আলাউদ্দিন আল আজাদ
ভাষাসংগ্রামী ও মুক্তিযোদ্ধা আলাউদ্দিন আল আজাদ। ব্যক্তিগত পেশাজীবনে ছিলেন সরকারী কলেজের শিক্ষক। তার গল্পগ্রন্থ ‘জেগে আছি’। অনন্য এই গল্পগ্রন্থের অসাধারণ একটি গল্প ‘সৃষ্টি’ শিক্ষক জীবনকে অবলম্বন করে। শিক্ষক জীবনে রয়েছে যেমন মুগ্ধতা, অনেক প্রাপ্তির গল্প, সেইসঙ্গে রয়েছে অভাব অনটন না পাওয়া ও বৈষম্যের বিচিত্র কাহিনীও। একজন শিক্ষককে গ্রামীণ রাজনীতির পাতি নেতাদের আক্রোশে কিভাবে হেনস্তা, অপমানিত ও নির্যাতিত হতে হয় সে কাহিনীই এই গল্পে বিধৃত।
আলাউদ্দিন আল আজাদের যৌবনের প্রারম্ভকালে লেখা অসাধারণ সাতটি গল্প নিয়ে ১৯৫০ সালে প্রকাশিত হয়েছিল ‘জেগে আছি’ গল্পগ্রন্থ। গল্পকার আজাদ সম্পর্কে বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত গ্রন্থে লেখা হয়েছিল, ‘আলাউদ্দিন আল আজাদ দেশকাল ও সমাজসচেতন ছোট গল্পকার। শ্রেণী সংগ্রাম ও সংগ্রামের পরই সাফল্য এই নীতিতে স্থিরবিশ্বাসী আজাদকে আমরা প্রত্যক্ষ করেছি তার রচনাগুলোতে।’ আলাউদ্দিন আল আজাদ তার সমকালে যে বৈষম্যপূর্ণ নিয়ম নীতি, শিক্ষকের উপর গ্রামীণ স্থানীয় অবৈধ দখলদার সমাজপতি বা রাজনীতিবিদদের মতো মানুষদের পক্ষ থেকে নির্যাতন পর্যবেক্ষণ করেছিলেন সে সব নিয়েই লিখেছিলেন এই গল্পটি।
তিনি হয়তো ভেবেছিলেন গল্পের ফলে মানুষ সচেতন হবে, সমাজে এক ধরনের শান্তি ও সম্মান ফিরে আসবে। শিক্ষকগণ সামাজিক নিরাপত্তা পাবেন, সম্মান পাবেন, পাবেন আর্থিক বৈষম্যমুক্ত জীবন। রাজনীতি, অর্থনীতি সাহিত্যে অনেক এগিয়েছে দেশ, আমাদের সমাজ সচেতনতা, বিবেকবোধ সে তুলনায় কতটা জেগেছে সে প্রশ্নই রয়েই গেছে।
আলাউদ্দিন আল আজাদ ১৯৩২ সালের ৬ মে নরসিংদী জেলার রায়পুরা উপজেলার রামনগর গ্রামে একটি মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৪৭ সালে প্রবেশিকা এবং ১৯৪৯ সালে উচ্চ মাধ্যমিকে উত্তীর্ণ হন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ থেকে ১৯৫৩ সালে অনার্স এবং ১৯৫৪ সালে মাস্টার ডিগ্রী অর্জন করেন। এরপরই পেশাগত জীবনে সরকারী কলেজের অধ্যাপনা পেশায় যুক্ত হন তিনি।
তিনি নারায়ণগঞ্জের তোলারাম কলেজ (১৯৫৫), ঢাকা জগন্নাথ কলেজ (১৯৫৬-৬১), সিলেট এমসি কলেজ (১৯৬২-৬৮) এবং চট্টগ্রাম সরকারী কলেজে (১৯৬৪-৬৭) অধ্যাপনা করেন। ঢাকা কলেজের অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করেছেন এক বছর (১৯৭৪-৭৫)। পরবর্তীকালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক হিসেবে অবসর গ্রহণ করেন। মস্কোর বাংলাদেশ দূতাবাসে সংস্কৃতি উপদেষ্টা, সংস্কৃতিবিষয়ক বিভাগ ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়েও গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন আলাউদ্দিন আল আজাদ।
