ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

অপতৎপরতা রোধে পোল্ট্রি বোর্ড গঠনের দাবি

ডিমের দাম বাড়ার পিছনে সিন্ডিকেটের কারসাজি

বিকাশ দত্ত

প্রকাশিত: ২১:৫৮, ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২২; আপডেট: ২২:০৬, ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২২

ডিমের দাম বাড়ার পিছনে সিন্ডিকেটের কারসাজি

ডিম

শ্রমিকের মজুরি বৃদ্ধি, বিদ্যুৎ সংকট, চাহিদার চেয়ে উৎপাদন কম ও খামারে ঠিক মত চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে না পারায় ডিমের দাম বেড়েইে চলছে। ফলে পোল্ট্রি শিল্পের সঙ্গে জড়িত খামারীরা উৎপাদনের ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে পারছেন না। 

অনেক ছোট ফার্ম বন্ধ হয়ে গেছে। বেশী বিপাকে পড়েছেন ঋণগ্রস্থরা। লোকসানের কারণে এখন তাদের চোখে মুখে দুঃশ্চিন্তার ছাপ। মধ্যস্বত্বভোগীদের কারসাজীর কারনে ডিমের দাম বৃদ্ধি পাচ্ছে। 

গত দুই মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ ডিমের দাম ডজন প্রতি ১৫৫ টাকায় উঠেছে। অন্যান্য নিত্যপণ্যের দাম নিয়ে যখন বাজারে অস্থিরতা চলছে ঠিক তখনই অস্বাভাবিক বেড়েছে ডিমের দাম। 

২০০৬ সালে এক ডজন ডিমের দাম ছিল ৩৬ টাকা। ১৬ বছরে সেই ডিমের দাম বেড়ে এখন ডজন প্রতি ১৫৫ টাকা। অভিযোগ রয়েছে কিছু বড় ফার্মের কারসাজিতে এই দাম বাড়ছে। ডিমের হাত বদলের কারনে খামারীরা বঞ্চিত হচ্ছেন।
 
খামারীরা জানিয়েছেন, তিন হাজার লেয়ার মুরগীর জন্য ৩০ লাখ টাকা বিনিয়োগ করতে হয়। এর কারনে ছোট ছোট খামার বন্ধ হয়ে গেছে। এ ছাড়া কোভিড-১৯ মহামারির পর থেকে টানা লোকসানে ব্যবসা টানতে ব্যর্থ হয়ে ৪০ শতাংশের ও বেশি খামারি উৎপাদন বন্ধ করে দিয়েছেন। 

এত কিছুর পরেও এক দশকে ডিমের উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে ৩ দশমিক ৪ গুন। প্রতিদিন ৬ কোটি ডিম উৎপাদন হয়। সাড়ে ৪ কোটি আসে ফার্ম থেকে। আর দেড়কোট আসে দেশী হাঁসমুরগী থেকে। উৎপাদনের চেয়ে ভোক্তার সংখ্যা বেশী। 

গাজীপুর জেলার কয়েকটি উপজেলার বাজার ঘুরে দেখা গেছে, দুই সপ্তাহ আগেও ডিমের হালি ছিল ৩০-৩৫ টাকা তা এখন বিক্রি হচ্ছে ৫১-৫২ টাকায়। প্রতি ডজন ডিমে দাম বেড়েছে ৪০-৪৫ টাকা। মুরগির ডিমের পাশাপাশি বেড়েছে হাঁসের ডিমের দামও। ডিমের এই অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির কারণ হিসেবে বিক্রেতারা বলছেন, জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির কারণে পরিবহণ খরচ বৃদ্ধি এবং অনেক খামার বন্ধ হয়ে মুরগি ও ডিমের উৎপাদন কমে গেছে। 

তাই প্রতিদিনের ক্রেতা চাহিদার চেয়ে ডিমের সরবরাহ কম হওয়ায় দাম বাড়ছে। ভবিষ্যতে ডিম ও মুরগির দাম আরও বাড়বে বলেও আশঙ্কা করছেন ব্যবসায়ীরা। তবে দাম বাড়ার পরও বিক্রি তেমন কমেনি, বরং বেড়েছে। 

