ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

কদম আলির স্বপ্ন

আয়েশা বেগম

প্রকাশিত: ২১:১২, ১২ জানুয়ারি ২০২৩

কদম আলির স্বপ্ন

কদম আলি বাজারের এক দোকানদার। পান, সিগারেট-বিড়ি ও চা বিক্রি করে

কদম আলি বাজারের এক দোকানদার। পান, সিগারেট-বিড়ি ও চা বিক্রি করে। ছোট দোকান। কিন্তু সব সময়ই ভিড় থাকে। রাত ৮টা পর্যন্ত দোকান করে। হাটবারের দিন মোটামুটি ভালো বিক্রি হয়। একলা মানুষ কদম আলি। তাই তার কোনো অভাব নেই। দোকান থেকে আসার সময় মাছ, তরকারি, শাকসবজি সবকিছু কিনে নিয়ে আসে। এসেই ভাতটা উঠিয়ে দেয়। তারপর কাটাকুটি করে রান্নাটা সেরে হাত-মুখ ধুয়ে আরাম-আয়েশ করে তৃপ্তি সহকারে খায়।
কিন্তু তার একটাই চিন্তা। বিছানায় শুয়ে কদম আলি ভাবে, কবে গোলাপীকে ঘরে নিয়ে আসবে। একটা বউ না হলে আর ভালো লাগছে না। 
গতরাতের ভাবনাগুলো মনে করে কদম আলি মনে মনে হাসে আর গোলাপীর কথা চিন্তা করে। এমন সময় পশ্চিম পাড়ার তৈয়ব আলি চাচা ডাকে, ‘ও কদম আলি, এক কাপ চা দাও। কি চিন্তা করতাছো একলা একলা? দেইখা মনে হয় কিছু ভাবতেছিলা। 
কদম আলি চমকে উঠে বলে, ‘হ। চা দিতাছি অখনই। কেমন আছেন চাচা মিয়া। অসুখ শুনছিলাম। কয়দিন দোকানে আহো নাই। খালি খালি লাগছে।’
‘হ, ঠিকই কইছো। অসুখে পড়ছিলাম। এখন একটু ভালা আছি। পুরাপুরি সুস্থ হইতে আরো দিন কয়েক লাগবো। কিন্তু মিয়া তোমার হাতের চা না খাইলে আর ভালা লাগতাছে না। তাই কোনোরকমে লাঠি ভর দিয়া তোমার দোকানে চইলা আসলাম। তা, তুমি ভালো আছোনি মিয়া? বয়স হয়া যাইতেছে। বিয়া-টিয়া করবা না? শেষে আবার সেইরকম মেয়ে টেয়ে পাইবা না। সমস্যা হয়া যাইবো।’
কথাগুলো শুনে কদম আলি বললো, ‘হ চাচা বিয়া করুম। এইতো দোকানডা বড় কইরা আরও কিছু পয়সাপাতি জমায়া বিয়া করুম ভাবছি। দক্ষিণপাড়ার মজু ব্যাপারীর মাইয়া গোলাপীরে বিয়া করুম চাচা। কেমুন হইবো?’
‘খুব ভালা হইবো। তোমার সংসারে আইলে মেয়েটা সুখেই থাকবো।’
কদম আলি এক কাপ চা ধরিয়ে দেয় ভৈয়ব আলিকে। কদম আবার ভাবে, ‘আইজকাই গোলাপীদের বাড়ি যামু। প্রায় মাসখানিক হয়া গেল গোলাপীকে দেখি না। মনডা আনচান করতছে।’
একদিন দুপুরের দিকে কদম আলি গোলাপীদের বাড়ি গেল।
গোলাপীর মা বলল, ‘কি ব্যাপার কদম আলি। তোমারে যে অনেকদিন দেখি না।’ 
‘হ চাচী ঠিকই কইছেন। আসি আসি কইরা দেরি হয়া যায়। গোলাপী বাড়িত নাই চাচী?’
‘হ আছে। তয় মাইয়া আমার বড় হইছে। যখন তখন যার তার সামনে ওরে ডাকি না। বাইরেও যায় না। বিয়ার কথাবাতা হইতেছে তো, তাই।’
‘আমার সামনে আবার শরম কিসের। আমি তো আপনাগোর নিজের লোকের মতই। তাছাড়া আমার সামনেই গোলাপী বড় হয়া উঠলো। কই গোলাপী সামনে আহো না তোমারে দেখি। 
গোলাপীও মনে মনে কদম আলিকে পছন্দ করে। সে ধীরে ধীরে কদম আলির সামনে এসে দাঁড়ালো। কদম আলি গোলাপীর মুখের দিকে তাকালো। গোলাপীও কদম আলির দিকে তাকিয়ে ফিক করে হেসে দিল। তারপর লজ্জা পেয়ে এক দৌড়ে ঘরের ভিতর চলে গেল।
