ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

গল্প ॥ একটি ফটোগ্রাফ

সন্তোষ কুমার শীল

প্রকাশিত: ০১:৪৭, ২৯ জুলাই ২০২২

গল্প ॥ একটি ফটোগ্রাফ

স্টুডিও গ্রান্ড লুক

স্টুডিও গ্রান্ড লুক’-এর সামনে আসতেই মালিকের কর্কশ কণ্ঠস্বর আর জনতার ভিড় দেখে থমকে দাঁড়াতেই হয় শামসুর রহমানকেযদিও এই মুহূর্তে সে ভীষণ ব্যস্ত, তারপরও ভিড়ের মধ্যে মাথা গলিয়ে জাস্ট একনজর দেখেই এগিয়ে যাবে নিজের কাজে- এই ভেবে সে ভিড়ের মধ্যে গিয়ে দাঁড়ায়আর ঠিক তখ্খনই তার সঙ্গে চোখাচোখি হয় ভিড়ের কেন্দ্রবিন্দুতে কাঁচুমাচু বসা বিনয়ব্রতর সঙ্গে

শামসুর রহমানের নিজের চোখ দুটো বিশ্বাস হয় না- যে মানুষটি পরিবারের কাছ থেকেও পালিয়ে বেড়ায় একা থাকার জন্য তাকে ঘিরে এতবড় জটলা আর এতসব উচ্চবাচ্য! শামসুর রহমানকে দেখে চোখ দুটো জ্বলে ওঠে বিনয়ব্রতরহা করে শ্বাস নেয়ার ভঙ্গিতে কিছু বলতে যায়, কিন্তু গলা থেকে কোন স্বর বের হয় নাবার দুই চেষ্টা করার পর মাথাটা নিচে দিয়ে চুপ করে থাকে

শামসুর রহমান কিছু একটা আন্দাজ করে নেয়স্টুডিও মালিককে বজ্রগম্ভীর স্বরে ধমকে বলেÑ একজন ভদ্রলোকের সঙ্গে কেমন আচরণ করতে হয় পরিবারের কাছ থেকে সে শিক্ষা পাওনি? নাও ওকে ভেতরে নিয়ে বসাও

তারপর রবাহুত জনতাকে উদ্দেশ করে বলে- আপনাদের কি খেয়ে-দেয়ে কোন কাজ নেই? দাঁড়িয়ে মজা দেখছেন? যে যার কাজে চলে যানআমার বন্ধুর ব্যাপারটা আমিই দেখছি

শামসুর রহমান শহরের ডাক সাইটে উকিলশহরের ছেলে-বুড়ো একনামে তাকে না চেনে এমন মানুষ নেইতার কথা অমান্য করে সাধ্য কার! মুহূর্তেই ভিড় মিলিয়ে যায়স্টুডিও মালিক উকিল সাহেবকে দেখে মিইয়ে যায়এতক্ষণ জনতার ভিড়ে চুপ করে থাকা প্রতিপক্ষের সামনে তর্জন-গর্জন করে বেশ একটা হিরো হিরো ভাব জেগেছিলসে জবাবদিহির সুরে বলে- দেখুন উকিল সাহেব, এই শহরে স্টুডিও গ্রান্ডলুকের একটা সুনাম আছে

দুই যুগের বেশি সময় ধরে একটু একটু করে এটা অর্জন করেছিকিন্তু এই ভদ্রলোক দীর্ঘদিন- প্রায় বছরখানেক ধরে আমার ইমেজ, আমার ইগোয় আঘাত করে চলছেনআমার ছবিতে নাকি পারফেক্ট লুক আসে না, ছবি বিষণ্ণ-মলিন দেখতে লাগেপ্রথমদিকে কথাগুলো শোনার পরে ওঁর ছবি আমি নিজে প্রিন্ট করেছিএকাধিকবার স্ন্যাপ নিয়ে ফটোশপে এডিট করে যতটুকু ন্যাচারাল সুন্দর করা যায় আমি চেষ্টায় ত্রুটি করিনিকিন্তু তিনি এসে ফটোগ্রাফের মূল্যশোধ করে বলেছেন- এ ছবিটা মনে হয় যেন আতঙ্কিত কোন লোকের হবেআমি এটা নিতে পারছি নাআপনি আবার তুলুন