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে দেশে ভুট্টা আমদানি কমে দাম প্রায় দ্বিগুণ হওয়া ও সয়াবিনের (সয়াবিনের খইল) দাম বেড়ে গেছে। এতে ডিমের দাম বেশি হচ্ছে। তারপরও এখানের উৎপাদিত ডিম গাজীপুর জেলার চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি সারা দেশে বিক্রি হচ্ছে। বৈশ্বিক সংকট কাটলে ডিমের দাম কমে আসবে।

খামারীরা জানান, আগে একটি ডিম উৎপাদনে খরচ হত ৫ টাকা ৭০ পয়সা। বর্তমানে একটি ডিম উৎপাদনে খরচ হচ্ছে ৮ টাকা ৭০ পয়সা থেকে ৯টাকা ৬১ পয়সা। খামারীরা পাইকারি পর্যায়ে ডিম বিক্রি করছেন ১০ টাকা ৭০ পয়সা। 

ভোক্তরা ডিম কিনছেন প্রতিপিস ১২ থেকে ১৩ টাকায়। প্রাণিসম্পদ অধিদফতর সূত্রে জানা যায়, সারাদেশে পোল্ট্রি খামারের সংখ্যা দুই লাখ পাঁচ হাজার ২৩১টি। এর মধ্যে নিবন্ধিত পোল্ট্রি খামারের সংখ্যা ৮৬ হাজার ৫৪১টি ও অনিবন্ধিত খামারের সংখ্যা এক লাখ ২০ হাজার চারটি। 

বর্তমানে দেশে মোট জিডিপির ১ থেকে ৩০ শতাংশ আসছে পোল্ট্রি শিল্প থেকে। তাই পোশাকশিল্পের পরই সম্ভাবনাময় খাত হিসেবে পোল্ট্রি শিল্প এরই মধ্যে একটি স্বতন্ত্র অবস্থান তৈরি করে নিতে সক্ষম হয়েছে।

সরেজমিনে গাজীপুর, কাপাসিয়া ও সাভারের কয়েকটি ফার্ম পরিদর্শন করে দেখা গেছে, হাতে গোনা দুই একটি ফার্ম ছাড়া ছোট ছোট খামারীরা নানা সমস্যার মধ্যে রয়েছেন। বড় ফার্মগুলো তাদের সমস্যার কথা প্রকাশ করতে চায় নি। 

সেখানকার ছোটখামারীরা বলেছেন, খাবারের দাম বেশী, বিদ্যুৎ বিল বেশী মেডিসিনের দাম বেশী। এ কারণে আমরা এখন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি। 

এ প্রসঙ্গে রাষ্ট্রপতি পদক প্রাপ্ত খামারী মীর মো: আমিনুজ্জামান জনকন্ঠকে বলেন, চাহিদার চেয়ে যোগান কম। পাশাপাশি খাদ্যের মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে। গত দুই মাসে যে দাম বেড়েছে তা আর কমেনি। খাদ্যের বেশী মুল্যের কারনে অনেক ছোট খামারী বন্ধ হয়ে গেছে। 

মধ্যস্বত্বভোগীরা সব সময় আমাদের সঙ্গে টর্চারী করে আসছে। আমরা কোন অঞ্চলকে নিয়ন্ত্রন করতে পারি না। কাচামাল ব্যাবসায় আমাদের লোকসান হয়। কিন্তু ওদের লোকসান হয় না। সমস্ত ফিডমিলগুলোতে প্রসাশনের নজর দাবী করা দরকার। কারন ওরা দাম বাড়িয়ে যাচ্ছে। 

এ বিষয়ে মৎস্য ও পশু সম্পদ মন্ত্রী শ.ম রেজাউল করিম জনকন্ঠকে বলেন , প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকারের নানা উদ্যোগ ও পৃষ্ঠপোষকতায় বাংলাদেশ ডিম উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে। ২০০৮-০৯ অর্থবছরে ডিমের উৎপাদন ছিল ৪৬৯ দশমিক ৬১ কোটি, যা ২০২০-২১ অর্থবছরে বেড়ে ২ হাজার ৫৭ দশমিক ৬৪ কোটিতে উন্নীত হয়ছে। 

