ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

ঝরাপাতার ভুবন

আবু সাইদ কামাল

প্রকাশিত: ০০:০৪, ২২ জুলাই ২০২২

ঝরাপাতার ভুবন

.

(আগামী ২৬ জুলাই, নাজিরপুর যুদ্ধ দিবস। এদিনে নেত্রকোনা জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে ১১৭২ নম্বর সীমান্ত পিলার সংলগ্ন সাতজন শহীদ মুক্তিযোদ্ধার সমাধি স্থলে স্মরণ সমাবেশ ও লেঙ্গুরা হাইস্কুলে আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হবে। একাত্তরের এই দিনে সমাধিস্থল থেকে সাত কিলো দূরে নাজিরপুর পাক হানাদারদের সাথে সন্মুখযুদ্ধে সাতজন তরুণ মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। তাঁদের স্মরণে প্রতিবছর এদিনটি উদ্যাপন করা হয়। সেই বিষয়টি ঘিরে একটি মুক্তিযুদ্ধের গল্প)

সকাল দশটায় একজন তরুণ বাইকচালকের সাথে রওয়ানা হয় রাকিব হাসান। এপ্রিলের দ্বিতীয় সপ্তাহ। আকাশ ভালো। চড়া রোদ। চারাচরে থেকে থেকে বাতাস বইছে। কদিন আগে বৃষ্টি হয়েছে। রাস্তাঘাটে নেই ধুলোবালি।
উপজেলা প্রশাসনের আয়োজনে একটি পিকনিকের আয়োজনে যাচ্ছে ওরা। সীমান্তবর্তী লেঙ্গুরা ইউনিয়নের ঐতিহাসিক স্থান ফুলবাড়ি পিকনিক স্পট। উপজেলা থেকে ১৬ কিলো দূরে লেঙ্গুরা বাজার। বাজার থেকে আরও তিন কিলো উত্তরে ফুলবাড়ি। মনোমুগ্ধকর প্রাকৃতিক পরিবেশ। তিন দিকে পাহাড়। একদিক সমতল। সমতলভূমি ঢুকেছে পাহাড়ী আবহের ভিতর। ফুলবাড়ির পুবপাশ দিয়ে বয়ে গেছে গণেশ্বরী নামে পাহাড়ী নদী। মনোহর একটি স্থান বেছে নেয়া হয়েছে পিকনিকের জন্য। লেঙ্গুরা বাজার পার হয়ে উত্তরদিকে গণেশ্বরী নদীর কিনার ঘেঁষে মোটরবাইকে ছুটছে ওরা। মনে হচ্ছে যেন ক্রমেই পাহাড়ের পেটে ঢুকে যাচ্ছে।
সকাল এগারোটায় ফুলবাড়ি এলাকায় পৌঁছে থ বনে যায় রাকিব। এতটা পরিবির্তন দেখলে যে কারো বিস্ময় জাগবে। এলাকাটা আগে থেকেই রাকিবের বেশ চেনা-জানা। মনে পড়ে, সবশেষ প্রায় বিশ বছর আগে এসেছিল এ পথে।
২৬ জুলাই নাজিরপুর যুদ্ধদিবস ও সাত শহীদের সমাধিস্থলে এসেছিল। আলোচনা অনুষ্ঠান হয়েছিল লেঙ্গুরা হাইস্কুলে। তারও পনেরো বছর আগে লেঙ্গুরা হাইস্কুলের সহকারী প্রধান শিক্ষক ছিল মাস ছয়েক। তারপর সরকারি চাকরিতে চলে যায়। সে সময়ে ফুলবাড়ি বাজার ছিল না। পথের দুপাশ ছিল ফাঁকা। বাড়ি-ঘর ছিল একেবারে কম।
পিকনিকি স্পট ফুলবাড়ি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের আঙিনায় এসে স্মৃতি তাড়িত হয় রাকিব। স্কুলের উত্তরেই ছিল তার সহপাঠিনী মল্লিকা ঘ্রাগ্রাদের বাড়ি। সেই বাড়িতে বার দুই আসা হয়েছিল তার। তাদের বাড়ির উত্তরে পথের পাশে ছিল মল্লিকার বান্ধবী ছায়াবীথিদের বাড়ি। সেই সময়ে ছায়াবীথিদের বাড়িতেও এসেছিল রাকিব। এখানে এখন আর মল্লিকাদের সেই বাড়িটি নেই।

