ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

সবচেয়ে কম পঠিত শিল্প

প্রকাশিত: ০০:০০, ২২ জুলাই ২০২২

সবচেয়ে কম পঠিত শিল্প

.

কবি জীবনানন্দ দাশ মনে করতেন, কবির জীবদ্দশায় তার কবিতার বিশজন পাঠকই যথেষ্ট। কবির এই আক্ষেপের কারণ হিসেবে আমরা ধরে নিতে পারি, কবিতা সার্বজনীন শিল্প-মাধ্যম নয়, এই মাধ্যম সমৃদ্ধ কবি ও পাঠকের। রবি ঠাকুর চমৎকার একটি কথা বলেছেন এ ব্যাপারে, সেটা এখানে প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠতে পারে, ‘কবিতা বোঝার বিষয় নয়, কবিতাকে অনুভব করতে হয়।’ অনুভব বলতে আমরা বুঝব ইন্দ্রিয়লব্ধ বিষয়াদি যেমন, ফুল দৃশ্যমান হলেও গন্ধ তা নয়, গন্ধ দেখা যায় না- ঘ্রাণান্দ্রিয় দিয়ে অনুভব করতে হয়। বিজ্ঞান যদি গন্ধকে বোতলবন্দী করে, তাহলে জেনে রাখুন বিজ্ঞান কবিতা নয়। মোটাদাগে কবিতাকে অনুভব করতে হলে থাকতে হয় উচ্চমার্গীয় বোধ এবং হরিণের কানের মতো সজাগ পঞ্চইন্দ্রিয়।

এই যে বোধ তা কোথায় থাকে, কোথা থেকে উৎপত্তি? তার একটা ব্যাখ্যা বোধহয় এখন জরুরী হয়ে পড়েছে। কবি জীবনানন্দ দাশ তার বোধ কবিতায় কিছুটা বলেছেন সে কথা, আমরা কবিতাটি স্মরণে রেখে এগোতে চেষ্টা করি। তিনি বলেছেন- ‘আলো অন্ধকারে যাই- মাথার ভিতরে/স্বপ্ন নয়,- কোন এক বোধ কাজ করে!/স্বপ্ন নয়- শান্তি নয়-ভালবাসা নয়,/হৃদয়ের মাঝে এক বোধ জন্ম লয়!’ মানে বোধিপ্রাপ্ত হওয়ার কিছু পথ আছে, যেহেতু বোধ জন্ম লয়। উদাহরণ হিসেবে রত্নাকর দস্যু থেকে বাল্মিকী হয়ে ওঠার ব্যাপারটা এখানে কিছুটা ভূমিকা রাখতে পারে। রামায়ণের রচয়িতা বাল্মিকী দস্যু থেকে কবি হয়ে ওঠেন ধ্যানের মাধ্যমে, ধ্যান মানে চর্চা, পঠনপাঠন। নিশ্চয়ই এই পঠনপাঠন হতে হবে উচ্চমার্গীয়। কবিতা বুঝতে হলে প্রচুর পঠনপাঠন থাকা লাগে, এমনটা বলেন বিজ্ঞজন আর কবি তো কেউ কেউ হয়। ব্যাপারটা চমৎকার না? যেমনটা বাল্মিকী হয়েছিলেন প্রথম শ্লোক লিখে, চমৎকৃত! মানে কবিতা লিখে যেমন কবি চমৎকৃত হয়, পঠক পড়েও একইভাবে হন হ্যাংগওভার।

বিস্তারে যাওয়া লাগে, শিল্প হচ্ছে বিনির্মাণ (অবশ্যই মিস্ত্রিগিরি নয়) আর জ্ঞান হচ্ছে আবিষ্কার। প্রকৃতির যে নিয়ম তার অন্তর্গত বৈশিষ্ট্য জানার যে পদ্ধতি, তা এই জ্ঞানের পথ- আর শিল্পের পথ হচ্ছে প্রকৃতির রূপের বিবিধ উপস্থাপন যা উৎপাদন করে মূলত সৌন্দর্য। আর শিল্পের এই সৌন্দর্য সৃষ্টি করতে লাগে বোধ, যে বোধের কথা জীবনবাবু বলেছেন তার বোধ কবিতায়। যে বোধ প্রাপ্ত হওয়ার পরই বাল্মিকী মৈথুনরত দুটি পাখির ভেতর একটিকে হত্যা করতে দেখে উচ্চারণ করে বসেন প্রথম শ্লোক, ‘মা নিষাদ প্রতিষ্ঠাং ত্বমগমঃ শাশ্বতীঃ সমাঃ/যৎ ক্রৌঞ্চমিথনিষাদেকমবধীঃ কামমোহিতমঃ’ তার মানে শিল্প সৃষ্টির মূলে হচ্ছে বোধিপ্রাপ্ত হওয়া এবং প্রাপ্ত অনুভূতি স্বর-সুর-তাল-লয় ও ভাষা সহযোগে প্রকাশ করা। এই যে প্রকাশিত কাব্যটি, তার থাকতে হয় রস, রসের আবার নয়টি ভাগ আছে (১) আদি, (২) বীর, (৩) করুণ, (৪) অদ্ভুত, (৫) হাস্য, (৬) ভয়ানক, (৭) বীভৎস, (৮) রৌদ্র এবং (৯) শান্ত।