বিগত এক যুগে প্রাণিজ আমিষের অন্যতম প্রধান উৎস ডিমের উৎপাদন ৩ গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। পোলট্রি সেক্টরের উৎপাদন ও সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে সরকার সবসময় সচেষ্ট রয়েছে। প্রাণিজ শিল্পের উৎপাদন ব্যয় কমানো এবং ভোক্তাদের স্বল্প মূল্যে আমিষের সরবরাহ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে চলতি অর্থবছরে দেশীয় পোল্ট্রি খাদ্য প্রস্তুতে ব্যবহৃত নির্দিষ্ট উপাদানের আমদানি শুল্ক কমানো হয়েছে। 

পোল্ট্রি খাদ্য যাতে বিদেশ থেকে আমদানি করতে না হয় সেজন্য পোল্ট্রি খাদ্য দেশে উৎপাদনে বেসরকারি খাতকে এগিয়ে আসার জন্য সরকার নানাভাবে উৎসাহিত করছে। এ জন্য সংশ্লিষ্টদের কর অব্যাহতি সুবিধাসহ অন্যান্য আর্থিক সুবিধা সরকার দেবে। পোল্ট্রি খাদ্য দেশে তৈরি হলে ডিমের উৎপাদন ব্যয় আরও কমে যাবে। ফলে স্বাভাবিকভাবে দামও কমে আসবে। অপরদিকে উৎপাদনকারী খামারি ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তির পর যাতে ডিমের মূল্য ভোক্তা পর্যায়ে অস্বাভাবিকভাবে না বাড়ে সেজন্য ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরসহ সরকারের অন্যান্য সংস্থা কাজ করছে। ডিমের দাম সহনীয় রাখতে সংশ্লিষ্ট সব পক্ষকেই দায়িত্বশীল ভূমিকা রাখতে হবে।

বাংলাদেশ পোল্ট্রি খামার রক্ষা জাতীয় পরিষদের সাধারণ সম্পাদক খন্দকার মো: মোহসিন জনকন্ঠকে বলেন, প্রথম দফায় আরেরবারের ঘটনা ঘটেছে তেলের দাম বৃদ্ধির ফলে ট্রাক চলাচলের বিঘ্ন ছিল। খামার থেকে ডিম ঢাকায় সরবরাহ স্বাভাবিক ছিল না। আরেকটা ছিল প্রচন্ড গরমে ওপেন সেডে গুলোতে প্রায় ১০০ ভাগ খামারী মুরগী মারা যায। তিন দিন প্রচন্ড গরমে উৎপাদন কম ছিল। সরবরাহে ঘাটতি থাকায় হঠাৎ করে ডিমের দাম বেড়ে যায়। আবার দ্বিতীয় দফায় খাদ্যের দাম কেজিতে আড়াই টাকা বাড়িয়ে ফেলে। 

সাম্প্রতিক সময়ে খামারীরা যে মূল্য পাচ্ছে এটাও যদি পায়, খামার বন্ধ হয়ে যাবে। উৎপাদন মুলক খরচ কি ভাবে কমানো যায় এ ব্যাপারে গত বছরে প্রানী সম্পদ অধিদপ্তর ছোট খামারীদের সঙ্গে বসে নি। দুইমাসে ফিডের দাম বেড়েছে কেজিপ্রতি ১৩ টাকা। ভোক্তা অধিকারের অভিযানে খামারীদের আতঙ্কিত করেছে। 

আতঙ্কের কারনে ইনভেস্টে যাচ্ছে না। গত ৩০ বছরের মধ্যে সরকার খামারীদের বিপক্ষে কখনোযায় নাই। খছোট খামারীদের পক্ষে ছিল কিন্তু এবার দেখচি ভোক্তা অধিকার কিচু অতিউৎসাহি স্থানীয় প্রশাসন জরিমানা সহ অনেকগুলো সমস্যার সৃষ্টি করেছে। ডিমের দাম কমার সম্ভাবনা নেই। উৎপাদনমুল্য না কমলে ডিমের দাম কমানো সম্ভব না। 

তিনি আরো বলেন, এ পর্য্যন্ত সাত থেকে সাড়ে সাত হাজার খামার বন্ধ হয়েছে গত ছয় মাসে। সরকার যদি খামারীদের সঙ্গে জরুরী ভিত্তিতে না বসে তা হলে আরো খামার ঝড়বে। বড় কোম্পানিগুলোর বিষয়ে একটি নীতিমালায় আসা উচিত। না হলে একসময় ক্ষুদ্র পোল্ট্রি খামারিরা নিঃস্ব হয়ে পড়বে। আর কোম্পানির কাছে জিম্মি হয়ে যাবে কোটি জনগণ। তখন তাদের বেঁধে দেওয়া দামেই ডিম-মুরগি কিনতে হবে। 

