জাপানে রবীন্দ্রনাথ ॥ অজানা অধ্যায়
দীর্ঘ ২০ বছর পর জাপান সরকার তিনটি কাগুজে টাকা বা ব্যাংকনোট নতুনরূপে অবমুক্ত করেছে গত ৪ জুলাই (২০২৪) পূর্বঘোষণা অনুযায়ী। নোট তিনটি যথাক্রমে ১০০০, ৫০০০ এবং ১০০০০ ইয়েনবিশিষ্ট। এর মধ্যে সর্বোচ্চ মানের কাগুজে নোট হচ্ছে ১০০০০ ইয়েনের যাকে জাপানি ভাষায় বলা হয় মান। ১০ হাজার ইয়েনে ১মান। আর এই ১ মান ইয়েনের নেটে যার ছবি মুদ্রিত হয়েছে তিনিই আলোচনার বিষয় হয়ে উঠেছেন বিগত এক বছর ধরে।
তিনি আধুনিক জাপানের কতিপয় কারিগরদের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় প্রবল প্রভাবশালী সুবিশাল ব্যক্তিত্ব এবং জাপানি পুঁজিবাদের জনক। তার জীবন ও কর্মকা- নিয়ে ইতোমধ্যে জাতীয় সম্প্রচার মাধ্যম এনএইচকে (নিপ্পন হোসোওসোও কিয়োওকাই) টিভিনাটক প্রচার করেছে। একাধিক ম্যাগাজিন বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করেছে। একাধিক গ্রন্থ রচিত হয়েছে। এমনকি, তার রচিত গ্রন্থও পুনর্মুদ্রিত হয়েছে। ব্যাপক আলোচ্যমান এই ব্যক্তির নাম শিবুসাওয়া এইইচি (১৮৪০-১৯৩১)।
অত্যন্ত আনন্দের বিষয় এখানেই যে তার ছবিসম্বলিত রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ জাতীয় মুদ্রা প্রকাশের স্মারক-সময়ে একইসঙ্গে স্মরিত হচ্ছেন এশিয়ার আরেক প্রভূত প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১-১৯৪১)। বিভিন্ন প্রকাশনায় তাদের দুজনের ছবিও প্রকাশিত হয়েছে। বাঙালি হিসেবে এই ঘটনা আমাদের জন্য অত্যন্ত সম্মান ও শ্লাঘার বিষয়। কী ছিল তাদের দুজনের সম্পর্ক যা অপ্রকাশিতই থেকে গেছে শত বছর ধরে। গবেষণা তো দূরের কথা, স্বয়ং কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরই তার নাম বা কথা কোনো রচনায় উল্লেখ করেছেন বলে আমার জানা নেই। জানা যাক এশিয়ার এই দুই দিকপালের সম্পর্ক কী ছিল?
আধুনিক জাপানের স্বপ্নদ্রষ্টা জাপানশীর্ষ শিল্পপতি শিবুসাওয়ার এইইচির সঙ্গে কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের (১৮৬১-১৯৪১) সাক্ষাৎ এবং সম্পর্ক এক অজানা ইতিহাস। শিবুসাওয়া ছিলেন সামুরাই বংশে জন্ম জাপানের মেইজি (১৮৬৮-১৮১২), তাইশোও (১৯১২-১৯২৬) এবং শোওয়া যুগের (১৯২৬-১৯৮৯) প্রভূত ক্ষমতাধর সরকারি আমলা এবং পরবর্তীকালে ব্যবসায়ী, শিল্পপতি, ব্যাংক এবং শেয়ার এক্সচেঞ্জ ব্যবসার প্রবর্তক।