অনেকদিন প্রায় একই রকমের নেতিবাচক কথা শুনে শুনে আজ আর ধৈর্য ধরে রাখতে পারিনিএই দেখুন, এতদিন ধরে ওর একগাদা ছবি জমে আছেগত সপ্তাহে তোলা এই যে শেষ ফটোগ্রাফটা আজ নিতে এসে আমাকে বলেন- ফটো তোলায় তোমার স্টুডিওর সুনাম আছে বলে এতদিন ধরে একটা ভাল ছবির চেষ্টা করে গেছিকিন্তু আজকের ছবিটা একদম ক্রীতদাসের চেহারার মতো হয়েছেআমি কি দেখতে সত্যিই এ রকম? তোমার কাছে আর ছবি তুলতে আসব না

কথাটা শুনে আমার আত্মবিশ্বাসে ভীষণ রকম ধাক্কা লেগেছেএকটা ছবি যতটুকু সুন্দর করা যায় আমি চেষ্টা করিএজন্য একাডেমিক শিক্ষা নিয়েছিতারপর একাগ্রতার সঙ্গে নিজের সবটুকু সৌন্দর্যচেতনা ঢেলে দিয়ে এক একটা ফটোগ্রাফ প্রিন্ট করিগ্রাহক এসে যদি সেই ফটোগ্রাফের নিন্দা করে তখন অসহায় বোধ হয় না?

সত্যিই তো! স্টুডিও মালিকের কথা অযৌক্তিক তো কিছু নয়! অনেকগুলো ফটোগ্রাফ জমা হয়েছে যার কিছু কিছু বিবর্ণ হয়ে গেছেশামসুর রহমান জিজ্ঞেস করেন- সবগুলো ছবির মূল্য পরিশোধ করা হয়েছে?

-হ্যাঁইনি ছবি নিতে এসে প্রতিবার মূল্য শোধ করে গেছেনকিন্তু কোন একটা অজুহাতে ছবিগুলো নেননি

-ঠিক আছেসবগুলো প্যাকেট করে দাওআমি নিয়ে যাচ্ছিকিছু টাকা স্টুডিও মালিকের হাতে জোর করে গুঁজে দিয়ে বলেন- কিছু মনে করোনা যেনএটা তোমার ভাল কাজের পুরস্কারতারপর বিনয়ব্রতকে নিয়ে রাস্তায় নামেন

কলেজে সাহিত্য সাময়িকী সম্পাদনার কাজ করতে গিয়ে বিনয়ব্রত আর শামসুর রহমানের পরিচয়বাংলার অধ্যাপক ফজলুল হক স্যারের অত্যন্ত প্রিয়পাত্র ছিল বিনয়ব্রতবিভিন্ন অনুষ্ঠানে সাহিত্য বিষয়ে চমকার আলোচনা করতশামসুদ্দীন তখন ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদককি খেয়াল হল, একদিন একটা প্রেমের কবিতা লিখে বিনয়ব্রতর কাছে হাজিরকবিতাটা পত্রিকায় ছাপাতে হবে

বার দুই পড়ে বিনয়ব্রত বলে- এটা এখন পর্যন্ত কবিতা হয়ে ওঠেনিতবে একটা আইডিয়া আছেচেষ্টা করলে কবিতা বানানো যায়বাড়ি গিয়ে বসে যাও, এক সপ্তাহ পরে নিয়ে এসোআর একটা কথা, কাউকে ইমপ্রেস করার জন্য কবিতা লিখ না, নিজের আনন্দের জন্য লিখবে

ছাত্রনেতা শামসুদ্দীন ক্ষুব্ধ, বিরক্ত আর কিছুটা হতাশ মনে কবিতাটা নিয়ে ফিরে যায়ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদকের কথা তুচ্ছজ্ঞান করে এমন স্পর্ধা ! ছাত্রনেতা হিসেবে তার ইগোতে খুব লাগেতবু সে অধ্যবসায় সহকারে কবিতাটা নিয়ে বসেএক সপ্তাহ পর যখন বিনয়ব্রতর কাছে যায় কবিতাটায় একবার চোখ বুলিয়ে বলে, আজ থেকে তোমার নাম শামসুর রহমানকি একটা নাম বয়ে বেড়াচ্ছ!