রবি ঠাকুর বলেছেন, কাব্যের মূলে রয়েছে এই রস সৃষ্টির খেলা, যেটা বাল্মিকীর প্রথম শ্লোকে দৃশ্যমান। তাঁর লেখা সেই প্রথম কাব্য করুণ রসে সিক্ত, তিনি মিথুনরত দুটি পাখির ভেতর একটাকে হত্যা করতে দেখে ব্যথা পেয়েছিলেন, তাই বলে উঠেছিলেন ‘নিষাদ, তুই চিরকাল প্রতিষ্ঠা লাভ করবি না, কারণ তুই কামমোহিত ক্রৌঞ্চমিথুনের একটিকে বধ করেছিস।’ অধিকাংশ কবিতাই লেখা হয়ে থাকে করুণ রসে, বলা হয় ব্যথা না পেলে কবিতা লেখা যায় না। প্রায় সকল কবিরই কবিতা লেখার শুরুটা প্রেমে ব্যর্থ হয়ে। সিগমুন্ড ফ্রয়েড তাঁর মনোসমীক্ষণ তত্ত্বে বলেছেন, যার প্রতি মানুষের সবচেয়ে বেশি আকর্ষণ তাই নিষিদ্ধ। তিনি তার টোটেম এ্যান্ড টাবু গ্রন্থে এর যথাযথ ব্যাখ্যাও দিয়েছেন। তাঁর ভাষ্যে টোটেম জনিত কারণে আদিম সমাজে টাবুর উৎপত্তি ঘটে, যেহেতু টাবুগুলো পরবর্তীতে ক্ষমতাসীনদের দ্বারা সমাজে আরোপিত হতে থাকে ফলত নিপীড়িত শ্রেণীর ওপর সেটাকে চাপানো হয় পাপ হিসেবে, যেখানে সাজা পাওয়ার ভয়টা হয় প্রবল। ভয়াবহ। ফলত সৃষ্টি অবদমনের। (ফ্রয়েডের এই দর্শন প্রাশয়ই যৌনতার ইঙ্গিতবাহী।)

এই অবদমিত অবস্থা মানুষের মস্তিষ্কের অচেতন স্তরে জমা হতে থাকে এবং পর্যায়ক্রমে রূপক সৃষ্টির মাধ্যমে তা প্রকাশ পায়। ফ্রয়েডের ভাষায় টাবু হয়ে ওঠেন, মানে তার চেতনাদ্বারা অন্য আর একজনকে সংক্রমিত করেন। এটাই মূলত কাব্যের লক্ষ্য, সংক্রমিত করা, পক্ষান্তরে মিথষ্কৃয়া। শিল্পের যেহেতু অনেকগুলো মাধ্যম, তাই তার প্রকাশভঙ্গিও অনেক রকম; আবার সবই একই সূত্রে গাঁথা। যেমন চিত্রকর নানার রঙের সংমিশ্রণ করে ছবি আঁকেন, কবি শব্দ দিয়ে কবিতা লেখেন, নাটকে থাকে সংলাপ এবং অভিনয়, লাইট, মঞ্চ, সাজসজ্জা, প্রপস এগুলো সামগ্রিক অর্থে নাটককে নাটক হয়ে উঠতে সহায়তা করে, সঙ্গীতের আছে সুর, স্বর, তাল, লয় যা নানারকম বাদ্যযন্ত্রের মাধ্যমে বিমূর্ত হয়ে ওঠে। কিন্তু কবিতার অস্ত্র একটাই, শব্দ। শব্দব্রহ্ম। ফলে ছবি, নাটক, সঙ্গীত একই সূত্রে গাঁথা হলেও, কবিতার এসবের সকল রস থাকা সত্ত্বেও নাটক, ছবি, সঙ্গীতের মতো কবিতা সার্বজনীন শিল্প নয়।

