করোনা
করোনার উর্ধমুখী সংক্রমণের কারণে আবারও অনলাইনে বিভিন্ন সভা-সেমিনার আয়োজন করার তোড়জোড় শুরু হয়ে গেছে। মন্ত্রিসভার বৈঠক আবারও ভার্চুয়াল পদ্ধতিতে হওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। অনলাইনে পাঠদান শুরু করেছে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট)। পরিস্থিতি এ রকম চলতে থাকলে একে একে অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও অনলাইনে ক্লাস নেয়ার ইঙ্গিত মিলেছে। এ অবস্থায় জনসমাগম এড়িয়ে চলার আহ্বান সংশ্লিষ্টদের। সংক্রমণের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণে না আসলে পরিস্থিতি আবারও খারাপ হওয়ার আশঙ্কা তাদের।
করোনার উর্ধমুখী সংক্রমণ নিয়েই শুরু হয়েছে জুলাই মাস। এ মাসে কোরবানির ঈদের মতো বড় একটি ধর্মীয় উৎসব রয়েছে। মার্কেট-কোরবানির হাটসহ ঈদে ঘরমুখো মানুষের পদচারণায় রেলস্টেশনগুলো মুখর। কারও মধ্যে সামাজিক দূরত্ব তো দূরে থাক, নেই ন্যূনতম মাস্কের ব্যবহারও। তাই অন্তত মানুষজনকে আবারও মাস্ক ব্যবহারে উদ্বুদ্ধ করতে প্রচারসহ প্রয়োজনে আইন প্রয়োগ করার তাগিদ বিশেষজ্ঞদের।
করোনা মহামারীর মধ্যে দেশে ভার্চুয়াল পদ্ধতিতে হয়েছিল মন্ত্রিসভার বৈঠক। দীর্ঘদিন পর চলতি বছরের ২৮ মার্চ থেকে আবার সশরীরে এ বৈঠক হয়। তিন মাস পর করোনার সংক্রমণ বাড়ায় আবারও ভার্চুয়াল পদ্ধতিতে হতে যাচ্ছে মন্ত্রিসভার বৈঠক। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে সম্প্রতি সংশ্লিষ্টদের পাঠানো এক চিঠিতে জানানো হয়, রবিবার ভার্চুয়াল পদ্ধতিতে মন্ত্রিসভার বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে। এ সভায় অংশগ্রহণকালে প্রধানমন্ত্রী গণভবন এবং মন্ত্রিসভার সদস্য ও সচিবরা বাংলাদেশ সচিবালয়ের মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের ১ নম্বর ভবনের চতুর্থ তলায় অবস্থিত মন্ত্রিপরিষদ কক্ষে (কক্ষ নম্বর-৩০৪) অবস্থান করবেন। তবে, নিয়ম অনুযায়ী বৈঠক শেষে সচিবালয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম সংবাদ সম্মেলন করবেন।
একইভাবে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, সম্প্রতি করোনা সংক্রমণ আশঙ্কাজনক হারে বৃদ্ধি পাওয়ায় ২ জুলাই থেকে বুয়েটের ¯œাতকোত্তর পর্যায়ের সব ক্লাস অনলাইনে অনুষ্ঠিত হবে।
গত জুন মাসের শুরুতে করোনার সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে থাকলেও মাসের মাঝামাঝি এসে তা আবারও বাড়তে থাকে। মাত্র ৩৪ জনের সংক্রমণের খবর দিয়ে মাস শুরু হলেও মাস শেষে আক্রান্তের সংখ্যা ছাড়ায় ২ হাজারের বেশি। পুরো মাসে নতুন করে শনাক্ত ছাড়ায় ২০ হাজারের বেশি। পরীক্ষার বিপরীতে ০.৬৩ শতাংশ হার মাস শেষে পৌঁছায় ১৫.