তিনি জাপানি পুঁজিবাদের জনক হিসেবে স্বীকৃত। আধুনিক নারীশিক্ষা প্রসারেরও প্রধান পৃষ্ঠপোষক ছিলেন তিনি। জাতীয় অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা ও অবদান রাখার জন্য তিনি ব্যারন, ভিসকাউন্ট প্রভৃতি উপাধিতে ভূষিত হয়েছিলেন। তিনি জাপানে ৫০০ ছোট-বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠা ও উদ্যোগের সঙ্গে জড়িত ছিলেন যা এক কিংবদন্তি। ভারতের বিখ্যাত টাটাব্যবসা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গেও ছিল তার ব্যবসায়িক সম্পর্ক। ১৯০৩ সালে প্রতিষ্ঠিত দি জাপান-ইন্ডিয়া অ্যাসোসিয়েশনের তৃতীয় প্রেসিডেন্ট ছিলেন শিবুসাওয়া।
১৯১৬ সালে টোকিওর বর্তমান জে.আর.ওওজি রেল স্টেশনসংলগ্ন আসুকায়ামা শহরে তৎকালীন তার দৃষ্টিনন্দন গ্রীষ্মাবাস তথা বাগানবাড়িতে রবীন্দ্রনাথকে সাদর অভ্যর্থনা প্রদান করেছিলেন। তিনিই সদ্য নোবেল পুরস্কার বিজয়ী কবি রবীন্দ্রনাথকে প্রথম জাপান সফরে আমন্ত্রণ জানান বলে কথিত আছে। যা ছিল রবীন্দ্রনাথের বহু প্রতীক্ষিত স্বপ্ন। সরকারি আমলা, বুদ্ধিজীবী, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, রাজনীতিক, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, গবেষক, লেখক, সাংবাদিকসহ প্রায় ৪০ জন বিশিষ্ট ব্যক্তি উক্ত অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।
রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তখন পিয়ার্সন, অ্যান্ড্রুজ এবং মুকুলচন্দ্র দে ছিলেন ভ্রমণসঙ্গী। এখন সেই বাসভবনটির বদলে সেখানে গড়ে উঠেছে শিবুসাওয়া সংগ্রহশালা, কাগজ প্রস্তুতবিষয়ক জাদুঘর এবং সবুজ উদ্যান। কিন্তু যে বাগানটিতে দুজনে বিচরণ করেছিলেন সেই স্থানটি এখনো বিদ্যমান। যদিও সেখানে দুজনের সম্প্রীতির একটি স্মৃতিফলক স্থাপন করা যেত বা এখনো যায়।
এরপর ১৯২৪ এবং ১৯২৯ সালেও রবীন্দ্রনাথ যখন জাপানে আসেন শিবুসাওয়া তাকে তার বাসভবনে আমন্ত্রণ জানান এবং আপ্যায়িত করেন যথাযোগ্য মর্যাদার সঙ্গে। দোভাষীর মাধ্যমে পরস্পর মতবিনিময়ে মিলিত হন। শিবুসাওয়া জাপান-ইন্ডিয়া অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে বর্ণাঢ্য সাংস্কৃতিক সন্ধ্যারও আয়োজন করেন। তিনি রবীন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতন বিদ্যালয়ের উন্নয়নকল্পে বেশ মোটা অঙ্কের চাঁদা তৎকালীন ২০০০ ইয়েন উপহার দেন।
স্বগৃহে রবীন্দ্র-অভ্যর্থনার বিশদ বর্ণনা শিবুসাওয়ার পারিবারিক দিনপঞ্জিতে উল্লিখিত আছে। আছে শিবুসাওয়াকে লিখিত রবীন্দ্রনাথের চিঠি এবং ১৯২৪ সালে সংবর্ধনার উত্তরে রবীন্দ্রনাথ যে জ্ঞানগর্ভ বক্তৃতা দিয়েছিলেন সেটির ইংরেজি অনুলিপিও। এই বক্তৃতাতে কবি তার পারিবারিক ইতিহাস, ভারতের আদর্শ, প্রাচ্য-প্রতীচ্য সম্পর্ক এবং য়োরোপ-প্রভাবিত জাপানের ভবিষ্যৎপন্থা কী হওয়া উচিত সে সম্পর্কে তার নিজস্ব মতামত ব্যক্ত করেন। নিঃসন্দেহে একটি গুরুত্বপূর্ণ রবীন্দ্রদলিল জাপান বিষয়ে যা ২০০৭ সালে রবীন্দ্রনাথের জাপানে প্রদত্ত ইংরেজি বক্তৃতা সংকলন টকস্ইন জাপান কলকাতার শিজেন প্রকাশনা সংস্থা থেকে প্রকাশিত গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।
