হোলি আর্টিজানের ট্র্যাজেডির ছয় বছর পূর্তিতে ভবনের সামনে নিহতদের স্মরণে শ্রদ্ধা নিবেদন
হলি আর্টিজানে জঙ্গী হামলায় নিহতদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়েছেন বাংলাদেশে নিযুক্ত বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকসহ বিভিন্ন পেশার মানুষ। ওই হামলার ঘটনায় ছয় বছর পূর্তিতে শুক্রবার সকালে সাড়ে সাতটায় গুলশানের ৭৯ নম্বর সড়কের পাঁচ নম্বর প্লটের ওই ভবনের সামনে হামলায় নিহত ব্যক্তিদের উদ্দেশে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন তারা। কড়া নিরাপত্তার মধ্যে প্রথমেই ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন বাংলাদেশে নিযুক্ত জাপানের রাষ্ট্রদূত ইতো নাওকি। তারপর ইতালির রাষ্ট্রদূত এনরিকো নুনজিয়াতা, যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত পিটার হাস ও ভারতের হাইকমিশনার বিক্রম কুমার দোরাইস্বামী শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। এ সময় মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস জানান, বাংলাদেশ জঙ্গীবাদ দমনে যে ভূমিকা দেখিয়েছে তা প্রশংসনীয়। জঙ্গীবাদ দমনে গণমাধ্যমের ভূমিকারও প্রশংসা করেন তিনি। সকালে গুলশানের হলি আর্টিজান হামলার ষষ্ঠ বার্ষিকী উপলক্ষে দীপ্ত শপথ ভাস্কর্যে শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে র্যাপিড এ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র্যাব) মহাপরিচালক চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন বলেছেন, জঙ্গী ও সন্ত্রাসবাদ দমনে বাংলাদেশের সাফল্য ঈর্ষণীয়। তিনি জানান, ৬ বছর আগে ২০১৬ সালের পহেলা জুলাই হলি আর্টিজানে যে মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে। এতে ৩ বাংলাদেশীসহ ২০ জন নিহত হন। যারা মারা গিয়েছেন আমরা তাদের রুহের মাগফেরাত কামনা ও আত্মার শান্তি কামনা করছি। ওই সময় দুজন পুলিশ অফিসার বীরত্বের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে নিহত হন। র্যাব ডিজি জানান, র্যাব সব সময় জঙ্গীবাদ ও সন্ত্রাসবাদ দমনে দৃঢ়ভাবে দায়িত্ব পালন করে আসছে। র্যাবের গোয়েন্দা শাখার প্রধান কর্নেল আজাদ সিলেটে জঙ্গীবাদ বিরোধী অভিযানে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে নিহত হন। আমি তার রুহের মাগফেরাত কামনা করছি। তার পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা প্রকাশ করছি। চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন জানান, হলি আর্টিজান ঘটনার ১২ ঘণ্টার মধ্যে আমরা ওই এলাকা সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে আনি। অভিযান পরিচালনা করার মতো কয়েকজন একটি পরিবেশ সৃষ্টি করি। হলি আর্টিজানের ঘটনা যেদিন সংঘটিত হয় সেদিন জঙ্গীরা অনলাইনে লাইভ করেছিল। তাদেরকেও আমরা চিহ্নিত করেছি ও তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছি। তিনি বলেন, র্যাব আজ পর্যন্ত ৩ হাজার জঙ্গী গ্রেফতার করেছে। হলি আর্টিজানের পর আমরা ১ হাজার ৫০০ এর বেশি জঙ্গী গ্রেফতার করেছি। গ্রেফতারকৃত জঙ্গীদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো মূল পরিকল্পনাকারী আমির সারোয়ার জাহান, অর্থায়ন ও পরিকল্পনার