হঠাৎ গোলাপীর মা কদম আলিকে জোরে ডাক দিল। কদম আলি থতমত খেয়ে বলল, ‘চাচী, একটা কথা কইতে চাইছিলাম। তুমি যদি রাজি থাকো তোমার গোলাপীরে আমি বিয়া করবার চাই।’
‘ঠিক আছে। তুমি যখন কইলা ভাইবা দেখি। আরো দুই-এক জায়গা থাইকা ভালা ভালা প্রস্তাব আসতাছে। কি যে করি। পরে তোমারে জানামু। কেমুন?’
‘না চাচি। তুমি অমত কইরো না। আমি গোলাপীরে ভলাবাসি চাচি। ওরে না পাইলে আমার এতোদিনের
স্বপ্ন দেখাটা ভাইংগা চুরমার হয়া যাইব চাচি। ও চাচি তোমার পায়ে পড়ি। তুমি না কইরো না। জীবনে  গোলাপী ছাড়া আর কারো কথা ভাবি নাই।’
‘আরে কি কর, কি কর। পাও ছাড়ো। পা ধরন লাগবো না।  কপালে যদি লেখা থাকে তয় হইবো।’
‘ঠিক আছে চাচি। তাইলে অখন আমি যাই। আমার কথাডাও আরও একটু ভাইবো চাচি। আমার কোনো অভাব নাই। চাচি, গোলাপীরে আমি সুখেই রাখুম। তুমি ভাইবো না। গোলাপী রানীর মতো থাকবো। ওরে কোনো কষ্ট পাইতে দিমু না।’
কদম আলি গোলাপীর মায়ের কথায় বেশি সন্তুষ্ট হলো না। আত্মাটা ঢাস ঢাস করছে তার। অনেকটা নতমুখে কদম আলি ঘরে ফিরলো। ঘরে এসে ধপাস করে বিছানায় বসে পড়লো। 
সকালে উঠে ফজরের নামাজ পড়ে ভাত উঠিয়ে দিল। ভাতের সঙ্গে দুইটা আলু সিদ্ধ দিল। আলু ভর্তা দিয়ে ভাত খাবে সে। যেই কথা সেই কাজ। ঘর থেকে বের হতে হতে কদম আলির এগারোটা বাজলো। অনেকদিন পর মিয়া ভাইয়ের বাড়ি যাচ্ছে। তাই ছেলেমেয়েদের জন্য কিছু মিষ্টি কিনলো। সব ভুলে মনটা খুশি করে মিয়া ভাইয়ের বাড়ি এসে পৌঁছালো। দুই ভাই কোলাকুলি করলো। দুপুরের খাওয়ার পর কদম আলি টাকা ধারের কথা বললো। মিয়া ভাই না করলো না। বলল, ‘টাকা ধার নিবা ভালা কথা। একটু তাড়াতাড়ি দিবার চেষ্টা কইরো। সামনে কোরবানি ঈদের পর বড় মাইয়ার বিবাহের দিন ঠিক হইছে। তখন টাকা লাগবো।’
‘ঠিক আছে মিয়া ভাই। কোরবানি ঈদের আরো ছয় মাস বাকি আছে। এর আগেই আমি তোমার টাকা দিয়া দিমু ইনশাআল্লাহ।’
টাকা-পয়সা নিয়ে কদম আলি বিকেলেই রওনা হলো বাড়ির দিকে। সন্ধ্যা লাগে লাগে সে বাড়ি এসে পৌঁছাল। মাগরবের নামাজটা পড়ে রান্না চড়িয়ে দিল। বেশি রাত না করে খেয়ে-দেয়ে ঘুমিয়ে পড়লো কদম আলি।
সকালবেলা রোজকার মতো দোকান খুলে বসলো কদম আলি। ধীরে ধীরে লোকজনের ভিড় হয়ে গেল তার দোকানে। এমন সময় ওদের একজন বলল, ‘শুনছেননি আপনারা? দক্ষিণ পাড়ার মজু বেপারীর মাইয়া গোলাপীর বিয়া ঠিক হয়া গেছে করিম শেখের পোলা মুসা শেখের লগে।’ 
কে একজন বললো, ‘ভালাই হইবো। করিম শেখের জমি-জমা অনেক। কিন্তু আবার শেখের পো অনেক কিপটা। তিনটা বিয়া করছে। একটা কাজের মানুষ রাখে না। বউরাই সব কাজ করে। সংসারে খাটতে খাটতে ওদের যা তা অবস্থা হয়। দুই দিন পর পর বউগুলা অসুখে পড়ে। বেপারীর মেয়ের বিয়া কি হইলে কি জানি কি অবস্থা করে।’ 
কেউবা আবার বললো, ‘ছেলের বউয়ের সাথে এরকম নাও করতে পারে।’

