ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

ফুটবল, সাহিত্য ও বাঙালি জীবন

মো. ঈমাম হোসাইন

প্রকাশিত: ২১:২৭, ৮ ডিসেম্বর ২০২২

ফুটবল, সাহিত্য ও বাঙালি জীবন

বিংশ শতাব্দীর শুরুতে ফুটবল এত জনপ্রিয় খেলায় পরিণত হয় যে, সাহিত্যে খেলার প্রসঙ্গ এলেই ফুটবলের কথা উঠে আসে

ফুটবল ভিনদেশী খেলা হলেও গত দুই শতাব্দী ধরে নানা রাজনৈতিক, সামাজিক-সাংস্কৃতিক কারণে এই ভারতবর্ষের মানুষের মনে, মগজে ও বাস্তব অনুশীলনে জায়গা করে নেয়। সঙ্গতকারণে বাঙালিরা এ ক্রীড়াচর্চায় নিজেদের সামিল করেন। ফুটবল যেমন বাঙালি সংস্কৃতির অন্যতম অনুষঙ্গে পরিণত হয়েছে, তেমনিভাবে এটি আমাদের বাংলা সাহিত্যেও অনিবার্যভাবে প্রবেশ করে।
বিংশ শতাব্দীর শুরুতে ফুটবল এত জনপ্রিয় খেলায় পরিণত হয় যে, সাহিত্যে খেলার প্রসঙ্গ এলেই ফুটবলের কথা উঠে আসে। রবীন্দ্রসাহিত্যে প্রথম ফুটবলের উল্লেখ পাওয়া যায় ‘প্রজাপতির নির্বন্ধ’ উপন্যাসে (১৯০৪)। চতুর্থ পরিচ্ছেদে উপন্যাসের অন্যতম নায়ক বিপিন সম্পর্কে লেখাই আছে যে ফুটবল খেলে। ১৯৩০ সালে তার প্রকাশিত ‘সহজ পাঠ’ এর প্রথম ভাগের ‘ষষ্ঠপাঠ’ অংশে আছে- ‘ঐ যে আসে শচী সেন, মনি সেন, বংশী সেন।

আর ঐ যে আসে মধু শেঠ আর ক্ষেতু শেঠ। ফুটবল খেলা হবে খুব।’ মনে রাখা ভালো কলকাতার মোহনবাগান ক্লাবের প্রথম অধিনায়কের নাম ‘মনি সেন’। ১৯৩২ সালে প্রকাশিত ‘পুনশ্চ’ কাব্যগ্রন্থের ‘ক্যামেলিয়া’ কবিতায় রয়েছে- ‘আমার নাম আছে ফুটবল খেলায়/বেশ চওড়া গোছের নাম’ এবং ‘ফুটবল সর্দারের ‘পরে তাই তার এত ভক্তি’। এ কবিতার মূল চরিত্রটি ফুটবল খেলত বোঝাই যাচ্ছে। ‘বর্তমান যুগ (১৯৩৪)’ প্রবন্ধে তিনি আশ্রমবাসীদের উদ্দেশে লিখেছেন, ‘শুধু পড়া মুখস্থ করে পরীক্ষা পাস করে ফুটবল খেলে এত বড় একটা জীবনকে নিঃশেষ করে দেবে?’
জাতীয় কবি নজরুলের উদ্দাম তারুণ্যে ছিল চারটি নেশা- আম পাড়া, নদীতে সাঁতার কাটা, ফুটবল খেলা ও মাছ ধরা। তিনি কখনো কখনো দাবা খেলায়ও মেতে উঠতেন। তবে নজরুল ফুটবল খেলতে বেশি ভালোবাসতেন। নজরুলের ফুটবলও সাহিত্য প্রতিভার মতোই সে সময় সর্বত্রই ছড়িয়ে পড়েছিল। জনশ্রুতি আছে নজরুলের এমন ফুটবল খেলার ঝোঁক ছিল যে, খেলায় নেমে ইংরেজ ছেলেদের সুযোগ পেলে তিনি কিল, চড়, ঘুষি মারতে দ্বিধাবোধ করতেন না।

