ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

দৃষ্টিহীনের উচ্চ শিক্ষা জান্নাত হীরার গল্প  

সমুদ্র হক 

প্রকাশিত: ০২:২০, ৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৩; আপডেট: ০২:২২, ৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৩

দৃষ্টিহীনের উচ্চ শিক্ষা জান্নাত হীরার গল্প  

জান্নাত হীরার গল্প  

প্রবল ইচ্ছাশক্তি অদম্য সাহস একজন নারীকে কত উঁচুতে নিয়ে যেতে পারে তার প্রমাণ দেখাতে পেরেছেন বগুড়ার দৃষ্টি প্রতিবন্ধী মিফতাহুল জান্নাত হীরা। জন্মান্ধ হীরা মনের আলোর শক্তিতে তিনি প্রথমে দেখেছেন মা। তারপর প্রকৃতি। এ ভাবেই বিশ^ জয়ের পথে পা বাড়িয়েছেন। তিনি জাহাঙ্গীরনগর বিশ^বিদ্যালয় থেকে সরকার ও রাজনীতি বিষয়ে ¯œতক (সম্মান) পাস করেছেন ২০১৮ সালে। বর্তমানে ¯œাতকোত্তরে অধ্যয়নরত।

এর মধ্যেই গত বছর (২০২২) জুন মাসে সরকারি প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় অংশ নিয়ে কৃতকার্য হয়েছেন। প্রকাশিত ফলাফলে তার অবস্থান ৩৬। তিনি সহকারী শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন বগুড়ার শিবগঞ্জ উপজেলার বিহার কলেজপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। এ বছর জানুয়ারির শেষ সপ্তাহে স্কুলে যোগদান করার পর  হীরা বললেনÑ শিক্ষার্থীদের আলোকিত পথে এগিয়ে নেবেন। প্রমাণ করবেন দৃষ্টি প্রতিবন্ধী ভালো শিক্ষক হতে পারে। তিনি আশা করছেন বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস (বিসিএস) পরীক্ষায় অংশ নেবেন। তবে এই পথ যে তার জন্য কুসুমাস্তীর্ণ নয় তাও তিনি জানেন। বিসিএস পরীক্ষায় প্রতিবন্ধীদের জন্য এক শতাংশ কোটা ছিল তাও বাতিল হয়েছে। তারপরও চেষ্টা করবেন।

মিফতাহুল জান্নাত হীরার বয়স ২৪। বগুড়ার শিবগঞ্জের বিহার পশ্চিমপাড়া গ্রামের গৃহবধূ নুরজাহান বেগম ও গৃহস্থ আব্দুস সাত্তার দম্পতির চার ছেলে পাঁচ মেয়ের মধ্যে সে ছোট। তার আরও দুই বোন দৃষ্টি প্রতিবন্ধী। তাদের একজন লাভলি ¯œাতক পাস করেছে। সে একটি প্রতিষ্ঠানের ব্রেইলি বই লিখে দেয়। জান্নাত  হীরা যখন ছোট তখন তাকে ভর্তি করানো হয় গাজীপুরে। সেখানে ব্রেইলি পদ্ধতিতে একাডেমিক শিক্ষা জীবন শুরু করেন। মাধ্যমিকে তিনি ক্লাসের শিক্ষকের লেকচার রেকর্ডিং শুনে পাঠগ্রহণ করেন। তাকে সহযোগিতা করেন স্কুলের শিক্ষক ও সহপাঠী।