নয় এই কারণে, কবিরা মনে করে কবিতা সকলের জন্য নয়। অথচ নাটকে আমরা লক্ষ্য করি ভাবকে প্রকাশ করতে, সার্বজনীন করে গড়ে তুলতে সংলাপের সঙ্গে অভিনয় এবং অভিনেতাকে সাহায্য করতে সঙ্গীত, লাইট, প্রপস, মঞ্চ, সাজসজ্জা মোটাদাগে নাটককে দর্শক-শ্রোতার কাছে অর্থবহ করতে তুলতে নাট্যকার সদা সচেতন। সঙ্গীতে নাটকের প্রায় সকল গুণাবলি থাকে, থাকে রসাসিক্ত সুর ফলে শ্রোতার চৈতন্য সে দ্রুত নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম। ছবি এমনিতেই দৃষ্টিনন্দন, যেমন রামধনুর অর্থ খুঁজতে হয় না, তার সৌন্দর্যই দর্শককে আকৃষ্ট করতে যথেষ্ট। কিন্তু কবিতায় তা সম্ভব নয়, কারণ কবিতার সুর-স্বর, রস, ছন্দ, চিত্র, চিত্রকল্প, ভাব, নাটকীয়তা, সবকিছুকেই ধরে রাখে শব্দ। ফলে শব্দের নানামুখী সম্ভাবনা সম্পর্কে যার পর্যাপ্ত ধারণা নেই তিনি কবিতা বোঝেন না।

কবিতা সেও বোঝে না যার নেই অলঙ্কার সম্পর্কে পর্যাপ্ত ধারণা, নেই সাহিত্যে আন্দোলনগুলোর তাত্ত্বিক পঠনপাঠন। বলা হয়ে থাকে শিল্প প্রতি মুহূর্তে বিনির্মিত হয়, ফলে সময়ের সঙ্গে নিজেকে খাপ খাওয়াতে না পারলে, সমসময়কে ধরতে যে তাত্ত্বিক জ্ঞানচর্চা আছে সে বিষয়ে সাম্যক ধারণা না থাকলে; ইতিহাস সম্পর্কে জ্ঞান না থাকলে কবিতা বোঝা সম্ভব না। নীৎশের ঈশ্বরকে মৃত ঘোষণা করা, দেরিদার বিনির্মাণ তত্ত্ব কবিতাকে যে বহুরৈখিকতায় উন্নিত করেছে যার ব্যাখ্যা, বিশ্লেষণের অসম্ভব। পোস্টমডার্ন কালপর্বকে চিহ্নিত করার মতন। এই সময়টা নাকি এতোই এলোমেলো যাকে ধরতে শিল্প দুর্বোধ্য হয়ে পড়েছে, বিশেষভাবে কবিতা। তাই এই সময়ের কবিতাকে পাঠকের বুঝতে হলে চাই বিস্তর পড়াশোনা, নাহ্ তাতেও সন্তুষ্ট নন কবিরা; বলেন, সঙ্গে থাকতে হবে সংবেদনশীল মন, এর পরেও যে কবিতার মর্মোদ্ধার করতে পারবে পাঠক তার কোন নিশ্চয়তা নেই। একেবারেই নেই, যদি না অলৌকিকভাবে কেউ বোধিপ্রাপ্ত হন। অথচ দর্শক, শ্রোতা হতে পারবেন সকলেই।

মানেটা এরকম দাঁড়াচ্ছে যে, ‘সকলেই পাঠক নয়, কেউ কেউ পাঠক হয়।‘ প্রশ্ন হচ্ছে বাংলা কবিতার ওপর এই মহত্ত্ব আরোপ করলেন কে? যখন এই বঙ্গে লোককবিদের রমরমা ছিল, তখন তো কবিতা সর্বসাধারণের কাছে দুর্বোধ্য ছিল না? বরং সাধারণের শিল্পই ছিল সমষ্টির শিল্প। বৈষ্ণব পদাবলি, ময়মনসিংহ গীতিকা, জারি, সারি, ভাটিয়ালি, ভাওয়াইয়া, চটকা, পুথি, পাঁচালী, লালনগীতি এগুলো নিয়ে তো কখনও দুর্বোধ্যতার অভিযোগ ওঠেনি? অভিযোগ উঠেছে তখন, যখন আমরা আমাদের মূল থেকে সরে গিয়ে আধুনিক হতে চেয়েছি, লোককবিদের ব্যাঙ্গ করতে শুরু করেছি; বলতে শুরু করেছি ওগুলো হচ্ছে ইতরদের শিল্প, আধুনিকতার নামে আমরা যেটা আমদানি করেছি সেটাই হচ্ছে আসল। অথচ লোকগীতিতে কবিতার সকল রসদই বিদ্যমান। কথা সেটা না, কথা হচ্ছে বাংলা কবিতার ওপর এই মহত্ত্ব আরোপ করলো কে? জীবনানন্দ দাশ? বুদ্ধদেব বসু? নাকি বাংলা কবিতায় আধুনিকতার জনক বলে যে কবিদের আমরা চিনি?

