ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

কমছে প্রকল্প গ্রহণ ও খরচ

পরিকল্পনায় কৃচ্ছ

জনকণ্ঠ রিপোর্ট

প্রকাশিত: ২৩:১৬, ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২২

পরিকল্পনায় কৃচ্ছ

.

 ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধে বিশ্ববাজারের অস্থিরতা ও সব ধরনের পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব পড়েছে স্থানীয় বাজারে। জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি ও ডলারের বিপরীতে টাকার অব্যাহত দরপতনের মধ্যে সরকার কৃচ্ছ্র সাধনের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। যার প্রভাব পড়েছে সকল উন্নয়ন প্রকল্প অনুমোদনের কেন্দ্র পরিকল্পনা কমিশনে। ফলে নতুন প্রকল্প গ্রহণ থেকে চলমান কাজেরও গতি কমেছে অনেক ক্ষেত্রে। সরকারের পক্ষ থেকে বিষয়টিকে ব্যয় হ্রাসে ‘সফল পদক্ষেপ’ হিসেবে দেখা হচ্ছে।
পরিকল্পনা কমিশনের কৃষি বিভাগের কর্মকর্তা হিসেবে কাজ করছেন খোরশেদ আলম। ১৭ বছরের কাজের অভিজ্ঞতায় আগে কখনও প্রকল্প নিয়ে এত কম কাজ দেখেননি। প্রকল্পে অর্থছাড় ও বরাদ্দও কমেছে বলে মনে করেন এ কর্মকর্তা। শিল্প ও শক্তি বিভাগের আরেক কর্মকর্তা রাসেল হাওলাদারের কথায়ও একই সুর। ২০১৪ সাল থেকে কাজ করলেও আগে কখনও প্রকল্পের সংখ্যা-ফাইলের গতি এমন কমে আসেনি বলে জানান তিনি।
শুধু কর্মকর্তারা নন, পরিকল্পনা কমিশনের সচিবের সঙ্গে কথা বলেও একই তথ্য মিলেছে। কমিশনের সচিব মোঃ মামুন আল-রশীদ বলেন, সরকারের সিদ্ধান্তের আলোকেই খুব প্রয়োজনীয় প্রকল্প না হলে এ মুহূর্তে তা অনুমোদন দেয়া হচ্ছে না। যেসব প্রকল্প আসছে সেগুলোও খুব ভালভাবে দেখা হচ্ছে। এমনকি প্রশিক্ষণসহ পরামর্শক ব্যয় হ্রাস করে দেয়া হচ্ছে। আগে একনেকে ১০টির মতো প্রকল্প এলেও তা এখন কমে এসেছে বলেও জানান পরিকল্পনা কমিশনের এ সর্বোচ্চ আমলা। তাছাড়া কমিশনের একনেক সূত্র জানিয়েছে, পাইপলাইনেও প্রকল্পের সংখ্যা কমে এসেছে। আগে ৩০টির বেশি প্রকল্প প্রক্রিয়াধীন থাকলেও এখন ৫/৬টি প্রকল্প রয়েছে পাইপলাইনে।
সরকারের কৃচ্ছ্র সাধনের বিষয়ে পরিকল্পনামন্ত্রী বলেন, আপদকালীন সময়ে আমরা ব্যয়ের রাশ টেনে ধরতে সক্ষম হয়েছি। সবক্ষেত্রে মিতব্যয়ী হওয়ার বার্তা আমরা সব জায়গায় পৌঁছে দিতে পেরেছি। এ কারণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পরিকল্পনা কমিশনের কর্মকর্তাসহ সবাইকে ধন্যবাদ দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর ত্বরিত সিদ্ধান্তের কারণে কৃচ্ছ্রের মাধ্যমে অর্থনীতিকে খাদের কিনারা থেকে টেনে তুলতে পেরেছেন বলেও মনে করেন সরকারের এ নীতিনির্ধারক।
আগের চেয়ে ভাল করে প্রকল্পগুলো বিচার-বিশ্লেষণ করা হচ্ছে বলেও জানান মন্ত্রী। তবে ব্যয় হ্রাসের কারণে কত টাকা সাশ্রয় করা সম্ভব হয়েছে সে বিষয়ে নির্দিষ্ট কোন সংখ্যা বা পরিসংখ্যান প্রস্তুত করা হয়নি বলে জানান।
সরকারের ব্যয় হ্রাস ॥ গত ২ আগস্ট ডলার সাশ্রয়ের জন্য ফাইভ-জি প্রযুক্তি চালুর প্রকল্পটি ফিরিয়ে দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী। ২৩৬ কোটি টাকার প্রকল্পটির জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতির প্রায় ৮০ শতাংশ বিদেশ থেকে আমদানি করতে হতো। শুধু নতুন প্রকল্প গ্রহণের ক্ষেত্রে নয়, বরং চলমান প্রকল্পের ক্ষেত্রেও সরকার ব্যয় হ্রাসের পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে।
