ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

বিশ্লেষণে জীবনানন্দ পাঠ

লাবণী মণ্ডল

প্রকাশিত: ২২:১৭, ৮ ডিসেম্বর ২০২২

বিশ্লেষণে জীবনানন্দ পাঠ

জীবনানন্দ

বাংলা সাহিত্যে মধুসূদন-রবীন্দ্রনাথ-নজরুলের প্রভাব অপরিসীম। তবে ১৯৩০-এর দশকে ইউরোপীয় শিল্প-সাহিত্য ও বিজ্ঞানচর্চার প্রভাবও খুব স্পষ্ট হয়। এর প্রভাবে নতুন এক ধারা গড়ে উঠে। কার্যত প্রযুক্তির বিকাশ ও যন্ত্রনির্ভরতা তৎকালীন সমাজে এক অস্থিরতা, দ্বন্দ্ব ও নিঃসঙ্গতার ধারণা বাস্তব করে। এ বেদনাবোধ ও সংকটই জীবনানন্দের কবিতার মূলভিত্তি। প্রযুক্তির অতি-নির্ভরতার এ যুগে এই বিচ্ছিন্নতার বোধ আমাদের মাঝে আরও বেশি ক্রিয়াশীল। যে কারণে এ সময়ে জীবনানন্দ আরও বেশি বর্তমান।
দুর্বোধ্য শূন্যতার কবি জীবনানন্দ দাশের উপমা, শব্দচয়নের মাঝে রয়েছে এক রহস্যের চাদর। তার কবিতা যেন এনকোড করা মেসেজ, ডিকোড করলেই কেবল এর প্রকৃত অর্থ ধরা দেবে! আর ওই দুর্বোধ্যতা এড়িয়ে জীবনানন্দ পাঠের ক্ষেত্রে সাহিত্যিক বেগম আকতার কামাল রচিত ‘জীবনানন্দ : কথার গর্বে কবিতা’ বইটি বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ।
জীবনানন্দ কেমন করে কবিতা সৃষ্টি করেন? শব্দকে সন্ধান করে নেন? বুদ্ধদেব বসুর ‘কবিতা’ পত্রিকায় (বৈশাখ, ১৩৪৫ সাল) প্রকাশিত ‘কবিতার কথা’ শীর্ষক লেখায় তিনি ব্যাখ্যা করেছেন কাব্যজন্মের প্রক্রিয়াকে, তাঁর কবিতায় বহুবর্ণের পরিচয়ের নারীরা অন্বিষ্টরূপে থাকলেও কোনো কাব্যলক্ষ্মী বা অ্যানিমা-সত্তা হয়ে নারী প্রেরণা জাগায়নি। বরং অন্য-এক ক্রিয়াশীলতার মধ্যে তিনি কবিতাসৃষ্টিক্রিয়াকে দেখেন।
জীবনানন্দের মতে, ‘সৃষ্টির ভিতর মাঝে মাঝে এমন শব্দ শোনা যায়, এমন বর্ণ দেখা যায়, এমন আঘ্রাণ পাওয়া যায়, এমন মানুষের বা এমন অমানবীয় সংঘাত লাভ করা যায়—কিংবা প্রভূত বেদনার সঙ্গে পরিচয় হয় যে মনে হয় এই সমস্ত জিনিসই অনেকদিন থেকে প্রতিফলিত হয়ে কোথায় যেন ছিল; এবং ভঙ্গুর হয়ে নয়, সংহত হয়ে, আরও অনেকদিন পর্যন্ত, হয়তো মানুষের সভ্যতার শেষ জাফরান রৌদ্রালোক পর্যন্ত, কোথাও যেন রয়ে যাবে; এই সবের অপরূপ উদ্গিরণের ভিতরে এসে হৃদয়ে অনুভূতির জন্ম হয়, নীহারিকা যেমন নক্ষত্রের আকার ধারণ করতে থাকে তেমনই বস্তুসঙ্গতির প্রসব হতে থাকে যেন হৃদয়ের ভিতর; এবং সেই প্রতিফলিত অনুচ্চারিত দেশ ধীরে ধীরে উচ্চারণ করে ওঠে যেন, সুরের জন্ম হয়; এই বস্তু ও সুরের পরিণয় শুধু নয়, কোনো কোনো মানুষের কল্পনা মনীষার ভিতর তাদের একাত্মতা ঘটে-কাব্য জন্ম লাভ করে।’
জীবনানন্দের কবিতায় যেসব নারীমূর্তি গড়েছেন তারা আধুনিক, তবে তাঁর কল্পনামনীষার স্পর্শে তারা শব্দটির সাথে সর্বাগ্রে জড়িত তিরিশের এই কবিগণের মধ্যে জীবনানন্দ দাশ সম্ভবত সবচেয়ে বেশি আলোড়িত-আলোচিত। রবীন্দ্রনাথ-মধুসূদনকে ব্যতিরেকে, বাংলা সাহিত্যে একজন: জীবনানন্দ দাশ, যিনি বিবর্তন-বিবর্ধন ঘটিয়েছেন বাংলা কবিতার।
অলৌকিক, দুরূহ ও দুর্বোধ্য। নামের সঙ্গে পদবী থাকলেও অনেক নায়িকাই কবি-কল্পিত। অর্থাৎ কবি-সৃজিত  ‘বনলতা সেন’, ‘সুরঞ্জনা’, ‘শেফালিকা বোস’, ‘অরুণিমা সান্যাল’, ‘মৃণালিনী ঘোষ’ কখনো লৌকিক, আবার কখনো অলৌকিক, কখনো বা ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য থেকে অতীন্দ্রিয়লোকের বাসিন্দায় পরিণত হয়েছে।
প্রেমিকা-প্রেয়সী বিষয়ে কবি নিজেই দুর্গম-দুর্জ্ঞেয় রহস্যময়তা গড়ে তুলেছেন। জীবনানন্দের কাব্যপাঠে উপলব্ধি করা যায় যে, তাঁর কবিচিত্ত সর্বদা পুনরুত্থানের আকাক্সক্ষায় বির্মষ ও ব্যথিত। তিনি ব্যক্তিগত জীবনের আত্মমগ্নতা, বিষণ্ণতা, হতাশাবোধ, ক্লান্তি, বিচ্ছিন্নতা, মৃত্যুচেতনা  ইত্যাদি অনুষঙ্গকে কাব্যশিল্পে গেঁথেছেন সচেতনভাবে। জীবনানন্দ দাশ তাঁর কাব্যলোকে অতীন্দ্রিয় চেতনা একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ হিসেবে বিবেচিত  হয়েছে। প্রাচীন-মধ্যযুগের প্রথাগত কবিতাকে বিদায় দিয়ে তিনি সৃষ্টি করেছেন অসামান্য একাধিক কবিতা; যা বাংলা কবিতাকে বিশ্বজনীন করে তুলেছে।
‘জীবনানন্দ : কথার গর্বে কবিতা’ বইটি প্রকাশ করেছে কথাপ্রকাশ। এটি জীবননানন্দের কবিতা সম্পর্কে বোধ তৈরি করবে এবং নিরেট মূল্যায়নের সম্মুখীন করবে।

×