এই বিখ্যাত কবির নামটি ধারণ করলে দেখবে তুমিও একদিন বড় কবি হতে পারবেতোমার মধ্যে সম্ভাবনা আছেদেখ না আমি কবি বিনয় মজুমদারের নামানুসারে বিনয়ব্রত নাম রেখেছি! তুমি ওসব রাজনীতি-ফিতি ছাড়এখন থেকে কবিতা লিখতে লেগে যাওদেখবে ওসব হৈ-হুল্লোড়ের চেয়ে অনেক বেশি আনন্দ পাবে

-তুমি বরং রাজনীতিতে নেমে পড়তাহলে আমরা একজন সাহিত্যিক রাজনীতিবিদ পাব, যেমন লেনিন পেয়েছিলেন ম্যাক্সিম গোর্কিকে

-কবি-সাহিত্যিকরা রাজনীতি না করলেও কম-বেশি রাজনীতি সচেতনআমিও তা থেকে বাদ যাই নাকিন্তু তুমি শুধু রাজনীতিটাই যা একটু বোঝসাহিত্য-সংস্কৃতির কোন ধারণা নেইশুধু তুমি কেন, আমাদের দেশের সিংহভাগ রাজনীতিবিদদের সেটা নেই

সেদিন থেকে বলতে গেলে প্রায় বিপরীত প্রান্তের দুটি বিষয়- রাজনীতি আর সাহিত্যে বিচরণকারী দুজন যুবকের বন্ধুত্ব অটুট হয়ে ওঠেকলেজ ক্যাম্পাসে তারা একটা সোনালি অধ্যায়ের সূচনা করেছিলতারপর একদিন শামসুর রহমান আইন ব্যবসা আর বিনয়ব্রত শিক্ষকতা পেশায় ঢুকে পড়েশিক্ষকতার পাশাপাশি সাহিত্যচর্চা চললেও শামসুর রহমান ফৌজদারি আইন নিয়ে লেগে থাকেশহরের গু-া-মাস্তান, ভূমিদস্যু, ব্যবসায়ী সকলের ত্রাণকর্তা হয়ে ওঠেজীবনে আর কোনদিন কবিতার একটা লাইনও মাথায় আসেনিকিন্তু ওকলাতি পেশায় এসে অর্থ-বিত্ত, খ্যাতি-প্রতিপত্তিতে সে অপ্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠেছিল

হাঁটতে হাঁটতে শামসুর রহমান জিজ্ঞেস করে- তোমার কি হয়েছে? এই বয়সে এত ঘন ঘন ফটো তুলছো কেন ভাই? অভিনয়-টভিনয় করতে নামবে নাকি?

বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর বিনয়ব্রত বলে- কি হয়েছে বলতে পারি নাতবে আজকাল সবকিছুতে কেন যেন কেবলই হেরে যাচ্ছিগভীর হতাশা আর আশঙ্কার আঁধারে হাবুডুবু খাই সব সময়এসব থেকে মুক্তি পেতে নানা রকম চেষ্টা করিশুনেছি ফটোগ্রাফে নাকি সত্যিকারের প্রতিরূপটা দেখা যায়কিন্তু তাও দেখি নিজের ফটোগ্রাফ নিজের কাছেই অচেনা মনে হয়

-তোমার লেখালেখি কেমন চলছে?

-লেখালেখি ছেড়ে দিয়েছিআমি যে কোনদিন লিখতে পারতাম তা-ই মনে হয় নাঅনেক ভাবনা-চিন্তার পরও এক লাইন কবিতা মাথায় আসে না

শামসুর রহমান থমকে দাঁড়ায়- সৃষ্টিশীলতা যার ধ্যান-জ্ঞান, বন্ধুকে লেখানোর জন্য মরিয়া হয়ে চেষ্টা করে, প্রতিদিন লেখক-সাংবাদিক-শিল্পীদের নিয়ে আড্ডা-তর্কে মেতে থাকত তার মাথায় লেখা আসে না! এটা তো সহজ কথা নয়! এ তো অপমৃত্যুর নামান্তর! কিন্তু কেন এমন হলো?