ছায়াবীথিদের বাড়ি আছে। তবে বিয়ের পর সেও চলে গেছে স্বামীর কর্মস্থলে। ছায়াবীথি রাকিবেরও সহপাঠিনী। তবে তার সাথে তেমন সখ্য গড়ে ওঠেনি।
ওদের সাথে আর একটা মিল ছিল তার। ওরাও একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিল। গিয়েছিল রাকিবও। ওরা ছিল রংরা ক্যাম্পের কিশোরী মুক্তিযোদ্ধা। রাকিব ছিল দশ কিলো পুবে মহাদেও ইয়ুথ ক্যাম্পের কিশোর মুক্তিযোদ্ধা। স্বাধীনতার পর বালুচরা হাইস্কুলে নবম শ্রেণিতে ভর্তি হয় ওরা। একই ক্লাসে পড়ার সময় ওদের সাথে পরিচয় রাকিবের। সে সময়ে একবার সহপাঠিনীদের বাড়িতে বেড়াতে প্রথম এ গ্রামে আসা। তারপর দ্বিতীয়বার নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি সাত শহীদ মুক্তিযোদ্ধার সমাধিতে আসা। তৃতীয়বার আসা এই পিকনিক উপলক্ষে। লেঙ্গুরা হাইস্কুলে স্বল্পদিনের শিক্ষকতার সময় ফুলবাড়ি আসা হয়ে ওঠেনি।
পিকনিকে কিছুটা আনুষ্ঠানিকতা অল্প সময়ের মাঝে শেষ হয়। তারপর ওরা কয়েকজন বেরিয়ে পড়ে। চলে তাদের বাইকে ঘুরাফেরা। প্রথমে যায় সাত শহীদের সমাধিস্থলে। রঘুনাথপুর নামক স্থানটি বেশ মনোমুগ্ধকর। পুবে নদীর ওপারে মেঘালয়ের পাহাড়। পশ্চিমেও পাহাড়। দক্ষিণে বাংলাদেশ সীমান্তে একটি ছ্ট্টো পাহাড়। পশ্চিমে কিছুটা সমতলভূমির পর আবার বাংলাদেশ সীমান্তে ছোট আকারের ক’টি পাহাড়। ভূ-প্রকৃতিতে এমন নয়নাভিরাম স্থান আর রাকিবের চোখে পড়েনি।
চপল পাহাড়ী নদী গণেশ্বরী গারো পাহাড় থেকে এখানেই প্রথম সমতলে ছুঁয়েছে। নদীর পশ্চিম পাড়ে সমতল ভূমি। এটি রঘুনাথপুর নামে পরিচিত। নদীর পশ্চিমপাড় ঘেঁষে ১১৭২ নম্বর সীমান্ত পিলার। এ পিলারের তিন-চার ফুট পশ্চিমে সাত শহীদের সমাধিস্থল। সমাধিস্থলের আঙিনায় প্রায় একবিঘা সমতল ভূমি। এ চত্বরে উপজেলা পরিষদ এবং উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের পক্ষ থেকে লাগানো হয়েছে সারি সারি মেহগিনি গাছ। সবুজ গাছে আচ্ছাদিত পাহাড় পাদমূলের অপূর্ব সুন্দর এ স্থানটিতে সাত শহীদ মুক্তিযোদ্ধার সমাধি দিয়েছে- দেশপ্রেমজাত অবিনাশী এক ঐতিহাসিক মহিমা।
বেশ উত্তর দিয়ে যদিও নদীর ওপর একটি সেতু আছে। সে পথ চলে গেছে পাহাড়ের ওপর দিয়ে। ও পথে চলা কিছুটা কষ্টসাধ্য এবং সময় সাপেক্ষ। বাজার ফেরতা মানুষের অধিকাংশই গারো মহিলা। তাদের প্রায় প্রতি মহিলার পিঠে বাঁশ ও বেতের তৈরি জোঙা। এগুলো দিয়ে পণ্য বহন করে। রংরা বাজারের কাছেই রংরা বিএসএফ ফাঁড়ি। ওখানেই ছিল একাত্তরে রংরা মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্প।