এভাবে কয়েকজনের ওপর দোষ চাপিয়ে দিয়ে মূল সমস্যার সমাধানে যাওয়া সম্ভব না, কারণ সমস্যাটা আমাদের মজ্জাগত। ফ্রয়েড বলেছেন টোটেমরা টাবু তৈরি করে, টাবু হচ্ছে রীতি যেমন, আমাদের আপনজন মারা গেলে শেষকৃত্য করি, কেন করি? আমাদের ধারণা মৃত ব্যক্তির আত্মা শেষকৃত্যর মাধ্যমে স্বর্গ লাভ করবে; ব্যাপারটা আসলে তা নয়, আমরা মনে করি মৃত ব্যক্তির সৎকার না হলে তার মুক্তি ঘটবে না, আর যদি মুক্তি না পায়, তাহলে সে ভূত হয়ে আমাদেরই ঘাড় মটকাবে অথবা আমাদের ক্ষতি করবে, কিন্তু এই মৃত ব্যক্তি জীবিতাবস্থায় আমাদের পরম আত্মীয় ছিল, হয়ত সে ছিল পিতা নয়ত মাতা কিংবা স্বামী, স্ত্রী, সন্তান। জীবিতাবস্থায় আমাদের বোঝাপড়ায় ত্রুটি থাকার কারণে আমরা মনে করি এখন যখন সে মৃত তাই তিনি আমাদের ওপর প্রতিশোধ নিতে পিছপা হবেন না, তাই আমরা সৎকার করি যাতে মৃত ব্যক্তির ভূত আমাদের কোন ক্ষতি না করতে পারে। মানুষের এই ভীতি থেকেই টাবুর জন্ম। এই টাবু পালন করতে আমরা হেন কোন কাজ নেই যা করতে পারি না, এমনকি খুনও। শুধু তাই নয় বীভৎসভাবে খুন, পাথর ছুড়ে, জবাই করে, বোমা মেরে। আমরা যদি টাবু ভাঙা ব্যক্তিকে হত্যা না করতে পারি, মনে করি আমাদের সর্বনাশ হবে; যেমন এই উপমহাদেশে ধর্ম রক্ষা করার নামে ধর্মান্ধরা করে থাকেন, তারা মনে করে কেউ তার ধর্মের সমালোচনা করলেই তাদের ধর্মের অস্তিত্ব থাকবে না। এই হচ্ছে ভীতি, এগুলো এখন অধিকাংশই সুবিধাভোগীদের চাপিয়ে দেয়া।

কবিতার ক্ষেত্রেও এই একই ভীতি কাজ করে কিছু সুবিধাভোগী প্রতিষ্ঠিত কবিদের, তারা মনে করেন অন্য আরও অনেকে যদি ভাল কবিতা লিখতে শুরু করে তাহলে তাদের কবিত্ব লঘু হয়ে যাবে; তাই তারা কবিতার ওপর নানান মহত্ত্ব চাপিয়ে দেন; কবি নিজে হয়ে উঠতে চান অতিপ্রাকৃত কোন শক্তির অধিকারী। সাধারণের নাগালের বাইরের কেউ, ঈশ্বরের মতন। আর এই টাবুকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য একের পর এক কবিতার ওপর আরোপ করতে থাকেন তাদের কল্পিত মহত্ত্ব। ফলত এর চাপটা আর পাঠক নিতে পারে না, দূরে সরে যান- অনেক দূরে, আর কবি যশপ্রার্থী কিছু চাটুকার এই টাবুগুলো আওরাতে থাকেন ঈশ্বরের বাণীর মতো। হয়ত অনেকের মনে হতে পারে এগুলো ঔপনিবেশিক ধারণা, ব্যাপারটা ভুল নয়, তারাও তো নিজেদের উৎকৃষ্ট মনে করতেন আর আমাদের নিকৃষ্ট। তাই তো তারা বলেছেন, আমাদের মতো আধুনিক হও, আর আমরা একটা কেন্দ্র গড়ে তুলেছি। এসব আধুনিকতা জটিলতা কিংবা কিছু অসাধু কবি, সমালোচকদের কবিতার ওপর চাপিয়ে দেয়া টাবু ভাঙ্গতে হবে, নাহলে কবিতার মুক্তি নেই। মুক্তির কথা বলা মানুষেরা এখন অন্তহীন টাবু অথবা সীমাবদ্ধতার ভেতর বন্দী হয়ে আছেন।

 

×