ্রুপ, জেএমআই গ্রুপ, সিটি গ্রুপের মতো শিল্প জায়ান্টসহ প্রায় ৩০টি অপারেটর এলপিজি ব্যবসা করছেএর বাইরেও ফ্রান্সের টোটালগ্যাজ, ডাচ পেট্রোম্যাক্স এবং হংকংয়ের কাই হেং লং গ্লোবাল এনার্জির মতো বিদেশী অপারেটরগুলোও বাজারে তাদের উপস্থিতি জানান দিয়েছেফলে গত এক দশকে দেশের এলপিজি বাজার উল্লেখযোগ্য হারে বড় হয়েছে

বাজার অপারেটররা জানান, ২০১৩ সালে এলপিজির চাহিদা ছিল ৮০ হাজার টন২০২৩ সালের শেষ নাগাদ এই চাহিদা ১৪ লাখ টন ছাড়িয়ে যায়অর্থা এক দশকের মধ্যে এলপিজির চাহিদা বেড়েছে ১৫ গুণআর এটারই সুবিধা নিয়েছে গুটিকয়েক কোম্পানিএর মধ্যে বেক্সিমকো, বসুন্ধরা, ওমেরা অন্যতম

বর্তমান এলপিজি অপারেটরগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি স্টোরেজ ক্ষমতা রয়েছে জেএমআই গ্রুপের- ১৪ হাজার টনস্টোরেজ সক্ষমতার দিক থেকে এরপরই আছে বিএমআই এনার্জি (১০ হাজার ৭০০ টন), ওমেরা (৯ হাজার ৬০০ টন) এবং বসুন্ধরা (৯ হাজার ৩০০ টন)

টানা তিন মাস ঊর্ধ্বমুখী এলপিজির বাজার এদিকে কোটা সংস্কার আন্দোলনের জেরে গত আগস্ট মাসে দেশ যখন উত্তাল তখন ১১ টাকা বাড়ানো হয়েছিল তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাসের (এলপিজি) দামতখন ১২ কেজির একটি সিলিন্ডারের দাম নির্ধারণ করা হয়েছিল ১ হাজার ৩৭৭ টাকাএরপর সেপ্টেম্বরে একলাফে বাড়ানো হয় ৪৪ টাকাসেপ্টেম্বর মাসের জন্য ১২ কেজির একেকটি এলপি গ্যাসের সিলিন্ডারের দাম নির্ধারণ করা হয় ১ হাজার ৪২১ টাকাএরই ধারাবাহিকতায় অক্টোবরেও বাড়ে দামসেপ্টেম্বর মাসের তুলনায় অক্টোবর মাসে ১২ কেজি সিলিন্ডার গ্যাসের দাম ৩৫ টাকা বাড়িয়ে ১ হাজার ৪৫৬ টাকা নির্ধারণ করে বিইআরসিযদিও আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সমন্বয়ের কথা বলা হচ্ছে দাম বাড়ানোর সময়কিন্তু সংশ্লিষ্ট অনেকেই দাবি করছেন, এলপিজির বাজারে অস্থিরতা নিয়ন্ত্রণে অনেকটা সময় লাগবেআর তাই চাইলেও কমানো যাবে না এলপিজির মূল্য

অস্থির বাজার ২০২১ সালের ১২ এপ্রিলের আগে পর্যন্ত এলপিজির দর ছিল কোম্পানিগুলোর ইচ্ছাধীনওইদিন বিইআরসি কর্তৃক দর ঘোষণার সময় বলা হয় আমদানিনির্ভর এই জ্বালানি সৌদি রাষ্ট্রীয় কোম্পানি আরামকো ঘোষিত দরকে ভিত্তি মূল্য ধরা হবেএর পর থেকে প্রতি মাসেই এলপিজির দর ঘোষণা করে আসছে বিইআরসিতবে বিইআরসির ঘোষিত দরে বাজারে পাওয়া যায় না বলে অভিযোগ রয়েছে ভোক্তাদেরতাদের অভিযোগ হচ্ছে, বাজারে নির্ধারিত মূল্যে পাওয়া যায় না এলপিজি সিলিন্ডারবিক্রেতারা ইচ্ছামতো দর আদায় করেনকমক্ষেত্রেই শাস্তির আওতায় আনা হয়েছে