বহুমাত্রিক লেখক ড. আলাউদ্দিন আল আজাদ ছিলেন বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতির একজন পুরোধা ব্যক্তি। তিনি ছিলেন একাধারে ভাষাসৈনিক, মুক্তিযোদ্ধা, কবি, কথাসাহিত্যিক, ঔপন্যাসিক, সমালোচক, শিক্ষাবিদ। সাহিত্যের প্রায় প্রতিটি শাখায় ছিল তার সার্থক বিচরণ। আলাউদ্দিন আল আজাদের সাহিত্যকর্ম বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত ও প্রশংসিত।
কর্মজীবনের পুরোটা সময় সাহিত্যের দক্ষ অধ্যাপক এবং সংস্কৃতির সেবক হিসেবেই কেটেছে তার। প্রগতিশীল রাজনৈতিক চিন্তা-চেতনা ও সংগ্রামী কর্মতৎপরতার কারণে একাধিকবার কারাবরণ করেছেন তিনি।
মহান ভাষা-আন্দোলনে তিনি ছিলেন সক্রিয় কর্মী। একুশে ফেব্রুয়ারি রাজপথ রঞ্জিত হওয়ার পর তারই উদ্যোগে প্রকাশিত হয় একুশের প্রথম বুলেটিন। প্রথম শহীদ মিনার নিয়ে তিনিই প্রথম রচনা করেন কালজয়ী কবিতা ‘স্মৃতির মিনার’। যেখানে লিখেন তিনি-
স্মৃতির মিনার ভেঙেছে তোমার?
ভয় কি বন্ধু
আমরা এখনো চার কোটি পরিবার খাড়া রয়েছি তো
যে-ভিত কখনো কোনো রাজন্য পারেনি ভাঙতে।’
মুক্তিযুদ্ধকালীন দিনলিপি নিয়ে রচনা করেছেন এক অনন্য দলিল ‘ফেরারি ডায়েরি’। মোটকথা, তার জীবন ও সৃষ্টি আমাদের সাহিত্য-সংস্কৃতির উল্লেখযোগ্য সম্পদ।
সত্তরাধিক বছর পূর্বে ‘সৃষ্টি’ গল্পে আলাউদ্দিন আল আজাদ যা লিখেছিলেন- হেড প-িত মাহমুদ, তিন বছর পূর্বে তার স্ত্রী মারা গেছে। পাঁচটি ছেলের একটিকেও উপযুক্ত মানুষ করা সম্ভব হয়নি। এক ছেলে হোটেলে খানসামার কাজে ভর্তি হয়েছে। আরেক ছেলে পাঁচ টাকা পুঁজি নিয়ে ডিমের ব্যবসা শুরু করেছে। আরেক ছেলে নিজেদের রান্না বান্নার দায়িত্ব আঞ্জাম দিয়ে যাচ্ছে। এই পরিস্থিতির মধ্যেই কোন প্রভাবশালীর চক্রান্তে স্কুলটি বন্ধ করে দেয়ার দুরভিসন্ধি চলছে।
তাই মাহমুদ পণ্ডিতের মনের অবস্থা বিষণ্ণ। এর মাঝেই জানা গেল, কাশেমালী চৌধুরী স্কুল ঘরের সম্মুখে গরু বাঁধার ব্যবস্থা করেছেন এবং তিনি সেখানে উপস্থিত হয়েছেন। খবর পেয়েই মাহমুদ পণ্ডিত বাঁকা লাঠিটা হাতে করে তেড়ে গেলেন। কথা কাটা-কাটি হতে-হতে একপর্যায়ে তাদের মধ্যে উত্তপ্ত বাক্যবিনিময় শুরু হয়।
প-িত মাহমুদ দখলদার কাশেমালী চৌধুরীকে উদ্দেশ করে বলেন, শয়তানির আর জায়গা পেলেন না? শেষ পর্যন্ত থাবা দিয়েছেন ইস্কুলের ঘরের ওপর। দুনিয়া ঘোরে কোন তালে, টাকার গরমে বুঝতে পারেন না বুঝি? ভীষণ ক্ষুব্ধ হয়ে গরগর করতে করতে কাশেমালী চৌধুরী বলেন, সাবধান! মুখ সামলে কথা বলো! নৈতিক বলে বলীয়ান পণ্ডিত মাহমুদ বলেন, রাখো! তোমার ধমকানিকে কেউ ডরায় না।
সরকারেরও সাধ্যি নেই ইস্কুল ঘরের ওপর হাত দেয়, আর তুমি কোনখানের জমিদার? ইস্কুল ঘরে গরু। টাউট কাশেমালী চৌধুরী তাতে মোটেও কর্ণপাত না করে বলে, দেখ্ প-িত, বেশি বাড়াবাড়ি করিস না।