এখানে ওরা কথা বলে ভারতীয় পথচারীদের সাথে। এভাবে অনেক্ষণ আনন্দমুখর সময় কাটিয়ে দুটি মোটরবাইকে দুজন করে চারজন অন্য স্পটের উদ্দেশে ছুটে। মিনিট কয়েক গ্রামের পথে ছুটে ওরা ছোট্ট একটা পাহাড়ী ছড়ার পাড়ে দাঁড়ায়। মোটরবাইক নিয়ে পারাপারের উপায় নেই। এক বাঁশের সাঁকো পার হয়ে এমন একটি বাড়িতে যায়, যে বাড়ির আঙিনার অর্ধেক সমতলে; বাকিটা পাহাড়ী টিলায়। বাড়ির উঠোন টিলার বুকে। মোটরবাইকে আসা স্থানীয় প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একজন প্রধান শিক্ষক বাড়ির লোকদের ডাকলেন।  
সাড়া দিয়ে যিনি বের হয়ে আসলেন, তিনি সম্ভবত গারোমদ ‘চু’ পান করে আনকটা টালামাটাল। একজন বীর মুক্তিযোদ্ধাও। নাম ক্লিয়ারশন সাংমা। রাকিবের সহপাঠিনী মল্লিকা ঘাগ্রার স্বামী। প্রধান শিক্ষক সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, মল্লিকা ঘাগ্রা বাড়ি আছে কিনা। জবাবে তিনি জানালেন বাড়ি নেই। কাজেই রাকিবের পরিচয় দিতে হয়নি। তাদের বাড়িটাও দেখার মতো একটা স্পট। ওরা বাড়ির উত্তর আঙিনায় পাহাড়ের টিলায় উঠতে থাকে। সামনে গিয়ে থমকে দাঁড়ায়। ওখানেই একটি সীমান্ত পিলার। এ পিলারটি এ বাড়ির আঙিনায় পড়েছে। সীমান্ত পিলারের পর একের পর এক পাহাড়। পাহাড়ে সম্ভবত ফসলের চাষ হয়। এজন্য ফসল চাষের উপযোগী করে জঙ্গল সাফ করা হয়েছে। বাড়ির মূল মাচান ঘরের খানিক উত্তরে পাহাড়ের উপরে কিছুটা সমান জায়গায় শূকর পালনের জন্য বেড়া দেয়া স্থান। একটা শূকর ছানাকে খেতে দেয়া হয়েছে।
মল্লিকা ঘাগ্রার এমন মনোরম স্থানের বাড়িটি দেখে রাকিব অবাক হয়। অনেক বছর তার সাথে যোগাযোগ নেই। যোগাযোগ নেই তার বান্ধবী ছায়াবীথির সাথেও। এখান থেকে ভারতের রংরা বাজার কিংবা বিএসএফ ক্যাম্প হাঁটার দূরত্বে। বলা যায়, বাংলাদেশের লেঙ্গুরা বাজারই এরচে’ কিছুটা দূরে।
এভাবে একের পর এক ফুলবাড়ির পাহাড়ী দৃশ্য দেখে সময় গড়ায়। দুপুরের খাবারের সময় ঘনিয়ে এলে ওরা আবার পিকনিক স্পটে ফিরে আসে। আসার পথে দেখে ছায়াবীথিদের বাড়ি। অনিন্দ্যসুন্দর এক মেয়ের নাম ছায়াবীথি। সম্ভবত এ জন্যই রংরা বিএসএফ ক্যাম্পের রাজপুত ক্যাপ্টেন রোহান তার প্রতি আকৃষ্ট হয়। তখন অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী ছায়াবীথি। একাত্তরের এপ্রিলের মাঝামাঝি সময়ে ক্যাপ্টেন রোহান প্রথম সীমান্ত পার হয়ে লেঙ্গুরা বাজারে আসে। তখন বাজারে আন্দোলনমুখর মানুষ। ক্যাপ্টেন রোহান হিন্দি ভাষায় কথা বলে। বাঙালী কেউ তার ভাষা বুঝতে পারে না।