২৩ শতাংশে। একই ধারাবাহিকতা অব্যাহত রেখেই শুরু হয়েছে জুলাই মাসও। মাসের প্রথম দিন অর্থাৎ ১ জুলাই দেশে করোনা শনাক্ত হয় ১ হাজার ৮৯৭ জনের, মৃত্যু হয় ৫ জনের। শনিবারে মৃত্যুসংখ্যা আরও বাড়ে। এদিন ভাইরাসটিতে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন ৬ জন। নতুন করে শনাক্ত হন আরও ১ হাজার ১০৫ জন। এমন অবস্থায় মাস্ক ব্যবহারে কড়াকড়ি আরোপের চিন্তা করা হচ্ছে জানিয়ে স্বাস্থ্য অধিদফতরের মুখপাত্র অধ্যাপক ডাঃ নাজমুল ইসলাম জনকণ্ঠকে বলেন, আমরা কারিগরি কমিটির পরামর্শের জন্য অপেক্ষা করছি। তাদের পরামর্শ অনুযায়ীই হয়তো আমরা সিদ্ধান্ত নেব। আমরা দেখেছি, সম্প্রতি বন্যায় দেশের বিভিন্ন অঞ্চল বিপর্যস্ত। এসব এলাকার মানুষজনের খেয়ে-পরে বেঁচে থাকাই মুশকিল হয়ে দাঁড়িয়েছে। এমন অবস্থায় স্বাস্থ্যবিধি মানাটা একটু কষ্টেরই। তবে, এখনকার এই ট্রান্সমিশনটা হয়েছে গত রমজানের ঈদের সময়ই হয়তো। ওই সময় রাজধানী ছেড়ে বহু মানুষ নিজ এলাকায় ঈদ করতে গিয়েছেন। ফলে ভাইরাসটি দেশজুড়ে আবারও ছড়িয়ে পড়ার সুযোগ পেয়েছে। এখন তো আবার মানুষের মধ্যে টেস্ট করারও প্রবণতা কম। সামান্য জ্বর-সর্দি ভেবে কেউ টেস্ট করাতে চান না। ফলে এটি আরও ছড়িয়ে পড়ছে। পরিবারের একজন আক্রান্ত হলে দেখা যাচ্ছে অন্য সবাই আক্রান্ত হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে মানুষের মধ্যে সচেতনতাটা অত্যন্ত জরুরী। এই যেমন আসন্ন কোরবানির ঈদের আবারও মানুষজন ঢাকা ছেড়ে যাবে। কোরবানির পশুর হাটগুলোতে মানুষের ভিড় হবে। শপিং মলগুলোতে মানুষ যাবেই। কাউকে তো আমরা ধরে রাখতে পারব না। তবে, এ ক্ষেত্রে সবাই যেন মাস্ক ব্যবহার করে, সে ব্যাপারটির ওপর আমাদের জোর দিতে হবে। কারিগরি কমিটির সিদ্ধান্তের অপেক্ষা করছি আমরা। সভা-সেমিনার অনলাইনে করার কোন নির্দেশনা স্বাস্থ্য অধিদফতরের পক্ষ থেকে দেয়া হবে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, এখনই হয়তো এ বিষয়ে কোন নির্দেশনা দেয়া হবে না। তবে, আমরা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছি। যদি প্রয়োজন পড়ে অবশ্যই এ রকম সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।
করোনা সংক্রমণের উর্ধমুখীর কারণে বুয়েটে অনলাইনে ক্লাস শুরু হলেও এখনও অনলাইনে ক্লাস নেয়ার কথা ভাবছে না ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা যায়, আসন্ন ঈদ-উল- আজহার ছুটি শুরু হবে ৮ জুলাই থেকে। খুলবে ১৬ বা ১৭ তারিখে। এর মধ্যে পরিস্থিতি খারাপ হলে অবশ্যই অনলাইনে ক্লাস নেয়ার সিদ্ধান্ত হতে পারে।
শুধু বিশ্ববিদ্যালয় নয়, করোনা পরিস্থিতি এ রকম উর্ধমুখী চলতে থাকলে দেশের অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও আবারও অনলাইনে ক্লাস নেয়ার সিদ্ধান্ত আসতে পারে বলে জানিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক, মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা জনকণ্ঠকে বলেন, আমরা বরাবরই বলে আসছি মানুষের জীবনের নিরাপত্তা সবচেয়ে আগে। পরিস্থিতি যদি খারাপের দিকে যায় আবারও, তাহলে নিশ্চয় অনলাইনে ক্লাস নেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। এমনিতেই আর কয়দিনের মধ্যে ঈদের ছুটি শুরু হয়ে যাবে। এরপর যদি সংক্রমণ পরিস্থিতি উর্ধমুখীই থাকে, তাহলে কোভিড-১৯ প্রতিরোধে গঠিত জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির পরামর্শেই সিদ্ধান্ত নেয়া হবে এ ব্যাপারে।