সঙ্গে জড়িত শরিফুল ইসলাম খালেক ও মামনুর রশিদ রিপন। র্যাব মহাপরিচালক জানান, বিভিন্ন বাহিনী ও আমরা একসঙ্গে জঙ্গীদের বিরুদ্ধে সাঁড়াশি অভিযান পরিচালনা করি। সরকার ঘোষিত জঙ্গীদের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি অংশ হিসেবে আমরা সমন্বিতভাবে সাঁড়াশি অভিযান পরিচালনা করে জঙ্গীদের নেটওয়ার্ক ও আস্তানা ভেঙ্গে দিয়েছি। তিনি জানান, জঙ্গীবাদ ও সন্ত্রাসবাদ দমনে বাংলাদেশ ঈর্ষণীয় সাফল্য অর্জন করেছে। আমরা যেভাবে জঙ্গীবাদ দমন করেছি সেই ধারাবাহিকতা ধরেও রেখেছি। সাইবার জগতে আমরা জঙ্গী কার্যক্রমের বিষয়ে নজরদারি রাখছি। জঙ্গীবাদ দমনে সব আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এক সঙ্গে সমন্বিতভাবে কাজ করছি। যার কারণে জঙ্গীবাদ এখন তাদের সক্ষমতা প্রদর্শন করতে পারছে না। তারপরেও আমরা কিন্তু আত্মতুষ্টিতে ভুগছি না, সব সময় সতর্ক আছি। র্যাব ডিজি বলেন, আমরা ১৬ জঙ্গীকে আত্মসমর্পণ করিয়েছি। তাদের সঙ্গে আমরা সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখছি, যাতে করে তারা আবার জঙ্গীবাদে জড়িয়ে না পড়ে। কেউ যদি জঙ্গীবাদের পথ ছেড়ে ভাল পথে আসতে চায় এবং কোন অপরাধে এখনও জড়িত হয়নি তাদের ভাল পথে, শান্তির পথে আসার জন্য আমরা উদ্বুদ্ধ করি। দীপ্ত শপথ ভাস্কর্যে শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার মোহাঃ শফিকুল ইসলাম বলেন, হলি আর্টিজানে জঙ্গী হামলার পর ঘুরে না দাঁড়াতে পারলে পদ্মা সেতু-মেট্রো রেল প্রজেক্ট বাস্তবায়ন হতো না। কোন বিদেশী ইঞ্জিনিয়ার, টেকনিশিয়ান জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বাংলাদেশে কাজ করতে আসতেন না। আমরা ঘুরে দাঁড়াতে পেরেছি বলেই দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। ডিএমপি কমিশনার জানান, হরকাতুল জিহাদের মাধ্যমে বাংলাদেশের জঙ্গীবাদের উত্থান হয়। এরপর ইরাকে যখন আইএসআইএসর উৎপাত শুরু হয়, তখন বাংলাদেশের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য দেশের কিছু মানুষ তামিম চৌধুরীর নেতৃত্বে হলি আর্টিজান হামলা চালায়। জঙ্গীবাদ দমনে পুলিশের অবদানের কথা তুলে ধরে পুলিশ কমিশনার মোঃ শফিকুল ইসলাম বলেছেন, বিভিন্ন সময় এন্টি-টেরোরিজম ইউনিট-সিটিসিসহ বিভিন্ন মেট্রো ও জেলা পুলিশে সিটিসির মতো একটি করে ছোট ইউনিট করা হয়েছে। ইউনিটের অধিকাংশ সদস্যই ইউএস সরকারের পক্ষ থেকে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত হন। এছাড়া ইউএস সরকারের পক্ষ থেকে অস্ত্র এবং প্রটেকশনের কথা বলা হয় বাংলাদেশকে। তিনি বলেন, ইউএস সরকারের পক্ষ থেকে এই রিকোয়ারমেন্ট পাওয়ার পর থেকেই আপনারা লক্ষ্য করেছেন, চট্টগ্রামের মৌলভীবাজার ও খুলনা বিভাগের বিভিন্ন স্থানসহ দেশের অনেক জায়গায় জঙ্গীবাদ মাথা চাড়া দিয়ে ওঠার চেষ্টা করে। সে সময় জঙ্গীদের আস্তানা তছনছ করে দেয়া হয়। ডিএমপি কমিশনার বলেন, জঙ্গী দামনে আমরা আর তৃপ্তিতে ভুগছি না। কারণ এখনও জঙ্গী তৎপরতা মাঝে মাঝে চোখে পড়ছে। জঙ্গীদের সোশ্যাল মিডিয়ায় একটিভিটিসহ সব বিষয়ে আমরা মনিটরিং করি। বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতের হাইকমিশনার বিক্রম কুমার দোরাইস্বামী বলেন, এটা খুবই মর্মান্তিক