তখন বাজারে এসেছিল মল্লিকা এবং ছায়াবীথি। ওদের তো ক্লাসে উর্দু বাধ্যতামূলক ছিল। উর্দুর সাথে অনেকটা মিল থাকায় ওরা কিছুটা হিন্দি বুঝতো। তাই সাহস করে দুই বান্ধবী সামনে গিয়ে ক্যাপ্টেন রোহানের সাথে কথা বলে। সেদিন থেকে রোহানের দৃষ্টিতে আটকে যায় ছায়াবীথি। সেই দৃষ্টি সম্মোহনের। ছিপছিপে দেহের গড়ন রোহানের। গৌরবর্ণের নায়কোচিত সুপুরুষ। তার দৃষ্টি কি ছায়াবীথিকেও সম্মোহিত করেছিল?
এপ্রিলের শেষ সপ্তাহ থেকে দেশের অবস্থা ক্রমশ খারাপ হতে থাকে। বাঁধভাঙা ¯্রােতের মতো শরণার্থী আসতে থাকে সীমান্ত পার হয়ে। পাকবাহিনীর ভয়ে মল্লিকা এবং ছায়াবীথিদের পরিবারও চলে যায় ভারতে। রংরা বিএসএফ ক্যাম্পের সাথে শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নেয় ওদের পরিবার। কদিনের মাঝে ক্যাপ্টেন রোহান শরণার্থী শিবিরে ছায়াবীথিকে দেখতে পায়। তারপর থেকে প্রায় প্রতিদিন বিকেলে নিয়ম করে রোহান সেদিকে ঘুরতে যায়। শরণার্থী শিবিরে মানুষের প্রয়োজনে ততদিনে কয়েকটি চায়ের স্টল হয়েছে। রোহান কখনো স্টলের সামনে দাঁড়িয়ে চা পান করে। ছায়াবীথিও রোহানকে দেখে কোনো না কোনো অজুহাতে বের হয়। মল্লিকাকে ডেকে নিয়ে এসে পথের মোড়ে গল্প করে। চোখে চোখে হয় ওদের ভাববিনিময়। রোহান কথা বলার অজুহাত খোঁজে।
ততদিনে শরণার্থীদের রেশনের ব্যবস্থা করা হয়। তরুণ আর্মি অফিসার হলেও রোহানই রংরা ক্যাম্পের প্রধান। কাজেই স্থানীয় পর্যায়ে কারও কাছে জবাবদিহি করতে হয় না তার। শরণার্থীদের দেখভালের দায়িত্বও তার ওপর। রেশন সরবরাহের কাজটা করা হয় বিএএফ সদস্যদের মাধ্যমেই। রোহান রেশন প্রদানের কাজে মল্লিকা এবং ছায়াবীথিকে নিয়োজিত করে। রেশন দেয়ার জন্য পড়ালেখা জানা মানুষের দরকার। রোহান ওদের এ কাজে নিয়োজিত করে ছায়াবীথির আরও কাছাকাছি যাওয়ার সুযোগ পায়।
রংরা এলাকায় তখন সবচেয়ে ক্ষমতাশীল এবং প্রভাবশালী ব্যক্তি রোহান। সেই ব্যক্তিটির সাথে সম্পর্ক গড়ে ওঠার কারণে ছায়াবীথিদের পরিবারও কিছুটা সুবিধাভোগ করে। সুবিধা ভোগ করে মল্লিকাদের পরিবারও। ছায়াবীথি এবং মল্লিকাকে রেশন প্রদানের কাজে ক্রমে মাসোহারার ব্যবস্থা করা হয়। এভাবে ছায়াবীথির ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্য আসার সুযোগও