শামসুর রহমানকে নিয়ে বাড়ি ঢুকতে দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বিনয়ব্রতর স্ত্রী তনুজাদীর্ঘদিন ধরে কাছের লোকটাকে নিয়ে দুর্ভাবনায় থেকে থেকে মুখের হাসিটাই মিলিয়ে গিয়েছিলস্বামীর বন্ধু এবং সুহৃদ শামসুর রহমানকে দেখে মন থেকে একটা গুরুভার পাষাণ নেমে যায়নিজেকে বেশ নির্ভার মনে হয়

দেখতে দেখতে ঝমঝম করে এক পশলা বৃষ্টি নামেভ্যাপসা গরমে বেশ একটা স্বস্তির পরশ বুলিয়ে যায় দেহ-মনেবিনয়ব্রত শৌচাগারে ঢুকলে শামসুর রহমান ফটোগ্রাফগুলো তনুজার হাতে দিয়ে বলেÑ বিনয়ের কি ইদানীং কোন সমস্যা যাচ্ছে বৌদি?

বেশ কিছুক্ষণ নীরব থেকে তনুজা বলেÑ ইদানীং নয়, বেশ কিছুদিন ধরে মানুষটা অস্বাভাবিক আচরণ করে চলছেসব সময় হতাশ, মনমরা একটা ভাবকোন কাজকর্মেও মন নেইশুধুমাত্র স্কুলের দায়িত্বটুকু পালন করেআর ছুটির দিন বাজারটা করে আনেঅবসরে তার কাজ হচ্ছে নদীর ধারে গিয়ে বসে থাকাকাছেই তো নদী! যেটুকু সময় পায় ওখানে কাটায়আগে লেখালেখির জন্য সর্বস্ব ত্যাগ করতে পারতকিন্তু বছরখানেক হলো লেখার টেবিলে যায়ই না! আমি খাতা-কলম দিয়ে হাত ধরে লেখার টেবিলে নিয়ে বসিয়ে দিয়েছিকিন্তু পরে গিয়ে দেখি আনমনে বসে খাতায় হিজিবিজি দাগ কাটছে

বছরখানেক আগেও সময় একটু পেলেই দৌড়ে গিয়ে লিখতে বসতএকদিন হলো কি- দুপুর বেলা আমরা সবাই খেয়ে-দেয়ে দিবানিদ্রায় আছিআপনার বন্ধু লিখতে বসেছেহঠা একটা ফোন আসেশব্দ পেয়ে আমিও উঠে পড়িগিয়ে দেখি সে পাথরের মূর্তির মতো নিশ্চল বসে আছেমনে হলো তার চোখমুখ যেন আতঙ্কে বিবর্ণঅনেক পীড়াপীড়ি করেও সারাদিনে কোন কথা বলাতে পারিনিসবাই দুশ্চিন্তায় অস্থির! হঠা কি হলো লোকটার!

রাত এলে না খেয়ে গিয়ে বিছানায় পড়ে রইলগভীর রাতে অনেক প্রশ্নের পর বলে- সভ্যতার ইতিহাসে জঘন্যতম একটা কাজ হলো আজ আমাদের দেশে!

-কি হয়েছে বলো! আমার কিন্তু খুব দুশ্চিন্তা হচ্ছে!

-প্রগতিকামী মানুষের বিবেক বলে অভিহিত এক বিখ্যাত লেখককে উগ্রবাদী কোন গোষ্ঠী হত্যা করতে চেয়েছিলকোনমতে প্রাণে বেঁচে আছেএখন সে মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছে

-কেন, তার অপরাধ কি?

-সব সময় দুঃসাহসী সত্য উচ্চারণ করা তার প্রথম অপরাধভুলটাকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে কঠোর স্বরে উচ্চারণ করতেন তিনিরাজনীতিক, ধর্মযাজক- যারা মানুষের বিশ্বাস নিয়ে কারবার করে তাদের মস্নদ কেঁপে গিয়েছিল তার সত্যভাষণেতারই পরিণাম হিসেবে তাকে মৃত্যু উপহার দেয়া হলযেখানে সত্যের দ্বার রুদ্ধ করে দেয়া হয় সেখানে শিল্প-সাহিত্য, নান্দনিকতার চর্চা হতে পারে নাপ্রতিদিন সেখানে আঁধার জমে জমে অন্ধকূপ তৈরি হবে! এই যে হত্যাযজ্ঞ শুরু হল এটা আরও অসংখ্য হত্যা ডেকে আনবেআমাদের দেশটা পিছিয়ে যাবেরাস্তাঘাট, কলকারখানা বাড়লে তো আর দেশ উন্নত হয় না! এটা বড়জোর মানুষের মুখে দুটো খাবার তুলে দেয়ার ব্যবস্থামাত্রদেশ উন্নত হয় মানুষের প্রাণশক্তি বিকশিত হলে, প্রাণে আনন্দের সঞ্চার হলেযেখানে আনন্দ নেই সেখানে জীবন বিকশিত হয় না