কবি, সাহিত্যিক, সঙ্গীতজ্ঞ, শিক্ষাবিদ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং ব্যবসায়ী ও শিল্পপতি এইইচি শিবুসাওয়ার মধ্যে কোনো ব্যবসায়িক সম্পর্ক ছিল নাÑ ছিল আত্মিক, আধ্যাত্মিক এবং প্রাচ্যভ্রাতৃবাদী সম্পর্ক (প্যান্-এশিয়ানিজম)। এশিয়ায় কবি হিসেবে, প্রকৃতিনির্ভর শিক্ষাবিদ এবং দার্শনিক হিসেবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যে আলো জ্বেলেছিলেন তার আলো জাপানেও এসে পড়েছিল। সেই সময়ে জাপানিদের সবচেয়ে বেশি আকৃষ্ট করেছিল রবীন্দ্রনাথের উপনিষদ প্রভাবিত আশ্রমিক শিক্ষাপদ্ধতি এবং বৌদ্ধধর্মের নিরঙ্কুশ অহিংসাপ্রভাবিত আন্তর্জান্তিক চিন্তাভাবনা, যা তার প্রায় প্রতিটি বক্তৃতার মধ্যে খুঁজে পাওয়া যায়।
উনিশ শতক থেকে বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পর্যন্ত এই দেড়শ বছরের ইতিহাস খুঁজলে পরে সর্বক্ষেত্রেই জাপান ও দুই বাংলার সমাজসংস্কারকদের মধ্যে নিবিড় মিল পরিলক্ষিত হয়। অন্ততপক্ষে, রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে উন্নয়নমনস্ক শিক্ষিত ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিরা আধুনিকায়নে বিশেষ ভূমিকা রেখেছিলেন অবশ্য স্বজাতিবোধ, সংস্কৃতি ও প্রাচ্যারীতিকে উচ্চাসনে রেখেই। শিবুসাওয়া ছিলেন সেই ধারার একজন দেশপ্রেমিক।
তাই তাকে হাতেগোনা আধুনিক জাপান-নির্মাতাদের শীর্ষপ্রধান বলে আজও মানুষ স্মরণ করে থাকেন। কাজেই এহেন দুজন দুই বিপরীত মেরুর পথিক হলেও মিলিত হয়েছিলেন দুটি ভাবাদর্শে : একটি জাতীয়তাবোধ অন্যটি প্রাচ্যবাদ। দুজনেই ছিলেন খাঁটি স্বাদেশিক মানুষ। যদিওবা দুজনের এই ঐতিহাসিক সম্পর্ক অজানাই থেকে গেছে দুই জাতির বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর কাছে।
রবীন্দ্রনাথের প্রথম জাপান সফর উপলক্ষে বিভিন্ন স্মারক গ্রন্থ প্রকাশ এবং পত্রপত্রিকা-সাময়িকীতে তার বিভিন্ন দিক নিয়ে জাপানি ভাষায় প্রচুর লেখালেখি হয়েছিল। এর মধ্যে ২৮২ পৃষ্ঠার সাদাকালো স্মারক গ্রন্থ সেই তাগো-রু বা ঋষি টেগোর অত্যন্ত মূল্যবান এবং ঐতিহাসিক। যা একেবারেই দু®প্রাপ্য এখন। প্রকাশিত হয়েছিল তৎকালীন দোওবুনকান তোওকিয়োও প্রকাশনা সংস্থা থেকে, ১৯১৬ সালের জুলাই মাসের ৩ তারিখে।