অভিযোগ পাওয়া যায়, রাজধানীর প্রায় প্রতিটা এলাকার খুচরা থেকে পাইকারি এলপিজি সিলিন্ডার বিক্রেতারা সিলিন্ডার প্রতি অন্তত ২ থেকে আড়াইশ টাকা বাড়তি আদায় করেন ক্রেতাদের কাছ থেকে

দীর্ঘদিন ধরেই কৃত্রিম সংকট দেখিয়ে ব্যবসায়ীরা নির্ধারিত মূল্যের চাইতে অনেক বেশি দাম আদায় করে নিচ্ছে বাসাবাড়িতে রান্নার কাজে ব্যবহৃত এক একটি সিলিন্ডারেবিইআরসি নির্ধারিত মূল্যের তোয়াক্কা না করেই উপাদনকারী কোম্পানিসহ খুচরা পর্যায়ের বিক্রেতারা ভোক্তাদের জিম্মি করে আদায় করছেন এই অতিরিক্ত অর্থএকেকটা সিলিন্ডার প্রতি ৩শথেকে ৫শটাকা বাড়তি আদায় করা যেন এখন নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছেআর এর জন্য উপাদনকারী প্রতিষ্ঠান এবং খুচরা বিক্রেতারা দায়ী করছেন একে অপরকেগত ফেব্রুয়ারিতে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণের এক জরিপে বলা হয়, এক সিলিন্ডার এলপি গ্যাস কিনতেই ভোক্তাদের মাসে অন্তত ২১৫ কোটি টাকা গচ্চা দিতে হচ্ছেসমন্বিতভাবে এই অর্থ লোপাটে নেতৃত্ব দিচ্ছে উপাদনকারী মিল, ডিলার এমনকি খুচরা বিক্রেতারাযার খেসারত দিতে হচ্ছে সাধারণ গ্রাহকদের

এমন পরিস্থিতিতে বিব্রত খোদ বিইআরসির চেয়ারম্যান জালাল আহমেদজনকণ্ঠকে তিনি বলেন, আমরা দর ঘোষণা করে দেইআমদানিকারকদের সঙ্গে বসেই দর চূড়ান্ত করিব্যবসায়ীদের অবশ্যই নতুন দাম মেনে চলবেএক্ষেত্রে বড় ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলোচনা করে একটা সিদ্ধান্ত নেয়া হবেবিশেষ করে খুচরা বিক্রেতাদের যাতে করে লাইসেন্সের আওতায় নিয়ে আসা যায় সেই ব্যবস্থা করতে হবেনইলে বাজার তদারকি করা মুশকিলআমরা তো মাত্র কয়দিন হলো দায়িত্ব নিয়েছিএ বিষয়ে আশা করি খুব দ্রুত কাজ শুরু করতে পারবএক্ষেত্রে বাজার নজরদারির কোনো ব্যবস্থা করা হবে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, এলপিজির বাজার তো অনেক বড়সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে

আবাসিকে পুনঃপ্রাকৃতিক গ্যাস সংযোগের গুজব এদিকে সম্প্রতি সরকারের একটি অনির্দিষ্ট কোনো সূত্রের বরাত দিয়ে কয়েকটি গণমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয়েছে যে, আবারও আবাসিকে প্রাকৃতিক গ্যাসের সংযোগ দিতে যাচ্ছে সরকারযা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন বলে জানিয়েছে গ্যাস সরবরাহকারী সংস্থা তিতাসবৃহস্পতিবার গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে তিতাস জানায়, সরকারি সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বাসাবাড়িতে নতুন গ্যাস সংযোগ এবং লোড বৃদ্ধির সংযোগ বন্ধ রয়েছেসম্প্রতি কিছু গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নতুন সংযোগ দেওয়ার বিষয়ে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছেতা সম্পূর্ণ গুজব ও ভিত্তিহীনএতে আরও বলা হয়, কিছু প্রতারক চক্র জনগণকে বিভ্রান্ত করছেতা থেকে সংশ্লিষ্ট সকলকে সতর্ক থাকার পরামর্শ দেওয়া হয়তা ছাড়া প্রয়োজনে গ্যাস বিতরণ কোম্পানির সঙ্গে যোগাযোগ করার জন্য অনুরোধও করা হয় বিজ্ঞপ্তিতে

×