চলমান বার্ষিক উন্নয়ন পরিকল্পনায় এক হাজার ৩৭২টি প্রকল্প রয়েছে। এসব প্রকল্পগুলোকে এ,বি,সি- এই তিনটি ক্যাটাগরিতে বিভক্ত করেছে সরকার। যার মধ্যে ‘এ’ ক্যাটাগরিতে থাকা ৬৪৬ প্রকল্পে বরাদ্দ করা অর্থ আগের মতোই ব্যয় হবে। তবে ‘বি’ ক্যাটাগরিতে থাকা ৬৩৬ প্রকল্পের বরাদ্দের ৭৫ শতাংশ অর্থ ব্যয় করা হবে। অর্থাৎ প্রকল্পের গতি কমিয়ে আনা হয়েছে। ‘সি’ ক্যাটাগরিতে থাকা ৮১টি প্রকল্পের কাজ সম্পূর্ণ স্থগিত করা হয়েছে। ফলে কৃচ্ছ্রের এ সিদ্ধান্তে সাত শতাধিক প্রকল্পের কাজে বরাদ্দ ও গতি কমিয়ে আনা হয়েছে।
প্রকল্পের ক্যাটাগরি ॥ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে প্রকল্পগুলোর ক্যাটাগরি করে দিয়েছে। পরিকল্পনা কমিশন সূত্রমতে, ‘সি’ ক্যাটাগরির প্রকল্পগুলোর মধ্যে রয়েছে- প্রাথমিক বিদ্যালয়ে স্কাউট সম্প্রসারণ, ১৬টি আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিস নির্মাণের প্রকল্প, নরসিংদী জেলা কারাগার নির্মাণের, পুলিশ অফিসারদের আবাসনের প্রকল্প ইত্যাদি। তাছাড়া পুলিশের ৯টি আবাসিক ভবন ও মেট্রোপলিটন এলাকায় আরও ৯টি ভবন নির্মাণের প্রকল্পও ‘সি’ ক্যাটাগরিতে রাখা হয়েছে। শরীয়তপুরে নদীর তীররক্ষা ও ড্রেজিং প্রকল্প, চট্টগামের পটিয়ায় বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও সেচ প্রকল্প। ‘বি’ ক্যাটাগরিতে রয়েছে- জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের ৩২টি প্রকল্প। কিছুটা কম গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পগুলো ‘এ’ তালিকায় রাখা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে গ্যাস কূপ খননের কয়েকটি পরিকল্পনা, বেনাপোল স্থলবন্দরে কার্গো টার্মিনাল নির্মাণ, মোংলা বন্দরের জন্য জলযান ক্রয়, কুষ্টিয়া মেডিক্যাল কলেজ স্থাপন ইত্যাদি।
অন্যদিকে ‘এ’ ক্যাটাগরিতে থাকা প্রকল্পগুলোতে পুরোদমে কাজ চলবে। এর মধ্যে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের ৩৯টি প্রকল্পের মধ্যে ৩৩টি প্রকল্পকে অগ্রাধিকার দেয়া হয়েছে। পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগের ৭৬টি প্রকল্পের মধ্যে ৫৮টি প্রকল্পকেই ‘এ’ ক্যাটাগরিতে রাখা হয়েছে। অগ্রাধিকার তালিকাভুক্ত হয়েছে- রংপুর সিটির জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্প, রাজশাহী ওয়াসার পানি শোধানাগার ও সিলেট সিটির অবকাঠামো প্রকল্প।
কমছে নতুন প্রকল্প ॥ এডিপি তালিকায় থাকা প্রকল্পের ক্ষেত্রে ক্যাটাগরি করে বরাদ্দ হ্রাস করা হলেও আসন্ন নতুন প্রকল্পের কোন তালিকা করা হয়নি। তবে পরিকল্পনা কমিশনে এখন একদম জনগুরুত্বপূর্ণ কোন বিষয় না হলে প্রকল্প অনুমোদন দেয়া হচ্ছে না। আর সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে কৃচ্ছ্র সাধনের বার্তা আসায় মন্ত্রণালয়গুলোও হিসাব করেই প্রকল্প পাঠাচ্ছে কমিশনে। আর যেসব প্রকল্প কমিশনে আসছে সেগুলোও খুব চুলচেরা বিশ্লেষণের মুখে পড়ছে। সর্বশেষ একনেক সভায় ৬টি প্রকল্প অনুমোদন দেয়া হলেও নতুন প্রকল্প ছিল মাত্র ৩টি। এর আগের একনেকেও ৬টির মধ্যে ৩টি ছিল নতুন প্রকল্প। তাছাড়া কয়েকটি প্রকল্প কমিশনে অপেক্ষমাণ রাখা হয়েছে। এর মধ্যে দেশের সকল পৌরসভায় ডিজিটালাইজেশনের একটি প্রকল্প আরও বিশ্লেষণের জন্য অপেক্ষমাণ রাখা  হয়েছে। ৪ হাজার ২৯ কোটি টাকার প্রকল্প প্রস্তাব করেছে স্থানীয় সরকার বিভাগ। একই বিভাগের আরও একটি প্রকল্প অনুমোদনের জন্য অপেক্ষমাণ রয়েছে। কক্সবাজার জেলার ঈদগাঁও উপজেলায় পানি সরবরাহ ও স্যানিটেশনের একটি প্রকল্প প্রস্তাব ঘুরছে কমিশনে। ২ হাজার ৪৭০ কোটি টাকা ব্যয় ধরা হয়েছে প্রকল্পটির। কমিশন সূত্র বলছে, পাইপলাইনে প্রকল্পে সংখ্যা আগের চেয়ে অনেকটা কমে গেছে। নতুন প্রকল্পের তালিকা না থাকলেও খুব বিশ্লেষণ করে সিদ্ধান্ত নেয়া হচ্ছে বলে জানায় সূত্রটি।
বিরতি দিয়ে একনেক ॥ প্রতি সপ্তাহের মঙ্গলবার একনেক সভা হওয়ার রেওয়াজ থাকলেও প্রকল্পের সংখ্যা কমতে থাকায় কমেছে একনেক সভার সংখ্যাও।