এই সফরের সময় রবীন্দ্রনাথ প্রায় তিন মাসকাল জাপানে অবস্থান করেছিলেন য়োকোহামা বন্দরসংলগ্ন বিখ্যাত সানকেই এন বাগানবাড়িতে। এই গ্রন্থে সর্বমোট ১৬টি বক্তৃতাধর্মী প্রবন্ধ, গীতাঞ্জলি থেকে অনূদিত একাধিক কবিতা, ৯টি দুর্লভ আলোকচিত্র, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর অঙ্কিত ৪টি এবং গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর অঙ্কিত ১টি চিত্র মুদ্রিত আছে। অর্থপূর্ণ করে তুলেছে ভ্রমণসঙ্গী কিশোর চিত্রশিল্পী মুকুলচন্দ্র দের স্বহস্তে অঙ্কিত সংস্কৃত ভাষায় চিত্রিত একটি বাণী।
প্রবন্ধগুলো লিখেছেন তৎকালীন তেইকোকু (ইম্পেরিয়াল বর্তমানে টোকিও) বিশ্ববিদ্যালয়, ওয়াসেদা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশিষ্ট অধ্যাপক ছাড়াও ধর্মীয় পুরোহিত, সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী এবং লেখকবৃন্দ। তাতে রয়েছে রবীন্দ্রনাথের ৩টি বক্তৃতার অনুবাদ। দুটি ইংরেজি যথাক্রমে ইন্ডিয়া অ্যান্ড জাপান, দি মেসেজ অব ইন্ডিয়া টু জাপান এবং অন্যটি বাংলায়।
এট কি সরাসরি বাংলা থেকে জাপানি ভাষায় অনূদিত কিনা স্পষ্ট নয়, জাপানি তে নামকরণ করা হয়েছে নিহোন য়ো, নানজি নি নোজোমু অর্থাৎ হে জাপান, তোমার কাছে প্রত্যাশা। শিরোনাম থেকেই বোঝা যাচ্ছে কতখানি তাৎপর্য বহন করছে রচনাগুলো। কোনো-কোনো কাগজে এগুলো প্রকাশিত হয়েছিল যেমন ব্রিটিশ-ভারতের অগ্রসর কাগজমডার্ন ইন্ডিয়া এবং জাপানের প্রভাবশালী দৈনিক য়োমিউরিশিম্বুন।
এই সফরের সময় রবীন্দ্রনাথ কতিপয় উগ্র জাতীয়তাবাদী রাষ্ট্রীয় নেতৃবৃন্দ, রাজনৈতিক দল ও সংস্থার লক্ষ্য, উদ্দেশ্য ও কর্মতৎপরতার কঠোর সমালোচনা করে জাপানি বুদ্ধিজীবীদের যথেষ্ট বিরাগভাজন হয়েছিলেন। কিন্তু কেন তৎকালীন জাপানি নেতৃবৃন্দ প্রবলভাবে জাতীয়তাবাদী হয়ে উঠেছিলেন সে সম্পর্কে কোনো কিছুই বলেননি। কারণ, যে একটি ছিল এবং সেই কারণেই যে জাপানে মেইজিইশিন বা মেইজি রেস্টোরেশনের বিশেষ প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছিল সে বিষয়ে রবীন্দ্রনাথ কি জানতেন না?
অবশ্যই জানতেন কারণ, তখন সময়টাই ছিল শ্বেতাঙ্গ সাম্রাজ্যবাদী শক্তিকে প্রতিহত করার জন্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জাতিগুলোর তীব্র, উগ্র জাতীয়তাবাদী চেতনার উত্থানের যুগ। জাপান ও ভারতের বাংলাঅঞ্চল তার ব্যতিক্রম ছিল না। ১৯০৪-৫ খ্রিস্টাব্দে উদীয়মান সাম্রাজ্যবাদী শ্বেতাঙ্গ শক্তি রাশিয়ার বিরুদ্ধে ক্ষুদ্র সংকরজাতি জাপানিদের রক্তক্ষয়ী সশস্ত্র বিজয়ই তার প্রমাণ এবং এই বিজয়ে নেহরু, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরসহ প্রথম সারির ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামের পুরোধা-নেতৃবৃন্দ প্রবলভাবে অনুপ্রাণিত এবং নতুন সমরশক্তি জাপানের ভূয়সী প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে উঠেছিলেন! তথাপি, তৎকালীন জাপানের অন্যতম কট্টর জাতীয়তাবাদী, প্রাচ্যবাদী চিন্তাশীল ব্যক্তিত্ব, রাজনৈতিক গুপ্ত সমিতি গেনয়োওশার প্রতিষ্ঠাতা গুরু তোওয়ামামিৎসুরু (১৮৫৫-১৯৪৪) যিনি ছিলেন প্রকাশ্যে ভারতীয় চরমপন্থা জাতীয়তাবাদী বিপ্লবী রাসবিহারী বসু, হেরেম্বলাল গুপ্ত, চিনের ড. সান ইয়াৎ-সেন প্রমুখের জাপানে রাজনৈতিক আশ্রয়দাতা, তারই প্রদত্ত এক জমকালো সংবর্ধনা গ্রহণ করেন রবীন্দ্রনাথ ১৯২৪ সালে।