পায়। কখনো রেশনের কাজের জন্য ক্যাম্পে ডেকে নেয় রোহান। নিরিবিলি কথা বলে। তিলে তিলে দুজনের মাঝে একটা সম্পর্ক অঙ্কুরিত হয়। কারো সাথে না বলার শর্তে ছায়াবীথি এসব কথা বান্ধবীর সাথে গোপনে আলোচনা করে। সমাজের মানুষ যাতে বাঁকা চোখে না দেখে সেজন্য রোহানের সাক্ষাতের সময় কখনো মল্লিকাকে সাথে নেয় ছায়াবীথি।
মুক্তিযুদ্ধে রিক্রুটিংয়ের কাজ শুরু হয়েছে বেশ আগে থেকে। সেক্ষেত্রে শুধু তরুণদেরই রিক্রুট করা হচ্ছে। মেয়েদের সেভাবে মুক্তিযুদ্ধে নিয়োজিত করা হয়নি। রোহান বরাবরই রংরায় মেয়েদের একটা প্লাটুন গড়ে তোলার চিন্তা করে আসছে। প্রথমে সে ছায়াবীথি এবং মল্লিকা ঘাগ্রার সাথে কথা বলে। জবাবে ওরা জানায় যে, তাদের অভিভাবক সাড়া দিতে চাইবে না। তবে তাদের আগ্রহ আছে ষোলআনা। রোহান তবু দমে যায় না। চেষ্টা আব্যাহত রাখে। আশানুরূপ সাড়া পায় না। এ বিষয়ে সে গারোদের তরুণ নেতা গাব্রিয়েল রাংসার সাথে আলোচনা করে। গাব্রিয়েল রাংসাও এ কাজে উদ্যমী হয়।
মেয়েদের এ ব্যাপারে উদ্বুদ্ধ করার জন্য মল্লিকা এবং ছায়াবীথিকে সামরিক গাড়িতে করে রোহান ডালুর কাছে গাছুয়াপাড়া ক্যাম্পে নিয়ে যায়। ওখানে মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে তরুণদের প্রশিক্ষণ দেখিয়ে দুই কিশোরীকে উদ্বুদ্ধ করা হয়। ওখানে দুদিন অবস্থান করে ওরা। ছায়াবীথি এবং মল্লিকাকে রাখা হয় শরণার্থী শিবিরে। একদিন মল্লিকা থাকে শরণার্থী শিবিরে। সামরিক গাড়িতে ছায়াবীথিকে নিয়ে তুরা জেলা শহরে যায় রোহান। মল্লিকা ধরে নিয়েছে, ওটা তাদের রোমাঞ্চকর আনন্দ ভ্রমণ। ততদিনে যে ওদের প্রণয় বেশ গভীরে পৌঁছেছে, তা বুঝতে পারে মল্লিকা। তাই যেচে ওসব জানার জন্য ছায়াবীথিকে কিছুই জিজ্ঞেস করে না। যুদ্ধ আর প্রণয়ে যে সব কিছু বৈধ, বয়স অল্প হলেও তা ততদিনে বুঝতে পারে মল্লিকা।  
সন্ধ্যার আগে আগে ওরা আবার ফিরে আসে। দুদিন সেখানে অবস্থান করে সেখান থেকে রোহানের গাড়িতে রংরায় ফিরে আসে আবার। মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পের প্রশিক্ষণ দেখে ছায়াবীথি এবং মল্লিকা মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়ার  জন্য বেশ উদ্বুদ্ধ হয়। ওদিকে রোহানও গাব্রিয়েল রাংসার সহায়তায় চেষ্টা অব্যাহত রাখে।