ভাষা ক্রমশ নিচে নামতে থাকে। কথা কাটা-কাটির একপর্যায়ে প-িতমশাই কোন জবাব না দিয়ে বাঁধা গরুর খুঁটির গেরো খুলতে লাগলেন উত্তেজনায় কাঁপতে কাঁপতে। ক্ষিপ্ত হয়ে এগিয়ে আসে কাশেমালী, চিৎকার করে বলে, খুলিস না। প্রথম দড়িটা হেঁচকা টানে খুলে বলদটাকে বের করে দিলেন ঠেলে, তারপর দ্বিতীয় খুঁটিতে হাত দিলেন পণ্ডিত। কিন্তু খোলা হলো না। প্রথম একটা শব্দ, তারপর আর্তনাদ। আঘাত এসে পড়ল পণ্ডিতের মাথায়।
আহত হয়ে শিক্ষাগুরুকে শয্যা গ্রহণ করতে হলো। পাড়া-প্রতিবেশী এবং পার্শ্ববর্তী অন্যান্য স্কুলের সহকর্মীরাও এলেন, সমবেদনা জানালেন। ধীরে ধীরে মাহমুদ পণ্ডিতের জ্ঞান ফিরে এলো। সকলের উদ্দেশে কিছু বলার মতো শক্তি ফিরে পেলেন। তার নিজের বেদনা যেন সবার বেদনা হয়ে ওঠে এই আশাবাদ ব্যক্ত করলেন তিনি।
আলাউদ্দিন আল আজাদের গল্প রচনার সময় ও পরিস্থিতি এবং বর্তমান সময় ও পরিস্থিতির সঙ্গে প্রাসঙ্গিকতা কোনভাবেই মেলে না, কিন্তু শিক্ষক নিগ্রহের ধরন সমাজে শিক্ষকদের প্রতি অসম্মান, মর্যাদাহানি, নির্যাতন, শিক্ষকহত্যা, আমলাদের পা ধরে মাফ চাওয়ার দৃশ্য বলে দেয় সমাজে শিক্ষকদের অবস্থান এখনও সুখকর নয়।
আমাদের দেশে সরকারী-বেসরকারী, প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণ শক্তিশালী কর্ণধারদের নিয়ন্ত্রণে। সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা আমলা কিংবা অর্থশালীদের সাহায্য-সহযোগিতা নিয়ে এই সমস্ত বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে চলতে হয়। ফলে তাদের শিক্ষা-জ্ঞান-ভদ্রতা-বিবেকপ্রসূত মর্জিমাফিক বিবেচনার উপর নির্ভর ও ধৈর্যধারণ করেই কাটাতে হয় শিক্ষকসমাজকে। যুগ যুগ ধরে এই ব্যবস্থা চলে আসছে।
বিভিন্ন সমস্যা আসলেই সমাজের নিয়ত এই নিয়মের বিকল্প খোঁজার চেষ্টা করা হয় প্রতিনিয়ত। কিন্তু কিছুদিন সমস্যা নিয়ে বিশ্লেষণ ও চুলচেরা দৃশ্যমান পর্যালোচনা চললেও শেষমেশ শেষ হয়ে যায় সেখানেই। ফলাফল অদৃশ্যই থেকে যায়। সমাধানের মুলো ঝুলেই থাকে, ফুরোয় না কোনদিন। আলাউদ্দিন আল আজাদের সৃষ্টি গল্পের আবেদন এখানেই অনন্য।
ডিজিটালাইজড বাংলাদেশ অর্থনীতি, বাণিজ্য, ক্রীড়া, সংস্কৃতি-সাহিত্য প্রভৃতি বিষয়ে যতটা এগিয়েছে সে তুলনায় স্বাধীন বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থাপনা ঠিক কতটা এগুলো তার কিছু পরিচয় পাওয়া যায় আলাউদ্দিন আল আজাদের ‘সৃষ্টি’ গল্প বিশ্লেষণের মধ্যদিয়ে। ‘সৃষ্টি’ গল্পের রচনা ১৯৫০ সালে। গল্পে সে সময়ের বাংলার যে চিত্র পাওয়া যায়, তাতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অবকাঠামোগত উন্নয়ন কিংবা প্রাতিষ্ঠানিক সৌন্দর্য ছিল না বলতে গেলে।