কথাগুলো শুনে কদম আলির মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো। মনে মনে বলল, ‘কয় কি রে! গোলাপীর বিয়া ঠিক। দুইদিন আগেই তো ওগোর বাড়ি গেছিলাম। কই, চাচি তো আমারে তখন কিছুই বললো না। আমারে ফাঁকি দিল! অবহেলা করলো! বুঝছি, লোভে পড়ছে চাচি। ভাবছে জমিদার বাড়িতে বিয়া দিলে মাইয়া তার সুখে থাকবো।’
মানুষ ভাবে এক। হয় আর এক। কদম আলি এই ঠা-া শীতের মধ্যেও ঘামতে শুরু করলো। মনে মনে বললো, ‘না। এইডা কিছূতেই হইতে দেওন যাইবো না। গোলাপী আমার। ওরে আমিই বিয়া করুম। ওরে আমি ভালোবাসি। ওরে না পাইলে সব স্বপ্ন আমার স্বপ্নই থাইকা যাইবো।’
একজন-দুইজন করে যেতে যেতে দোকানের ভিড়টা একটু হাল্কা হলো। কদম আলি সন্ধ্যায়ই দোকান বন্ধ করে বাড়ির দিকে রওনা দিল। গোলাপীদের বাড়ি পার হয়েই কদম আলির বাড়িতে যেতে হয়। একবার আড়চোখে গোলাপীদের বাড়ির দিকে তাকিয়েই চোখ ফিরিয়ে নিল। ওদের বাড়িতে গিয়ে লাভ নেই। কদম আলির যা ক্ষতি তা তো হয়েই গেছে। তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে বাড়িতে এলো। না খেয়েই শুয়ে পড়লো। 
পরদিন সকালে কদম আলি বিছানা ছেড়ে উঠতে পারে না। জ্বরে তার কাঁপুনি উঠে গেছে। সন্ধ্যার দিকে জ্বর বেড়ে গেল। রাতে বারান্দায় বসে কলস থেকে পানি নিয়ে মাথায় পানি ঢাললো। কি আর করবে। সাহায্য করার মতো তার তো কেউ নেই! মাথাটা গামছা দিয়ে কোনোমতে মুছে আবার বিছানায় শুয়ে পড়লো। রাগে, দুঃখে, অপমানে কদম আলি ছটফট করতে লাগলো। মনের কথা কাকে বলবে ভেবে পেল না। সরাদিন খাওয়া-দাওয়া নেই, শরীর দুর্বল হয়ে গেল।
হঠাৎ বারান্দায় কিসের শব্দ শোনা গেল। কদম আলি সজাগ হলো। এই রাতের বেলা কে এলো? কদম আলি জিজ্ঞাসা করল, ‘কে? বাইরে কে?’
কোনো আওয়াজ নেই।
কদম আলি বিছানা থেকে নেমে ধীরে ধীরে দরজাটা খুলে বারান্দায় গেল। দেখল কে একজন চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে বাঁশের খুঁটি ধরে। আবছা আবছা অন্ধকার। ভালো করে দেখা যায় না। কদম আলি আবার বললো, ‘কে তুমি? সাড়া দাও না ক্যান? মাথার ঘোমটা ফেলায়া দাও না ক্যান?’
‘আমি গোলাপী। আস্তে কথা কন। কেউ আবার শুইনা ফেলাইব। আমি মায়েরে না জানায়া চুপ কইরা পলায়া আইছি। আপনি না আমারে বিয়া করবেন কইছেন। মা অন্য জায়গায় আমার বিয়া ঠিক করছে। তাই পলায়া আপনার কাছে চইলা আইছি। আমি আপনারেই বিয়া করুম। আপনারে ছাড়া আর কাউকে বিয়া করুম না। আমি মনে মনে আপনারেই ভালোবাসি।’
কথাগুলো শুনে কদম আলি থর থর করে কাঁপতে লাগলো। কিছু বলার আগেই তখনই কদম আলি জ্ঞান হারিয়ে ধপাস করে বারান্দায় পড়ে গেল। কতক্ষণ পরে ধীরে ধীরে যখন চোখ মেলে তাকালো, দেখলো সেখানে গোলাপী নাই। কদম আলি উঠে বসতে পারছে না। অনেক কষ্টে যদিও উঠে বসলো, কিন্তু গোলাপীর মায়ের কাছে যাওয়ার মতো শক্তি সে পেল না।