ঐ সাংগঠনিক কার্যক্রমে ছায়াবীথি রোহানের সাথে সামরিক গাড়িতে ১৫ কিলো দূরে পাহাড়ীপথে বাঘমারা পর্যন্ত ছোটাছুটি করে। তাদের অদম্য চেষ্টায় নারী মুক্তিযোদ্ধা প্রশিক্ষণের জন্য ১৭ সদস্যের একটি টিম গঠন করা হয়। ১ নবেম্বর থেকে লেঙ্গুরা ইয়ুথ ক্যাম্পে মহিলা প্লাটুনের প্রশিক্ষণ শুরু হয়। তাদের অস্ত্র প্রশিক্ষণসহ যুদ্ধের মাঠে রেকি কার্যক্রম এবং আহত মুক্তিযোদ্ধাদের নার্সিংয়ের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। যুদ্ধ যদি দীর্ঘস্থায়ী হয় তাহলে এমন একটি নারী প্লাটুনের খুবই প্রয়োজন হবে বলে রোহানের ধারণা।
ছায়াবীথিসহ উঠতি কিশোরী-তরুণীদের মাঝে প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণ করেছে মুকুল আজিম, তুষি হাগিদক, রকিতা হাগিদক, কুন্তুনি রংদি, অনিতা নকরেক, মাগদালিনা নেংমেনজা, রিতা রেমা, গিতা রেমা, হাসিনা বনোয়ারি, মায়া বনোয়ারি, সুজানা জাম্বিল, ঝরনা নকরেক, লিনা রেমা, সেলিনা হাউই, বেলজিনা নকরেক, মল্লিকা ঘাগ্রা।  
ডিসেম্বরের ২ তারিখে প্রশিক্ষণ শেষ হয়। ততদিনে যুদ্ধের পট পরিবর্তন হতে থাকে। পরদিনই পাকিস্তান-ভারত সর্বাত্মক যুদ্ধ ঘোষণা করে। ৩ ডিসেম্বর রাত বারোটায় ভারত সরকার সর্বাত্মক যুদ্ধ ঘোষণা করার সাথে সাথে হাই কমান্ড এই বার্তা মেঘালয় সেক্টরে পাঠিয়ে দেয়। ভারতীয় মিত্রবাহিনীর কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার হরদেও সিং ক্লিয়ার ভারতীয় বাহিনীর সামরিক অফিসার ও মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারদের নিয়ে ব্রিগেড হেডকোয়ার্টারে জরুরী বৈঠকে বসেন। তিনি সবার মাঝে যুদ্ধপরিকল্পনা পেশ করেন। পরিকল্পনা অনুযায়ী বিএসএফ সৈন্যদের নিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশের নির্দেশ দেন। সমর নির্দেশ অনুযায়ী ক্যাপ্টেন চৌহান ও রোহান নেত্রকোনা দুর্গাপুর সীমান্তে, ক্যাপ্টেন বালজিৎ সিং হালুয়াঘাট এবং ক্যাপ্টেন মুরারীকে পুর-খাসিয়া হয়ে শেরপুর, আবুল হাশেমকে ডালু থেকে তেলীখালী-হালুয়াঘাট সীমান্ত সড়ক দিয়ে ময়মনসিংহে অগ্রসর হওয়ার নির্দেশ দেন।
সাব-সেক্টর কামান্ডার তোফাজ্জল হোসেন চুন্নুর নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনী দুর্গাপুর বিরিশিরি মুক্ত করে তাদের অগ্রাভিযান অব্যাহত রাখে। ওরা তখন প্রায় শ্যামগঞ্জ পর্যন্ত চলে আসে। বিএসএফ কমান্ডার মুরারী, ক্যাপ্টেন চৌহান, রোহান ও মেজর প্রীত, কর্নেল রাওসহ যৌথবাহিনীর আর একটি দল কলমাকান্দা, আটপাড়া, নেত্রকোনা হয়ে শ্যামগঞ্জ পর্যন্ত পাকবাহিনীর পিছু ধাওয়া করে। ক্যাপ্টেন চৌহান ও রোহানের সাথে নারী প্লাটুন থেকে আসে মল্লিকা ও ছায়াবীথি। ষোল ডিসেম্বরে দেশ স্বাধীন হলে মল্লিকা ও ছায়াবীথি বিজয়ীর বেশে বাড়ি ফিরে আসে। স্বাধীনতার পর রোহানের সাথে ছায়াবীথির দেখা হয়েছে কম। কারণ, কিছুদিনের মাঝে রোহান অন্যত্র বদলি হয়।
বাহাত্তরে বালুচরা স্কুলে নবম শ্রেণিতে পড়ত ওরা। তখন ছায়াবীথি এবং মল্লিকার সাথে পরিচয় রাকিবের। পরের বছর কী একটা জরুরী কাজে বাঘমারায় আসে রোহান। তখন সে মেজর হিসাবে পদোন্নতি পেয়েছে। বাঘমারা থেকে ছায়াবীথির কাছে লোক পাঠিয়ে খবর দেয় রোহান। ছায়াবীথিকে বাঘমারা গিয়ে দেখা করতে বলে। এ সংবাদে বেশ উৎফুল্ল হয় ছায়াবীথি। অন্য কাউকে না জানিয়ে ছায়াবীথি বান্ধবী মল্লিকাকে নিয়ে বাঘমারা  রোহানের সাথে দেখা করে। কিছুক্ষণ একান্তে কী কথা হয়েছে দুজনের তা মল্লিকা শুনেনি। রোহানের কাছ থেকে অখন্ড বিষণ্ণতা নিয়ে ফিরে আসে ছায়াবীথি। সেদিন বিকেলে বাড়ি ফিরে ওরা। তাদের প্রণয়কলিটি আর বিকশিত হয়নি, সেখানেই ঝরে পড়ে। রোহান জানায়, ততদিনে বিয়ে করে সে এক সন্তানের জনক হয়েছে। সেই ঘটনার পর আর তাদের মাঝে কোনো যোগাযোগ হয়নি।
এরপর থেকে অনিন্দ্যসুন্দরী ছায়াবীথিকে অবিনাশী বিষণ্ণতা গ্রাস করে। হঠাৎ করে ছায়াবীথির এমন ভিষণ্ণতা এবং পরে এসএসসি ফেল করার কারণ খুঁজতে গিয়ে এ তথ্য মল্লিকার কাছে জানতে পারে রাকিব হাসান।

 

 

×