প্রতিটি পরীক্ষায় শ্রুতি লেখক নিয়ে পরীক্ষা দেন। গাজীপুর সালনা নাসির উদ্দিন মেমোরিয়াল হাই স্কুল থেকে ২০১২ সালে মাধ্যমিক পাস করার পর বগুড়া সরকারি মজিবর রহমান মহিলা কলেজে উচ্চ মাধ্যমিকে ভর্তি হন। ২০১৪ সালে জিপিএ-৫ পেয়ে উচ্চ মাধ্যমিক অতিক্রম করেন। এরপর জাহাঙ্গীরনগর বিশ^বিদ্যালয়ে সরকার ও রাজনীতি (পলিটিক্যাল সায়েন্স) বিভাগে সম্মানে ভর্তি হন। ২০১৮ সালে সাফল্যের সঙ্গে ¯œাতক পাস করেন। বর্তমানে ¯œাতকোত্তরে অধ্যয়নরত।  
¯œাতকোত্তরে ভর্তির আগে উচ্চ শিক্ষায় দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের ব্রেইল পদ্ধতির একটি প্রকল্পে কাজ করেন। ন্যাশনাল কারিকুলাম অব টেক্সট বুকের (এনসিটিবি) আওতায় একটি প্রকল্প সম্মিলন ফাউন্ডেশনে তিনি সম্পাদনা বিভাগের দায়িত্ব পান। ওই প্রকল্পে ইউনিকোডে বিশেষ ধরনের সফটওয়্যারে ব্রেইলি ডেভেলপমেন্টের কাজ চলে। হীরা জানান ইউনিকোডের এই ব্রেইলে সফলতা এলে দেশের অনেক দৃষ্টি প্রতিবন্ধী সহজে উচ শিক্ষা গ্রহণ করতে পারবে।
হীরা তার জীবনের এগিয়ে চলার পথে যে বাধাগুলো অতিক্রম করেছেন তা বলেন। পাবলিক পরীক্ষায় শ্রুতি লেখকের নীতিমালায় দৃষ্টি প্রতিবন্ধীকেই ঠিক করতে হয় কাকে তিনি নেবেন। অনেক সময় দেখা যায় শ্রুতি লেখক তার চেয়ে নিচের ক্লাসের। তখন উত্তর লেখায় শ্রুতি লেখক অনেক কিছু বুঝতে পারে না। কালক্ষেপণে অনেক উত্তর বাদ পড়ে যায়। হীরা বলেন তারপরও তিনি অনেক ভালো শ্রুতি লেখক পেয়েছেন। প্রতিটি পরীক্ষায় একেকজন শ্রুতি লেখক আসেন। তিনি মনে করেন উচ্চতর শ্রেণিতে অধ্যয়নরত  দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের জন্য শ্রুতি লেখকের নীতিমালায় প্রযুক্তি নির্ভর ও সময়োপযোগী হওয়া দরকার। হীরা ২০২১ সালে  জাতীয় পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ জয়িতা পুরস্কার পেয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাকে পুরস্কৃত করেন।   
হীরা বলেন তার প্রবল ইচ্ছা বিসিএস পরীক্ষা দেওয়ার। বললেন এতটা পথ যখন এসেছেন আরও পথ অতিক্রম করার ইচ্ছাশক্তি তার আছে। বিশেষ চাহিদা সম্পন্নদের জন্য বিসিএসে প্রবেশ খুবই কষ্টের। সেখানে অনেক বাধা। তিনি মনে করেন মেধাবী দৃষ্টি প্রতিবন্ধীরা সুযোগ পেলে এসব বাধা অতিক্রম করে দেশ গঠনে বড় ভূমিকা রাখার প্রমাণ দিতে পারবে। বগুড়া সমাজসেবা অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক এ এস এম কাওসার রহমান বলেন দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের সিক্সথ সেন্স অনেক বেশি। বগুড়ার সরকারি প্রতিষ্ঠানে তিনিই প্রথম দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিক্ষক। বিহার কলেজপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক আজমল হোসেন বলেন তারা গর্বিত একজন নারী দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ করে এই স্কুলে যোগদান করতে পেরেছেন। জেলার সহকারী প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার জাবেদ আহমেদ বলেন সরকার বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন নারীদের এগিয়ে যাওয়ার পথ সৃষ্টি করেছে। হীরা তাদেরই একজন। যিনি দৃষ্টি প্রতিবন্ধী হয়ে মনের আলোয় আগামী প্রজন্মকে আলোকিত করে তুলবেন। 

×