সেক্ষেত্রে বেশ এগিয়েছে দেশ, শিক্ষকরা আগের চেয়ে অনেক বেশি বেতন পাচ্ছেন, নিয়মিত পাচ্ছেন। সুদৃশ্য বিল্ডিং পেয়েছেন, বসার জায়গা গাছতলা থেকে বিল্ডিংএর সুদৃশ্য কক্ষে স্থানান্তরিত হয়েছে। কিছুটা ভাল পোশাক-আশাক পরছেন হয়তো, বাজারের ভাল কিছু তরকারি কিনতে পারছেন। সমাজের বুকে বেশ গর্বের সঙ্গে চলাফেরা করতে পারছেন অনেকে। ছেলেমেয়েদের এটা-ওটা কিনে দিতেও পারছেন কেউ কেউ।
অনেক দিক দিয়েই তারা বেশ উন্নত কিন্তু সম্মানের জায়গায় অবস্থা কি তথৈবচ! সমাজের দায়িত্বশীল ব্যক্তিবর্গ, স্থানীয় মোড়ল মাতবর ও বিত্তবান গোষ্ঠী লোকাল রাজনীতিবিদ কিংবা প্রভাবশালীরা শিক্ষকদের কোনরকম সম্মানের জায়গায় বসতে দিতে চান কিনা তা প্রশ্নবোধক চিহ্ন দ্বারা আবৃত। শিক্ষকদের প্রতি সমাজের উঁচুস্তরের মানুষদের এহেন অবহেলা উঁচুস্তরের মানুষদের সন্তানদের মধ্যেও সংক্রমিত। বাবাদের আচরণ দেখে সন্তানরা, সমাজপতিদের চোখের ভাষায় তার অনুসারীরা শিক্ষকদের প্রতি মারমুখী, কখনও কখনও হন্তারক হিসেবে আবির্ভূত হতে দ্বিধাবোধ করছে না।
যদিও ওই সন্তানরা সে সমস্ত শিক্ষকদেরই পাঠ গ্রহণ করছে বিদ্যালয়ের ক্লাসরুমে। অথচ তাদের দাম্ভিক পদচারণায় সন্ত্রস্থ থাকতে হয় শিক্ষকদের। অনৈতিক দাবির কাছে অসহায় থাকতে হয় তাদের। গ্রেড-বেতনভাতা ও আর্থিক দৈন্য, বৈষম্যের নানা জটিলতা ও সঙ্কটে আবদ্ধ শিক্ষক-সমাজ। অবহেলা, অসম্মান থেকে মুক্তির জন্য শিক্ষকদের দাঁড়াতে হয় পথে। এমপিওভুক্তির আশায়, ন্যায্য গ্রেড চেঞ্জের দাবিতে দিনের পর দিন রাস্তায় ফুটপাথে অনশনে কাটাতে হয় তাদের। অথচ এসডিজি-৪ তথা মানসম্মত শিক্ষার লক্ষ্য অর্জনের উদ্দেশ্যে হলেও শিক্ষকদের যথাযথ সুযোগ-সুবিধা থাকা খুবই প্রয়োজন।
আর্থিক ও মর্যাদার নিরাপত্তা ক্লাসরুমে শিক্ষকদের মনস্তাত্ত্বিক শক্তি দেয় এ কথা কারও অজানা নয়। শিক্ষক সমাজের সকল শ্রেণীর মানুষের কাছে অত্যন্ত মর্যাদা ও সম্মানের পাত্র। ন্যায়-বিচার, সুশাসন প্রতিষ্ঠা এবং একটি আদর্শ জাতি গঠনে শিক্ষকদের ভূমিকা অপরিসীম। শিক্ষক আলোকিত সমাজ বিনির্মাণের হাতিয়ার। শিক্ষকরা হলেন তার সুনিপুণ কারিগর। শিক্ষা ছাড়া আলোকিত মানুষ সৃষ্টি কোনভাবেই সম্ভব নয়। শিক্ষক শুধু শিক্ষাদানই করেন না, তিনি মানুষ গড়ার কারিগরও।
শিক্ষকরা তাদের শিক্ষার আলো দিয়ে ভবিষ্যত গড়ে দেয়ার প্রাণপণ চেষ্টা করে যান। স্নেহ, মমতা, ভালবাসা তো বটেই। তাদের শিক্ষার আলো যেমন শিক্ষার্থীদের সামনের পথচলাকে সুদৃঢ় করে, তেমনি তাদের স্নেহ, মমতা, ভালবাসা তাদের অনুপ্রাণিত করে। মহৎ শিক্ষক তিনি উদ্বুদ্ধ করেন, জীবন চলার পথকে মসৃণ করতে শেখান। শিক্ষাদানের মহান ব্রত যার কাজ তাকেই মহৎ শিক্ষক বলা হয়। শিক্ষার্থীর মানবতাবোধকে জাগ্রত করে একজন শিক্ষক কেবল পাঠদানকে সার্থকই করে তোলেন না, পাশাপাশি দেশের উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করেন শিক্ষকদের জাতি গঠনের কারিগর বলা হয়। সুতরাং শিক্ষক আক্রান্ত হলে নিশচয় সেটি দেশের জন্য কোন ভাল হতে পারে না।