তিনি বলেন, পোল্ট্রি খাদ্য তৈরির কাঁচামাল সয়াবিনসহ সবকিছুর দাম বেড়েছে। ইউরোপ ও চীন থেকে মূলত এসব পণ্য আমদানি করতে হয়। সেখানেই দাম বেড়েছে তাই খাদ্যের দামও বেড়েছে। এসব যেন সরকার এবং নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর সরাসরি নিয়ন্ত্রণে থাকে সে বিষয়ে সরকারের পদক্ষেপ জরুরি।

তিনি আরো বলেন , ডিমের দাম বৃদ্ধি মুল কারণ তিনটি। প্রথমত: সম্প্রতি মিল মালিকরা পোল্ট্রি ফিডের দাম কেজি প্রতি ২দশমিক ৫ টাকা বাড়িয়েছে। এতে ডিমের উৎপাদন খরচ বেড়েছে। আগে লেয়ার ফিডের দাম ছিল কেজিপ্রতি ৫৬ টাকা ,এখন ৫৮ দশমিক ৫টাকা। বর্তমানে ডিম উৎপাদনে ৭৬ শতাংশ খরচই হচ্ছে খাদ্যে। দ্বিতীয়: ডিসের উৎপাদন ও সরবরাহ কমে গেছে। ফলে চাহিদার তুলনায় ডিমের বাজারেও ঘাটতি রয়েছে। খাদ্যের দাম বেশি হওয়ায় প্রতিনিয়তই খামার বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। অনেকে উৎপাদন কামিয়ে দিয়েছে। খামারে ধারন ক্ষমতার অনেক কম মুরগি পালন করছেন উদ্যোক্তারা। 

এ বিষয়টিও ডিমের বাজারে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। ডিমের দাম যদি কিছুটা না বাড়তো তবে আরো অনেক খামারি ঝড়ে পড়তো। তৃতীয়ত: আবহাওয়া কারণে সরবরাহ বিঘিœত তলেও মাঝে মাঝে দাম বাড়ে। তবে সেটি বেশীদিন স্থায়ী হয় না। যেমন গত কয়েক দিন আগে টানা বৃষ্টি কারণে দাম হটাঃ করে বেড়েছিল। তবে এখন কিছুটা কমেছে। 
ডিম খাওয়ার কোন বয়স নেই, ডিমের জিংক ও ভিটামিন ডি কোভিড-১৯ সংক্রমণের ঝুঁকি কমায়। ডিম ইমিউনিটি বাড়ায়, হার্ট সুস্থ রাখে, টাইপ-২ ডায়বেটিসের ঝুঁকি কমায়, ভাইরাল ও ব্যাকটেরিয়াল রোগ প্রতিরোধে সহায়তা করে। সুস্থ-সবল থাকতে তাঁরা বেশি বেশি ডিম খাওয়ার পরামর্শ দেন। 

খামারি ও খুচরা ব্যবসায়ীরা বলছেন, কয়েক দফা হাতবদল হলেও ডিমের দাম হালিতে ১০ টাকা বাড়ার কোনো সুযোগ নেই। তাদের দাবি, কিছু অসাধু চক্র তেলের বাজারে অস্থিরতার ফায়দা লুটছে। ফলে গত এক মাসে ডিমের দর বেড়েছে গড়ে ১৬ শতাংশ। গত মাসের মাঝামাঝি সময়ে প্রতি ডজন ১৫০ থেকে ১৫৫ টাকায় উঠেছিল। অভিযোগ আছে, এই সময়ে কারসাজি করে ডিমের বাজার থেকে প্রায় ৫০০ কোটি টাকা অতিমুনাফা করে। জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের বাজার অভিযানে ১১৫ থেকে ১২০ টাকা নেমে আসে।
দাম বাড়ার কারণ অনুসন্ধান করে অধিদফতর জেনেছে, ডিমের বাজারে কারসাজির সঙ্গে জড়িত দেশের বড় ডিমের প্রতিষ্ঠান। 