ঘটনা। বাংলাদেশের বন্ধু হিসেবে আমরা খুবই ব্যথিত। বাংলাদেশের পুলিশসহ সাধারণ মানুষ এই ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন। আমাদের মনে রাখা উচিত, ঘটনাগুলো কেন ঘটেছে, আমাদের উচিত যৌথভাবে এসব মোকাবেলা করা, যাতে এ ধরনের ঘটনা আর না ঘটে। জাপানী রাষ্ট্রদূত ইতো নাওকি বলেন, ছয় বছর আগের এই ঘটনায় আমাদের সাতজন নাগরিক মারা গেছেন, তারা সবাই জাইকার ঢাকা মেট্রো লাইন-১ প্রজেক্টে কাজ করতেন। তারা রিসার্চের কাজ করছিলেন। আমরা তাদের কখনও ভুলব না, ওইদিন কি ঘটেছিল তা আমরা কখনও ভুলব না। তিনি বলেন, বাংলাদেশের সঙ্গে জাপানের গুরুত্বপূর্ণ পার্টনারশিপ ও সম্পর্ক রয়েছে। এই সেপ্টেম্বরে লাইন-১ এর কাজ শুরু হবে। এই কাজটা চালিয়ে যাওয়া এবং শেষ করা আমাদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এটা আমাদের দায়িত্ব। হলি আর্টিজান হামলায় তৎকালীন ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের সহকারী পুলিশ কমিশনার (এসি) রবিউল ও বনানী থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) সালাউদ্দিন নিহত হন। তাদের স্মরণে গুলশান মডেল থানার সামনে দীপ্ত শপথ নামে এই দুই অফিসারের ভাস্কর্য বানানো হয়। প্রতিবছর হলি আর্টিজানের হামলার বার্ষিকীতে দীপ্ত শপথ ভাস্কর্যে শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয় তাদের স্মরণে। এই দুই পুলিশ কর্মকর্তার স্মরণে নির্মিত গুলশানের দীপ্ত শপথ ভাস্কর্যে শুক্রবার সকালে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানাতে এসেছিলেন নিহত সালাউদ্দিনের স্ত্রী রেমকিম খান, কন্যা সামান্তা খান ও পুত্র এস এম রায়ান। শ্রদ্ধা জানানোর পর সালাউদ্দিনের স্ত্রী রেমকিম খান জানান, শুধু এই দিনে আমরা তাকে বেশি মিস করি, বিষয়টি এমন নয়। যেদিন থেকে আমরা ওকে (সালাউদ্দিন) হারিয়েছি, সেদিন থেকে প্রতিটি দিন, প্রতিটি মুহূর্তে আমরা তাকে মিস করি। দুই সন্তানের প্রসঙ্গ টেনে রেমকিম খান বলেন, বাচ্চারা (দুই সন্তান) বাবাকে মিস করেনি এমন কোনদিন আমি দেখিনি। তার (সালাউদ্দিন) অনুপস্থিতিতে বাচ্চারা কীভাবে যে বেড়ে উঠছে বাবার জায়গাটা আমি মা হয়ে শত চেষ্টা করেও পূরণ করতে পারিনি। দুই সন্তানের লেখাপড়া প্রসঙ্গে রেমকিম বলেন, সালাউদ্দিন যখন মারা যায় তখন মেয়েটা সপ্তম শ্রেণীতে আর ছেলেটা কেজি টুতে পড়ত। পুলিশ সার্ভিস এ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে এসবি প্রধান মনিরুল ইসলাম ও বিভিন্ন ইউনিটের পুলিশ সদস্যরা শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেন। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, ২০১৬ সালের ১ জুলাই রাতে ঢাকার গুলশানে হোলি আর্টিজান বেকারিতে নৃশংস হামলা চালান জঙ্গীরা। তারা অস্ত্রের মুখে দেশী-বিদেশী অতিথিদের জিম্মি করেন। ভয়াবহ ওই হামলার ঘটনায় স্তম্ভিত হয়ে পড়ে পুরো দেশ। সেদিন জঙ্গীরা কুপিয়ে ও গুলি করে হত্যা করেন ২০ দেশী-বিদেশী নাগরিককে, যাদের মধ্যে ৯ জন ইতালীয়, ৭ জন জাপানী, ১ জন ভারতীয় ও ৩ জন বাংলাদেশী। ডিবির সহকারী কমিশনার (এসি) মোঃ রবিউল করিম ও বনানী থানার তৎকালীন অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মোঃ সালাহউদ্দিন খান নিহত হন।