-তুমি এখন ঘুমাওকাল আবার বলবে

-ঘুমাব কী করে বলো! জগতের সব মতেরই বিরুদ্ধ মতবাদ থাকবেকারণ মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি সব সময়ই আলাদাতার বোধ, অনুভব, শিক্ষা, সংস্কার সবই আলাদাতাকে মেনে নেয়ার সহিষ্ণুতাটুকু আমাদের থাকবে না! বিরুদ্ধ মতবাদের বক্তব্যকে ভয় পেয়ে হত্যার সিদ্ধান্ত নেয়া কত বড় নির্মমতা ভেবে দেখ! আগামী দিনের পথচলা কত বড় সংশয় চিহ্ন হয়ে দাঁড়াল! অথচ, এই ভূখ-ের জল-বাতাস, হাজার বছরের সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, দেশের মানুষের কোমল স্বভাব সবই কত উকৃষ্ট! তাহলে কোথা থেকে কাদের হাত ধরে ধর্মান্ধতা, হত্যা-লুণ্ঠন এলো! প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে বাংলার অন্তর্লোক কত ঋজু, কত উদার! সেই দেশে আজ প্রগতিশীলতাকে বিষনজরে দেখা হচ্ছে! হত্যার মত ঘৃণ্য, বীভসতা ঠাঁই পাচ্ছে! আমরা কি আর কোনদিন আলোর চর্চা করতে পারব?

-কাল দেখো সব ঠিক হয়ে যাবে!

-আশা ছেড়ে দিয়ে তো আর মানুষ বাঁচতে পারে না! তাই আমরা এমনটা ভাবছিকিন্তু কিছুই ঠিক হবে নাবরং একটা আলোর পাখিকে হত্যা অসংখ্য হত্যার জন্ম দেবেআমাদের দেশটা ভয়ঙ্কর মৃত্যুকূপ হয়ে উঠবেহয়তো কোনদিনই আর শান্তিতে ঘুমুতে পারব নাঅনিদ্রার অভিশাপ গ্রাস করে নেবে শান্তিপ্রিয়, সংস্কৃতির পূজারীদের

বিনয়ব্রত শৌচাগার থেকে বের হয়ে তনুজাকে কথা বলতে দেখে তিরস্কারের সুরে বলে- তুমি কি আতিথেয়তাও ভুলে গেলে নাকি?

লজ্জিত মুখে তনুজা ঘরে গেলে শামসুর রহমান জিজ্ঞেস করে- আজকাল কি নিয়ে লেখালেখি করছ?

-লেখালেখি তো কবেই ছেড়ে দিয়েছি!

-সে কী? কেন?

-কী হবে লিখে? আমাদের সমাজ, রাষ্ট্র কি মননে শিল্প-সাহিত্য, নান্দনিকতা লালন করে? বরং শিল্প-সাহিত্য, প্রগতিশীলতা, জ্ঞানচর্চাকে বিষ নজরে দেখেএখানে অত্যন্ত আড়ম্বরের সঙ্গে, গুরুত্বের সঙ্গে ধর্মান্ধতা এবং অপরাজনীতিকে উসাহিত করা হয়দুটোই জ্ঞানচর্চার পথে মস্ত বাধাওই তোমরা যাকে কর্পোরেট সভ্যতা না কি সব ভাল ভাল আধুনিক শব্দ বলো না ওটা যারা নিয়ন্ত্রণ করে মানুষকে অন্ধ করে রাখলেই তাদের উদ্দেশ্য পূরণ হয়ে গেল! তাই সংস্কৃতিহীনতাকে উসাহ দেয়া হচ্ছে যাতে মুক্তবুদ্ধির চর্চা মাথা তুলে দাঁড়াতে না পারেচোখের সামনে দেখছি প্রতিদিন অন্ধকারে সব ঢেকে যাচ্ছেঅথচ হাত-পা গুটিয়ে আমাদের অথর্বের মতো বসে থাকা ছাড়া কোন কাজ নেই

-এর মধ্য দিয়েই আমাদের পথ চলতে হবেথেমে থাকলে কি সব ঠিক হয়ে যাবে?