গত মাসে ডিমের দাম বাড়ার কারণ অনুসন্ধান করে গত ৩০ আগস্ট ভোক্তা অধিদপ্তর বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে একটি প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে ডিমের বাজারে কারসাজির সঙ্গে জড়িত দেশের বড় ডিমের প্রতিষ্ঠান। 

এই বিষয়ে প্রতিযোগিতা কমিশনকে মামলা করার সুপারিশ করেছে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। প্রতিবেদনে বলা হয়, অধিদপ্তরের অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ডিমের ক্রয়মূল্যের ওপর ভিত্তি করে ব্যবসায়ীরা বিক্রয়মূল্য নির্ধারণ করেন না। এই বিক্রয়মূল্য তেজগাঁও ডিম ব্যবসায়ী বহুমুখী সমবায় সমিতি নির্ধারণ করে। এরপর তা মোবাইল বার্তার মাধ্যমে সারা দেশে জানিয়ে দেওয়া হয়। 

অভিযানে দেখা যায়, ব্যবসায়ীরা ডিমের ক্রয় ভাউচার, মূল্যতালিকা ও বিক্রয় রসিদ সংরক্ষণ করেন না। ফের বাড়ছে ডিমের দাম পোলট্রি নগরী হিসেবে খ্যাত গাজীপুর জেলার প্রধান বাজারগুলোতে প্রতি হালি ডিম খুচরায় বিক্রি হচ্ছে ৫৫ টাকা টাকা দরে। আর উপজেলার গ্রামাঞ্চলের বাজারগুলোতে প্রতি হালি ডিম বিক্রি হচ্ছে ৬০ টাকায়; যা বিগত বছরগুলোতে সর্বোচ্চ দাম। 

গাজীপুর জেলা প্রাণিসম্পদ অফিসের দেওয়া তথ্যমতে, জেলায় ছোট-বড় মিলিয়ে মোট ৬ হাজার ৬৭১টি পোলট্রি খামার রয়েছে। ডিম উৎপাদনের জন্য লেয়ার খামারে দেশি বার্ডসহ মুরগির সংখ্যা ১ কোটি ৫০ লাখ। জানা যায়, দিনের পর দিন ওষুধ ও খাদ্যের দাম বৃদ্ধি, শিল্পায়নের প্রসার এবং ঋণের চাপে গাজীপুরের সদর উপজেলা, টঙ্গী, জয়দেবপুর, কালিয়াকৈর, কাপাসিয়া ও শ্রীপুর উপজেলার অধিকাংশ পোলট্রি খামারি তাদের ব্যবসা গুটিয়ে নিয়েছেন।

খামারীরা বলছেন, ডিমের দাম বেড়েছে ৫ কারণে। খাদ্য- শ্রমিকের মজুরি বৃদ্ধি, বিদ্যুত সংকট, চাহিদার চেয়ে উৎপাদন কম ও খামারে ঠিক মত চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে না পারায় ডিম ও মুরগির দাম বেড়েইে চলছে। ফলে পোল্ট্রি শিল্পের সঙ্গে জড়িত খামারীরা উৎপাদনের ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে পারছেন না। 

পোল্ট্রি মালিক সমিতি সূত্রে জানা গেছে, দেশের বিভিন্ন জেলায় ডিম উৎপাদনের কয়েক লাখ প্রান্তিক খামার রয়েছে। মালিবাগ এলাকার রাজ্জাক মিয়া জানান, আগে তাদের বাড়িতে প্রতিদিন ডিম লাগত ৬ পিছ। দাম বেড়ে যাওয়ায় এখন তারা ৩/৪ পিছ ডিম দিয়ে প্রতিদিনের চাহিদা মিটাচ্ছেন। আরেক ভোক্তা জামাল বলেন, খামারী ও ইন্ডাস্টিয়াল উৎপাদকারিরা যোগসাজস করে ডিম ও মুরগির দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। 

এক দশকে ২০১০-১১ থেকে ২০১৮-১৯ পর্যন্ত অর্থবছরে ডিম উৎপাদন বেড়েছে কয়েক গুণ। এ সময়ে ডিম উৎপাদন বেড়েছে ১১’শ ৩ কোটি। যা ২০১০-১১ অর্থবছরে মাত্র ছিল ৬০৮ কোটি পিচ। ২০১৯-২০ অর্থবছরের তুলনায় ২০২০-২১ অর্থবছরে অর্থ্যাৎ মাত্র এক বছরের ব্যবধানে ডিমের উৎপাদন বেড়েছে ৩২১ কোটি পিস। বর্তমানে দেশে একজন মানুষ বছরে ডিম খাচ্ছেন ১২১টি। 

মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ২০১০-১১ অর্থবছরে ডিমের উৎপাদন ছিল ৬০৮ কোটি পিচ। এরপর উৎপাদন বৃদ্ধি ১৮২ শতাংশে দাঁড়ায়। দশবছর পর ২০১৮-১৯ অর্থবছরে এসে দাঁড়ায় ১ হাজার ৭১১ কোটিতে। এর এক বছরের মাথায় করোনাকালে ২০১৯-২০ অর্থবছরে মাত্র ২৫ কোটি ডিম উৎপাদন বেড়ে দাঁড়ায় ১ হাজার ৭৩৬ কোটিতে। করোনা মহামারি কমতে শুরু করলে বিস্ফোরণ হয় প্রাণিসম্পদে; বাড়তে থাকে উৎপাদন। ২০২০-২১ অর্থবছরে ডিম উৎপাদন ৩২১ কোটি বেড়ে ২ হাজার ৫৭ কোটি ৬৪ লাখে পৌঁছায়।

এদিকে সিন্ডিকেটের হাত থেকে পোলট্রি শিল্পকে রক্ষায় ডিমের দাম বেঁধে দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন প্রান্তিক খামারিরা। তারা বলেছেন, একটি চক্র সিন্ডিকেট করে ডিমের দাম বাড়িয়েছে। অথচ প্রান্তিক খামারিরা ডিমের ন্যায্যমূল্য পান না। তারা বছরের পর বছর লোকসান দেন। 

খামারিরা বলেন, ডিমের দাম বাড়ার কারণে প্রান্তিক খামারিদের জরিমানা করা হচ্ছে। পোল্ট্রি খাতের সিন্ডিকেট নির্মূলে ‘পোল্ট্রি বোর্ড’ গঠনের দাবি জানিয়েছে ডিম উৎপাদনকারীদের সংগঠন বাংলাদেশ পোল্ট্রি অ্যাসোসিয়েশন। পোল্ট্রি ফিড, বাচ্চার দাম নিয়ন্ত্রনহীনভাবে বৃদ্ধি ও খামারিদের উৎপাদিত ডিম, মুরগির ন্যায্যমূল্য না পাওয়ার প্রতিবাদে সম্প্রতি আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে সংগঠনটির সভাপতি সুমন হাওলাদার এ দাবি জানান। ডিজেলের দাম বৃদ্ধির অজুহাতে এক মাস আগে ডিমের দাম বাড়িয়ে ফায়দা লুটে এক শ্রেণির মুনাফালোভী ব্যবসায়ী। এরপর জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের অভিযানে ডিমের দাম কমতে শুরু করে। 

গত কয়েকদিন ধরে আবারো ডিমের দাম ঊর্ধ্বমুখী। এবার বাড়তি ফিডের দাম, বাড়তি পরিবহন ভাড়া এবং মুরগির বাচ্চার অস্বাভাবিক দাম বৃদ্ধির অজুহাত দাঁড় করাচ্ছেন পোল্ট্রি সংশ্লিষ্টরা । গত ৯ আগস্ট থেকে ডিমের দাম বাড়তে শুরু করে। 

যা ১৩ আগস্ট রেকর্ড পর্যায়ে পৌঁছায়। ১৮ থেকে ২৪ আগস্টের মধ্যে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সুরক্ষা অধিদফতর (ডিএনসিআরপি) দেশজুড়ে ডিম ব্যবসার সঙ্গে জড়িত প্রতিষ্ঠানগুলোতে অভিযান চালায়। অভিযানে ডিমের বাজারে সিন্ডিকেটের কারসাজির বিষয়টি পরিষ্কার হয়। এরপর বাজারে ডিমের দাম কমতে শুরু করে।

 তবে এই স্বস্তি ছিল ক্ষণস্থায়ী। ডিমের একটি বড় অংশ আসে সারা দেশে ছড়িয়ে থাকা খামারগুলো থেকে।
 

×