এর আগে ২০২০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে করোনার কারণে প্রথম অনলাইনে নিয়মিত শ্রেণী পাঠদান চালানোর নির্দেশনা দেয় মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতর (মাউশি)। ওই সময় বলা হয়েছিল, সংসদ টেলিভিশনের প্রচারিত শ্রেণী পাঠদানের সঙ্গে সমন্বয় করে শ্রেণী পাঠদানের রুটিন তৈরি করবে স্ব স্ব প্রতিষ্ঠান। ওই রুটিন অনুযায়ী নিয়মিত পাঠদান চালিয়ে যেতে হবে। যদি করোনা পরিস্থিতি এ রকমই থাকে, তাহলে এ রকম সিদ্ধান্ত আবারও নেয়া হতে পারে জানিয়ে ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক তপন কুমার সরকার জনকণ্ঠকে বলেন, দীর্ঘদিন পরে যখন আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো স্বাভাবিক হতে শুরু করে, তখনই বন্যার ভয়াবহতা শুরু হয় দেশজুড়ে। এখন আবার বাড়ছে করোনা। এমন অবস্থা যদি চলতে থাকে, তাহলে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ মোতাবেক আবারও অনলাইনে পাঠদানের সিদ্ধান্ত নেয়া হতেই পারে।
তবে, জনগণের মধ্যে সচেতনতা তৈরি না হলে পরিস্থিতির উন্নয়ন হবে না বলে আশঙ্কা বিশেষজ্ঞদের। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডাঃ লেনিন চৌধুরী জনকণ্ঠকে বলেন, আমরা শুরু থেকেই বলে আসছি, করোনা নিয়ন্ত্রণে থাকলেও মানুষকে স্বাস্থ্যবিধি মানতে হবে। কারণ, একজনও যদি করোনার রোগী থাকে, তাহলে এটি ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা থাকে। এখন এমনটিই হয়েছে। মানুষের জীবনযাত্রা স্বাভাবিক হয়ে যাওয়ায় মানুষ আর স্বাস্থ্যবিধি মানছে না। এমনকি, মাস্কও ব্যবহার করছে না। আর এতে করেই বাড়ছে করোনা। সঠিক নিয়মে অন্তত মাস্কটা ব্যবহার করতে হবে। নইলে পরিস্থিতি আবারও খারাপ হতে বাধ্য।
মানুষজনের মধ্যে সচেতনতা তৈরি না হলে আবারও বিধিনিষেধে কড়াকড়ি আরোপ করা হতে পারে বলে জনকণ্ঠকে জানিয়েছেন স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডাঃ আবুল বাশার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম। তিনি বলেন, দেখেন, গত ছয় মাসে আমরা ভাইরাসটিকে মোটামুটি নিয়ন্ত্রণে নিয়ে এসেছিলাম। একটা সময় মনে হচ্ছিল ভাইরাসটি বুঝি পুরোপুরিই চলে যাবে। তখন মানুষের মধ্যেও সচেতনতা ছিল চোখে পড়ার মতো। কিন্তু যেই সব বিধিনিষেধ শিথিল করা হলো, সেই থেকে মানুষের মধ্যে সচেতনতাও উধাও। মানুষজন এখন মাস্কও ব্যবহার করে না। সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা তো দূরে থাক। কিন্তু এভাবে যদি সংক্রমণ বাড়তে থাকে তাহলে আমাদের আবারও বিধিনিষেধে কড়াকড়ি আরোপ করা ছাড়া আর কোন উপায় থাকবে না।