কদম আলি আবার ভাবলো, বিয়া ভাঙলে গ্রামের সবাই তারে নিন্দা করবে। সবাই তারে ভালো মানুষ বলেই জানে। তাদের কাছে কদম মুখ দেখাতে পারবে না। তবে অল্পক্ষণের মধ্যেই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললো কদম আলি। এই গ্রামে সে আর থাকবে না। মিয়াভাইয়ের শ্বশুরবাড়ি বলাশপুর গ্রামে। সেখানেই যাবে। ওখানে গিয়ে দোকান করেই খাবে। ধীরে ধীরে কষ্ট করে উঠে সে ঘরের ভেতরে গেল। মিয়া ভাইয়ের টাকাগুলো নিল। কিছু কাপড়-চোপড় একটা ব্যাগে নিল। নিজের কিছু টাকা ছিল সেগুলোও নিল। 
ঘর থেকে বের হলো কদম আলি। মায়াভরা গ্রামখানির চারদিকে চোখ বুলালো। রাতের আঁধারে সে কষ্ট করে ধীরে ধীরে হাঁটতে লাগলো। মনে হতে লাগলো এই গ্রামেই তার জন্মকর্ম। বাবা এই চায়ের দোকান চালাতো। একদিন বাবা-মা মারা গেল। কদম আলি একা হয়ে গেল। বাবার মতো চায়ের দোকানের মালিক হলো। মা-বাবার ভিটেমাটি ছেড়ে যেতে তার কষ্ট হচ্ছিল। কি করবে আর। কপালে এই লেখা ছিল। ভাবতে ভাবতে দোকানটার সামনে এসে দাঁড়ালো কদম আলি। দোকানে ক্যাশ বাক্সের টাকার কথা মনে পড়লো।

কিন্তু অভিমান করে কদম আলি কিছুই নিল না। সে ভাবলো ভোর হওয়ার আগেই তাকে এ গ্রাম ছাড়তে হবে। তাই সে আর দেরি না করে সামনের দিকে হাঁটতে শুরু করলো। গোলাপীর কথা মনে করে কদম আলির চোখ দিয়ে পানি পড়তে লাগলো। তার স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে গেল। সবই তার ভাগ্য। এরপর থেকে গ্রামের মানুষ আর কোনদিন কদম আলিকে দোকান খুলতে দেখেনি। কেউ বুঝতে পারলো না তাদের সবার প্রিয় মানুষ কদম আলির কি হয়েছে? কোথায় যেতে পারে? তার বাড়িঘর, দোকানপাট সব পেছনে পড়ে রইলো। কদম আলি আর কোনোদিন ফিরে এলো না তার জন্মভূমি মায়াভরা ফুলপুর গ্রামে।

×