ইংরেজদের সম্পর্কে তার বিতৃষ্ণা চিরকাল। আর কবির কাছে ফুটবল এত প্রিয় হয়ে ওঠে যে, ফুটবলকে তিনি স্বাধীনতার প্রতীক হিসেবে চিহ্নিত করে লেখেন কবিতা। ‘জোর জমিয়েছে খেলা’ নামের এ কবিতা সে সময় বিখ্যাত পত্রিকা ‘দৈনিক নবযুগ’ এ প্রকাশিত হয়। কবি এ কবিতায় স্বাধীনতাকে নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে কঠিন ব্যাঙ্গে মেতে ওঠেন।
প্রমথ চৌধুরী ১৯১৫ সালে রচিত তার ‘সাহিত্যে খেলা’ নামের এক প্রবন্ধে বলেছিলেন, ‘মানুষের দেহমনের সকল প্রকার ক্রিয়ার মধ্যে ক্রীড়া শ্রেষ্ঠ, কেননা তা উদ্দেশ্যবিহীন।’ ওই প্রবন্ধে তিনি ‘উদ্দেশ্যবিহীন’ বলতে আনন্দদায়ক বোঝাতে চেয়েছেন। তার মতে, খেলা উদ্দেশ্যবিহীন এবং আনন্দদায়ক বলেই কলকাতার টাউন হলের দেশহিতকর বক্তৃতার চেয়ে ‘গড়ের মাঠে ফুটবল খেলা দেখতে’ মানুষ বেশি যায়। খেলা সম্পর্কে, বিশেষত ফুটবল খেলা সম্পর্কে, প্রমথ চৌধুরীর এই বক্তব্য খুবই সরল এবং বাছবিচারহীন বলেই মনে হয়।
বাংলামুলুকে ফুটবল খেলা ঢুকেছে মূলত ইংরেজ উপনিবেশকদের হাত ধরে। ইংরেজ রাজ-কর্মচারীরা তাদের বিকেল বেলা কাটানোর জন্য নিজেদের মধ্যে এ খেলা খেলত। এক এলাকার রাজ-কর্মচারীরা অন্য এলাকার রাজ-কর্মচারীদের সঙ্গে মাঝেমধ্যে প্রতিযোগিতারও আয়োজন করতেন। উনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে কলকাতা ও ভারতের অপরাপর অঞ্চলে এই খেলার খেলোয়াড় এবং দর্শক দুটোই ছিল ইংরেজ।

ক্রমে এর সঙ্গে যুক্ত হয় বাংলার ইংরেজ-সুবিধাভোগী অভিজাত বাঙালি শ্রেণি। আরও পরে দর্শক হিসেবে ‘সাধারণ মানুষের’ সমাগম ঘটতে থাকে। তবে এই ‘সাধারণ’ বলতে নিশ্চয়ই খেটে খাওয়া মানুষ না। এই ‘সাধারণের’ও একটা শ্রেণি-পরিচয় ছিল। তারা অবশ্যই সেই শ্রেণি, যারা এ দেশে ইংরেজ শাসনের স্থানীয় খুঁটি হিসেবে কাজ করত অথবা পড়ালেখা শিখে যারা কালো চামড়ার ইংরেজ হয়ে উঠতে চাইত।
ফুটবল বাঙালি জাতীয়তাবাদকে যেমন শাণিত করেছে তেমনি বিতর্কও কম তৈরি করেনি।
শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তার শ্রীকান্ত (১৯১৭) উপন্যাসে ফুটবল খেলার এক বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন, ‘ইস্কুলের মাঠে বাঙালি ও মুসলমান ছাত্রদের ফুটবল ম্যাচ। সন্ধ্যা হয় হয়। মগ্ন হইয়া দেখিতেছি। আনন্দের সীমা নাই। হঠাৎ ওরে বাবা একি রে! চটাপট্ শব্দ এবং মারো শালাকে, ধরো শালাকে!...পাঁচ-সাতজন মুসলমান-ছোকরা তখন আমার চারদিকে ব্যূহ রচনা করিয়াছে পালাইবার এতটুকু পথ নাই।’ (শ্রীকান্ত, প্রথমপর্ব, পৃ.২) শরতের এই ‘বাঙালি’ এবং ‘মুসলমান’ দল বিভাজন উত্তরকালে ব্যাপক বিতর্কের জন্ম দেয়।
ফুটবল শহরে এবং গ্রামবাংলার আনাচে-কানাচে প্রবেশ করলেও এ কথা অনস্বীকার্য যে অবিভক্ত বাংলায় ফুটবল ছিল মূলত শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণির আকর্ষণীয় খেলা। ফুটবল যে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণির খেলা ছিল তা জসীমউদ্দীনের হাসু (১৯৩৮) কাব্যগ্রন্থের ‘ফুটবল খেলোয়াড়’ কবিতা দেখলেই বোঝা যায়। এ কবিতায় দেখা মেলে কবি জসীমউদ্দীনের কাব্যের মধ্যে সবচেয়ে ‘স্মার্ট’ নায়ক’ ইমদাদ হকের। সোজন, রূপাই নামের বিপরীতে এই নাম ‘স্মার্ট’ আর নির্দিষ্ট শ্রেণি-চিহ্নিত তো বটে।