এই সভায় প্রভাবশালী বুদ্ধিজীবী, রাজনীতিবিদ, উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মকর্তাও উপস্থিত ছিলেন। শুধু তাই নয়, ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে গুরু তোওয়ামার অবদানের প্রতি অকুণ্ঠচিত্তে কৃতজ্ঞতাও প্রকাশ করেছেন। আঞ্চলিক, আন্তর্জাতিক রাজনীতি সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের বিভ্রান্তি ছিল এটাও যেমন সত্য তেমনি, স্বাধীনচেতা কবির মননে ছিল অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত অনন্য এক জাতীয়তাবোধ এবং এশিয়া তথা প্রাচ্যপ্রেম।
এ-দুই ভাবাদর্শই তাদেরকে পরস্পরের কাছাকাছি টেনে এনেছিল। তারা তাদের পথ ও মতের মধ্যে মিল খুঁজে পেয়েছিলেন। এই ভাবাদর্শই তাদেরকে যুগপৎ স্বাদেশিক এবং আন্তর্জাতিক করে তুলেছিল। কাজেই বলা যায়, শিবুসাওয়া এইইচি এবং গুরু তোওয়ামা মিৎসুরুর সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের ঐতিহাসিক সাক্ষাৎ ও সম্পর্ক অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণÑবাহ্যতনানা বিতর্ক থাকা সত্ত্বেও। উল্লেখ্য যে, শিবুসাওয়া ও তোওয়ামা ছিলেন ঘনিষ্ঠ বন্ধু, একই আদর্শের অনুসারী এবং মনীষী, শিল্পাচার্য, প্রাচ্যভ্রাতৃবাদের উদ্গাতা তেনশিন ওকাকুরার (১৮৬৩-১৯১৩) ভাবশিষ্য।
বহু বছরের ব্যবধানেও এই সম্পর্ক মুছে যায়নি আজও। বরং নতুন আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছে বিশেষ-বিশেষ ক্ষণে, যেমন এ বছর নতুন ব্যাংকনোট প্রকাশের ক্ষেত্রে। আরও একাধিক ঘটনা রয়েছে অতীতে। যেমন, ১৯৬১ সালে জাপানে রবীন্দ্রনাথের জন্মশতবর্ষপূর্তি সাড়ে তিন বছর ধরে বিপুল পরিকল্পনাধীনে উদযাপন-যার তুলনা খুঁজে পাওয়া কঠিন; ১৯৮৮ সালে জাপানে বছরব্যাপী ইন্ডিয়া ফেস্টিভেল অনুষ্ঠান, ১৯৯৪ সালে শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথের স্বপ্ন নিপ্পন ভবন তথা জাপান ভবন, ২০০৭ সালে কলকাতার সল্ট লেকে ভারত-জাপান সংস্কৃতি কেন্দ্র : রবীন্দ্র-ওকাকুরা ভবন উদ্বোধন এবং ২০১১ সালে ইন্ডিয়া-জাপান গ্লোবাল পার্টনারশিপ সামিটের সূচনার মধ্য দিয়ে। তাদের এই সম্পর্কই জাপান-ভারত-বাংলাদেশ ত্রিদেশীয় শিক্ষা-সাংস্কৃতিক-আধ্যাত্মিক-রাজনৈতিক-এবং বাণিজ্যিক সম্পর্কের ভিত রচনা করেছে বলাই বাহুল্য।