অর্থনৈতিক চাপের মধ্যে সরকারের কৃচ্ছ্রের সিদ্ধান্তের ফলে প্রতি ২ সপ্তাহে একবার একনেক সভা হচ্ছে। তবে চলতি অর্থবছরের তৃতীয় ও সর্বশেষ তথা চতুর্থ একনেক সভার মধ্যে ফারাক রয়েছে প্রায় এক মাস। গত আগস্ট মাসের ১৬ তারিখ তৃতীয় একনেক হলেও শেষ একনেক হয়েছে এ মাসের ১৩ তারিখ। যেখানে দ্বিতীয় একনেক হয়েছিল তৃতীয় একনেকের দুই সপ্তাহ আগে। আর শেষ একনেক সভাটি শেষ হয়ে গিয়েছিল দেড় ঘণ্টার আগেই। যেটিকে সবচেয়ে ছোট একনেক সভা বলছেন খোদ পরিকল্পনামন্ত্রী। তবে এ বিষয়ে মন্ত্রীর ব্যাখ্যা হলো- নতুন প্রকল্প কম থাকায় কম সময়ে হয়ে গেছে। আমরা তাড়াহুড়ো করে শেষ করে দিচ্ছি বিষয়টা এমন না, বলেন তিনি। এদিকে একনেক সমন্বয় উইং সূত্র জানিয়েছে, পাইপলাইনে প্রকল্পের সংখ্যা অনেক কম। ফলে সামনের একনেক সভা হতেও আরও এক মাস সময় লাগতে পারে।
উল্লেখ্য, সরকারের নিয়ন্ত্রণমূলক নানামুখী তৎপরতার ফলে আমদানি ব্যয়ে লাগাম পড়েছে। নতুন করে এলসি খোলার প্রবণতা কমায় ডলার সাশ্রয় হয়েছে। ফলে ইতোমধ্যে টাকার মূল্য অবনমনের ধারা কমে এসেছে। আগামী কয়েক মাসের মধ্যেই অর্থনীতি স্থিতিশীল হবে বলেও প্রত্যাশার কথা  জানিয়েছেন পরিকল্পনামন্ত্রী।

×