তৎকালের শিক্ষিত তরুণদের মধ্যে ফুটবল কী এক তীব্র উন্মাদনা ছড়িয়েছিল তার এক বিশ্বস্ত ছবি পাওয়া যায় এ কবিতায়। ইমদাদ হককে সকালবেলা গিঁটে গিঁটে মালিশ আর সেঁক দিতে দিতে মেসের চাকর ‘লবেজান’ হয়ে যায়। সবাই ভাবে ইমদাদ ‘ছমাসের তরে পঙ্গু যে হল হায়’। কিন্তু সন্ধ্যাবেলায় দেখা গেল ‘বাম পায়ে বল ড্রিবলিং করে ডান পায়ে মারে ঠেলা,/ভাঙা কয়খানা হাতে-পায়ে তার বজ্র করিছে খেলা।’
সমকালের শিক্ষিত তরুণদের মধ্যে ফুটবল কী এক তীব্র উন্মাদনা ছড়িয়েছে তার চিত্র উঠে আসে বিশ্বকাপ চলার মৌসুমে শহর কিংবা গ্রামের দালান, বাড়িঘরে ভিন দেশের পতাকা ঝুলানো, মিছিল কিংবা প্রিয়দলের জার্সি পরা দেখে। বর্তমানে খেলার জগতে দল, পতাকা জার্সির জন্য আপন বন্ধুও ভাগ হয়ে যায়। আলাদা হয়ে যায় পাড়া-মহল্লা।

খেলার প্রেম কখনো কখনো নারী পুরুষের প্রেমকেও হার মানায়। বিশেষ করে জার্সির প্রেম চিরচেনা প্রেমের মতোই ভয়ঙ্কর! যেখানে প্রিয় খেলোয়াড়ের দল পরিবর্তন বা জার্সি পরিবর্তন মানতে পারে না ভক্তরা। ভক্তের হাতে ব্যানার ওড়ে, বাতাস ভারি হয় তাদের চেঁচামেচিতে, স্লোগানে, তাদের ফোটানো বাজি-পটকা-আতশবাজিতে আকাশ ভরে ওঠে, মনে হয় যেন ভালোবাসার বৃষ্টি।
ফুটবল পেশিশক্তির খেলা, আনন্দ দেয়, ক্রীড়া নৈপুণ্য দেখায়। এটা যেমন সত্যি, তেমনি এও সত্যি যে ফুটবলের সাংস্কৃতিক, ভৌগোলিক, রাজনৈতিক পরিচয় আছে। আছে সাহিত্যের অন্দরমহলে হানা দেওয়ার মতো অসামান্য ক্ষমতা। পেশিশক্তি পরীক্ষার এ খেলার মধ্যে আছে ইতিহাসের সরল-জটিল সব অলিগলি আর আলো-আঁধার, বিশ্ব রাজনীতিও।

×