-তোমার কাজগুলো তো সেই অপরাজনীতি কেন্দ্রিক! ওসব করা যায়কিন্তু সাহিত্য চর্চার মত অকাজের কাজ করা যায় না বন্ধু!

-তুমি এসবের প্রতিবাদ করে লেখ

-যতই দুঃসময়ের তরঙ্গ উঠুক না কেন জীবন এক মহার্ঘ্য প্রাপ্তিএটাকে উপভোগ করার প্রচ- ইচ্ছা নেশাচ্ছন্ন করে রাখে যে! কে যেচে গিয়ে মৃত্যুর দুয়ারে দাঁড়ায় বল?

-কিছু কিছু মৃত্যু হাজার মৃত্যুকে রুখে দিতে পারেতুমি যার জন্য কথাগুলো বলছ তিনি মৃত্যু দুয়ার থেকে ফিরে এসে মৃত্যুঞ্জয়ী হয়ে উঠেছেনএটা মৃত্যু নয়, বলতে পার নির্ভীক সত্য উচ্চারণের জন্য নিজেকে উসর্গঅসুরদের হাত থেকে দেবতাদের সুরক্ষা দিতে দধীচি মুনি একদিন এই আত্মোসর্গ করেছিলেনতিনি এই সময়ের দধীচিনিজের জীবনকে মৃত্যুর কাছাকাছি নিয়ে গিয়ে তার মত সহ¯্র জ্ঞানতাপসের জীবনকে তিন নিষ্কণ্টক করে গেছেনআবার তো তিনি আত্মশক্তি বলে সেখান থেকে ফিরেও এসেছেন!

-সেটাকে অলৌকিক বলতে পারকিন্তু না ফেরাটাই স্বাভাবিক ছিল

-তুমি আমার চেয়ে ভাল জান- সক্রেটিস, ব্রুনো থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত কত জ্ঞান সাধকই তো সত্যের জন্য, আলোর জন্য আত্মাহুতি দিয়েছেন! তাঁদের এই উসর্গের জন্যই আজও সত্যের কণ্ঠ সুউচ্চে আছে

-জানি না তোমার কথা ঠিক কিনাআমার মনে হয় মিথ্যার কণ্ঠই জোরালোসত্য আড়ালে বসে ফিসফিস করে

-তোমার এই নেতিবাচক ধারণা, বিশ্বাস ব্যক্তি, সমাজ, রাষ্ট্র সকলে জন্যই অকল্যাণকরকতখানি হতাশা, যন্ত্রণার দহনে তোমার এই ভীতি, গ্লানি সেটাও বুঝিএখান থেকে যে করেই হোক তোমাকে বেরিয়ে আসতে হবেআচ্ছা, তার আগে বল তো স্টুডিও গ্রান্ড লুক’-এ আজ কি হয়েছিল?

-তুমি যা শুনেছ সবই ঠিকসে লোকটা এক বর্ণও মিথ্যে বলেনিবছরের বেশি সময় হয়ে গেল নিজেকে নিয়ে বড্ড সংশয়ে থাকিকখনও মনে হয় আমি খুনী আবার কখনও মনে হয় আমাকে খুন করা হচ্ছেভীষণ আতঙ্ক ভর করে মনেমাথাটা ঠিক রাখতে পারি নাদেখি- কোন অন্ধকার অতল গহ্বরের দিকে প্রচ- বেগে ভেসে চলছিনিজেকে দেখার জন্য ফটো তুলিকিন্তু ফটোতে নিজেকে খুনীর সামনে মুখ থুবড়ে অসহায় পড়ে থাকা মানুষের মতো দেখিসেটাই বুঝিয়ে বলতে চেয়েছিলামকিন্তু লোকটা ক্ষেপে গেলে আমার চুপ করে থাকা ছাড়া আর পথ ছিল নাআমার কথা কে বিশ্বাস করবে! কিন্তু ভেতরের দহন, ক্ষয় ক্রমাগত আমাকে শেষ করে ফেলছে

বিনয়ব্রতকে বলার মতো কোন ভাষা জোগায় না আদালত পাড়ায় কথার জালে প্রতিপক্ষকে তুলোধোনা করে দেয়া দুঁদে উকিল শামসুর রহমানের মুখেসে বন্ধুপত্নীকে আপ্যায়নের সুযোগ না দিয়ে পালিয়ে চলে যায়

×