জাতির কারিগরদের অসন্তুষ্ট করে জাতি হিসেবে আমরা এগুতে পারব না। আলাউদ্দিন আল আজাদ এই মেসেজটিই তার গল্পে শৈল্পিকভাবে উপস্থাপন করতে চেয়েছিলেন। যেটি আজও সমানভাবে প্রযোজ্য আমাদের সমাজে। জার্মান চ্যান্সেলর এ্যাঞ্জেলা মার্কেলকে একবার তার দেশের বিচারক, ডাক্তার, প্রকৌশলীরা শিক্ষকদের সমান বেতন দাবি করলে তিনি তা প্রত্যাখ্যান করে বলেছিলেন, ‘ঐড়ি পধহ ও পড়সঢ়ধৎব ুড়ঁ ঃড় ঃযড়ংব যিড় ঃধঁমযঃ ুড়ঁ’ সমাজ ও রাষ্ট্রে শিক্ষকের অবদানকে বঙ্গবন্ধুও বারবার অকুণ্ঠচিত্তে উচ্চারণ করে গেছেন তঁর ভাষণে।
শিক্ষকদের উদ্দেশে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আগামী প্রজন্মের ভাগ্য শিক্ষকদের উপর নির্ভর করছে। শিশুদের যথাযথ শিক্ষার ব্যত্যয় ঘটলে কষ্টার্জিত স্বাধীনতা অর্থহীন হবে।’ যে শিক্ষককে আমরা সম্মান করতে পারব না তার কাছে আমাদের সন্তানকে শিখতে পাঠাবার মতো বিরুদ্ধাচার আত্মমর্যাদাশীল উন্নত জাতির পক্ষে শোভনীয় নয়।
গল্প, কবিতা, উপন্যাস, প্রবন্ধ, নাটক, গবেষণা, অনুবাদ- সব মিলিয়ে আলাউদ্দিন আল আজাদের প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা দুই শতাধিক। তার রচিত গ্রন্থগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য-জেগে আছি (১৯৫০), ধানকন্যা (১৯৫১), জীবনজমিন (১৯৮৮), তেইশ নম্বর তৈলচিত্র (১৯৬০), কর্ণফুলী (১৯৬২), ক্ষুধা ও আশা (১৯৬৪), মানচিত্র (১৯৬১), লেলিহান পা-ুলিপি (১৯৭৫), সূর্য-জ্বালার সোপান (১৯৬৫), নিখোঁজ সনেটগুচ্ছ (১৯৮৩), সাজঘর (১৯৯০) ইত্যাদি।
সাহিত্যকর্মের জন্য তিনি বিভিন্ন পদক ও পুরস্কার পেয়েছেন। উল্লেখযোগ্য- বাংলা একাডেমি পুরস্কার (১৯৬৪), ইউনেস্কো পুরস্কার (১৯৬৫), জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার (১৯৭৭), আবুল কালাম শামসুদ্দীন সাহিত্য পুরস্কার (১৯৮৩), আবুল মনসুর আহমেদ সাহিত্য পুরস্কার ১৯৮৪, লেখিকা সংঘ পুরস্কার (১৯৮৫) ইত্যাদি।
এছাড়া তিনি দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ স্বর্ণপদক (১৯৯৪) লাভ করেন। ২০০৯ সালের ৩ জুলাই ঢাকার উত্তরায় নিজ বাসভবনে ৭৭ বছর বয়সে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন ড. আলাউদ্দিন আল আজাদ। তার সৃষ্টিকর্মের মধ্য দিয়ে বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতি অঙ্গনে তিনি চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন।